সম্পদ সন্ধানে ৫ কৌশল
পাচারের তথ্য চেয়ে বিদেশে চিঠি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশ থেকে পাচারের টাকা সন্ধানে পাঁচ কৌশলে এগোতে চায় টাস্কফোর্স। এগুলো হচ্ছে আমদানি পণ্য এবং রপ্তানির মূল্য দেশে না আনা, আমদানি বা রপ্তানির ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য, হুন্ডি ব্যবসার মাধ্যমে এবং অন্যান্য পন্থায় টাকা পাচার। উপকরণগুলোর তথ্য সংগ্রহের পর বিশ্লেষণের মাধ্যমে শনাক্ত করা হবে দেশ থেকে কারা, কিভাবে টাকা পাচার করেছে। দ্বিতীয়ত, কোন কোন দেশে পাচার করেছে এবং পাচার করা সম্পদ কি অবস্থায় আছে। পাচারের টাকা শনাক্ত ও দেশে ফেরাতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। ক্ষেত্রভেদে এর আলোকে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সাবেক ১৪ মন্ত্রী, ১৬ এমপি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের তথ্য জানতে বিএফআইইউ থেকে এগমন্ট গ্রুপের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কেও তথ্য চাওয়া হয়েছে।
তথ্য সংগ্রহের পর পাচারকারীর বিরুদ্ধে আরও বহুমুখী তদন্ত শেষে বিশদ প্রতিবেদন তৈরি হবে। এর ভিত্তিতে হবে মামলা। মামলা পরিচালনায় দক্ষ আইনজীবী নিয়োগের পাশাপাশি সরকারি অন্যান্য সংস্থা থেকেও সহায়তা নিশ্চিত করা হবে। আদালতে পাচারের ঘটনা প্রমাণ করা গেলেই সেগুলো ফিরিয়ে আনার জন্য জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ প্রক্রিয়ায় সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে কাজে লাগানো হবে।
পাচার করা সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং ওইসব সম্পদের ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সম্প্রতি পুনর্গঠিত টাস্কফোর্স এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এগোতে চায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে প্রধান করে সম্প্রতি এই টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করা হয়। বুধবার টাস্কফোর্সের প্রথম বৈঠক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। এতে টাস্কফোর্সের সদস্যসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে দেশ থেকে কারা কিভাবে টাকা পাচার করেছেন, কোথায় করেছেন, সেগুলো কিভাবে শনাক্ত এবং ফিরিয়ে আনা যায় সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
সূত্র জানায়, যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছে, সেগুলো দেশে ঠিকমতো আসছে কিনা আগে তা দেখা হবে। যাদের পণ্য দেশে আসেনি। পরে এ বিষয়ে আমদানিকারক ব্যাংকের কাছে যুক্তিযুক্ত কোনো ব্যাখ্যাও দেননি। প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া হবে ওইসব আমদানিকারক দেশ থেকে টাকা পাচার করেছেন। একই ভাবে রপ্তানির মূল্য নির্ধারিত সময়ে দেশে আনেননি বা এ বিষয়ে ব্যাংকের কাছে কোনো ব্যাখ্যাও তুলে ধরেননি বা ব্যাখ্যা দিলেও ব্যাংক তা গ্রহণ করেনি। এমন রপ্তানিকারককে প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া হবে টাকা পাচার করেছেন। এছাড়া আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে বা এলসিতে উল্লিখিত পণ্যের চেয়ে কম পণ্য এনে অথবা দাম বেশি দেখিয়ে নিম্নমানের পণ্য এনেছেন। এর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি এমন আমদানিকারকদেরও প্রাথমিকভাবে টাকা পাচার করেছেন বলে ধরে নেওয়া হবে। একইভাবে রপ্তানি পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে বা এলসিতে উল্লিখিত পণ্যের চেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করেছেন বলে শনাক্ত হয়েছে, কিন্তু এর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই। এমন রপ্তানিকারকদেরও টাকা পাচার করেছেন বলে ধরে নেওয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করতে প্রয়োজনে সরকারি অন্যান্য সংস্থারও সহযোগিতা নেওয়া হবে। এর মধ্যে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, বিভিন্ন বন্দর কর্তৃপক্ষ ও গোয়েন্দা সংস্থা।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় হুন্ডিবাজদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। আগে গোয়েন্দা সংস্থা, স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে হুন্ডিবাজদের শনাক্ত করা হবে। তারপর তাদের মূল হোতা বা গডফাদারকে শনাক্ত করা হবে। তাদের মাধ্যমে কারা কোথায় টাকা পাচার করেছে সেসব তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এর বাইরে অন্যান্য পন্থায় ক্রেডিট কার্ড, বিদেশ ভ্রমণ, স্বর্ণ বা হীরা চোরাচালানের মাধ্যমে কারা টাকা পাচার করেছেন তাদেরও শনাক্ত করা হবে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা উৎস ব্যবহার করে আরও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করবে। এর আলোকে সংস্থাটি দেশ থেকে শীর্ষ টাকা পাচারকারীদের একটি তালিকা করবে। ওই তালিকা ধরে সংস্থাটি এগমন্ট গ্রুপের (মানি লন্ডারিং বিষয়ক তথ্য আদান প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা) মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করবে। এভাবে এখন টাস্কফোর্স সামনের দিকে এগোবে।
সূত্র জানায়, তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে দেশ থেকে পাচার করা সম্পদ ও বিদেশে কোথায় কি অবস্থায়, কাদের কি ধরনের সম্পদ আছে সে বিষয়ে বিএফআইইউ একটি ডাটাবেজ তৈরি করেছে। এসব ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সূত্র থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য ইতোমধ্যে বিএফআইইউ থেকে এগমন্ট গ্রুপের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে সাবেক ১৪ মন্ত্রী, ১৬ এমপি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আছে কিনা সে বিষয়ে তথ্য চেয়েছে। পাশাপাশি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী সাইফুল আলম মাসুদের মালিকানাধীন এস আলম গ্রুপ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম মজুমদারের মালিকানাধীন নাসা গ্রুপ, আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত নাম নাফিজ সরাফাত, আজিজ খানের মালিকানাধীন সামিট গ্রুপসহ আরও কয়েকটি কোম্পানির বিদেশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এছাড়াও বিদায়ি সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত আরও একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের নামে বিদেশে সম্পদের তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ।
বৈঠকে বলা হয়, পাচার করা সম্পদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। মামলা করেই দেশে-বিদেশে পাচারকারীদের সম্পদ জব্দ করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পুরো বিষয়টিই সম্পন্ন করা হবে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে করা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আইনি বাধাগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করার পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বিদেশ থেকে উদ্ধার করা সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনে একটি কোম্পানি গঠনের প্রস্তাবও এসেছে। অনেক দেশে পাচার করা সম্পদ উদ্ধার করে তা কোম্পানির মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। পাচার করা সম্পদ উদ্ধারের বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে কাজের সমন্বয় করার বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়।
টাস্কফোর্সের সদস্য সংখ্যা আগে ছিল নয়জন। বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধিকে যুক্ত করে সদস্য সংখ্যা ১০ জনে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাচার ঠেকাতে তদারকি বাড়ানোর পাশাপাশি এসব কাজে যেসব সংস্থা কাজ করবে সংশ্লিষ্টদের কাজ জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিকভাবে খোঁজ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা জেনেছেন, পাচার করা সম্পদ ফেরত আনা নির্ভর করে অনেকটা যে দেশে পাচার হয়েছে সে দেশটির মানসিকতার ওপর। যে দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে ওই দেশে আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি সন্তোষজনক থাকলে তারা সাধারণ তথ্য দিয়ে সহায়তা করে। কিন্তু রাজনৈতিক বা হয়রানি করার উদ্দেশ্যে যদি পাচার করা সম্পদের তথ্য চাওয়া হয় এবং সেটি তারা বুঝতে পারে তাহলে আর তথ্যও দেয় না। পাচার করা সম্পদ ফেরাতেও কোনো সহায়তা করে না। যে কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পাচার করা যেসব ব্যক্তির সম্পদের তথ্য চাওয়া হয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে অনেক দেশই তথ্য দেয়নি। তারা তথ্য চাওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণের শর্ত আরোপ করে। এত দিন বাংলাদেশ তা করতে পারেনি।
এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আন্তর্জাতিকভাবে তার বড় ধরনের গ্রহণযোগ্যতা আছে। তিনি ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘের কাছে পাচার করা সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সহায়তা চেয়েছেন। তারা সহায়তা করতে সম্মতিও দিয়েছেন।
অনেকেই বলেছেন, এখন এই সরকারের প্রধান কাজ হবে ড. ইউনূসের খ্যাতিকে ব্যবহার করা। বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশে বেশি মাত্রায় টাকা পাচার হয়েছে তা জব্দ করার জন্য ওইসব দেশের সরকারগুলোকে রাজি করানো। এটি হলেই পাচারকারীরা একটি শক্ত বার্তা পাবে। এজন্য প্রাথমিক কাজগুলো সরকারকে জোরালোভাবে এবং দ্রুত করতে হবে। তা হলেই পাচার করা টাকা ফেরাতে ভালো ফল পাওয়া যাবে। পাচার করা টাকা যে দেশেই আনতে হবে এমনটা ভাবা যাবে না। পাচার করা সম্পদ জব্দ করে বাংলাদেশ সরকারের জিম্মায় নিতে হবে। সম্পদ যে দেশে আছে সেখানেই থাকবে, কিন্তু সম্পদের সুবিধাভোগী হবে বাংলাদেশের জনগণ।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে যুক্তরাজ্যে ২৫ কোটি ডলার মূল্যের ৩৬০টির বেশি বিলাসবহুল সম্পত্তি রয়েছে। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়ও তার সম্পদ ও ব্যবসা রয়েছে। এসব সম্পদ জব্দ করার জন্য যুক্তরাজ্যের অপরাধ তদন্ত সংস্থার কাছে চিঠি দিয়েছেন দেশটির বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক এমপি। বিষয়টি নিয়ে দেশটিতে তুমুল আলোচনা চলছে।
এদিকে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে অর্থ পাচার বিরোধী জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠকে হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া ও আইনগত জটিলতা নিরসনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।