Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

আন্ডারওয়ার্ল্ডে আবারও সক্রিয় অপরাধী চক্র

চাঁদাবাজি, দখলদারত্বসহ নানা অপকর্মে জড়াচ্ছে চক্রের সদস্যরা * অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে খুনের পরিকল্পনা, মোটা অঙ্কের টাকা পৌঁছেছে জিসানের কাছে * পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্রের একাংশ চলে গেছে সন্ত্রাসীদের হাতে

Icon

সিরাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আন্ডারওয়ার্ল্ডে আবারও সক্রিয় অপরাধী চক্র

আন্ডারওয়ার্ল্ডে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে অপরাধী চক্র। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ইতোমধ্যে ৯ শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিন পেয়েছে। আরও তিন শীর্ষ সন্ত্রাসী চেষ্টা চালাচ্ছে জামিনের। জামিনপ্রাপ্ত ও পলাতক সন্ত্রাসীরা নতুন করে দল গোছানোর পাশাপাশি জড়িয়ে পড়ছে চাঁদাবাজি, দখলদারত্বসহ নানা অপকর্মে। এমনকি অপরাধ সাম্রাজের নিয়ন্ত্রণ নিতে কেউ কেউ করছে প্রতিপক্ষকে খুনের পরিকল্পনা। একটি খুনের পরিকল্পনা এরই মধ্যে ফাঁস হয়ে গেছে। ২০ বছর দেশের বাইরে থাকা এক সন্ত্রাসী দেশে ফিরেছেন আওয়ামী লীগ আমলের শেষের দিকে। তাকে হত্যা করতে দুবাইয়ে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে দেখা করেছেন তার অনুসারী নিছার উদ্দিন কাজল (বগা কাজল)। কাজল তার (জিসান) হাতে এরই মধ্যে তুলে দিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। এছাড়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ঘটনায় পুলিশের কাছ থেকে যেসব অস্ত্র লুট হয়েছে সেগুলোর একাংশ চলে গেছে সন্ত্রাসীদের হাতে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া খুনের ঘটনাতেও নাম আসছে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি রাজধানীর মগবাজারের বিশাল সেন্টারে দলবল নিয়ে মহড়া দিয়েছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন। ২০০১ সালে সরকার যে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম প্রকাশ করে তাদের মধ্যে অন্যতম এই সুব্রত। তার নামে এখনো ইন্টারপোলের রেড নোটিশ ঝুলছে। প্রকাশ্যে আছে ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালসহ অনেকেই। পিচ্চি হেলালের বিরুদ্ধে দুই যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় মামলা হয়েছে।

এদিকে জিসানের সহযোগী হিসাবে এই মুহূর্তে বেশ তৎপর খিলগাঁওয়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী বগা কাজল। সে ধানমন্ডির ইমন-মামুন গ্রুপের হয়েও কাজ করছে। মামুন বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। মেরাদিয়ার একু মিয়া ও মজনু হত্যা মামলায় আলোচিত মিন্টু গ্রুপও প্রকাশ্যে এসেছে। এক সময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীর গ্রুপের কয়েকজন সদস্যও সাম্প্রতিক সময়ে তৎপর হয়েছে। বগা কাজলের কাছে ২২-২৩টি আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। সম্প্রতি এসব অস্ত্র মামুন, শামীম, কিলার আব্বাস ও শাহাদাতের লোকদের মধ্যে ভাগাগাগি হয়েছে। বগা কাজলের নামে বিভিন্ন সময়ে ৩৮টি মামলা হয়। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা হয়েছে।

এক শীর্ষ সন্ত্রাসী বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে জানায়, গার্মেন্টস এবং রিয়েল এস্টেট সেক্টরে চাঁদাবাজি এবং দখলদারত্বের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ তৎপরতা দেখা যাচ্ছে কাজল বাহিনীর। গার্মেন্টস সেক্টর থেকে কাজল নিজে চাঁদা নেয় না। তবে তার লোকজন দিয়ে টাকা আদায় করে। জমিজমা দখলের ক্ষেত্রে সে নিজে সরাসরি যুক্ত হচ্ছে। ওই শীর্ষ সন্ত্রাসী বলে, সাম্প্রতিক সময়ে থানা ও কারাগার থেকে যেসব অস্ত্র লুট হয়েছে এর একটি অংশ গিয়েছে কাজল বাহিনীর সদস্যদের হাতে। আন্দোলনের সময় তার লোকজন থানায় হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুট করেছে। অপরদিকে অন্দোলনের সময় কাজল নিজে নৌকা মার্কার গেঞ্জি পরে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালিয়েছে। গুলি করে অনেক ছাত্রকে হত্যা করেছে।

গত ৩ সেপ্টেম্বর রামপুরা থানায় করা এক সাধারণ ডায়েরিতে (জিডি) সাইয়ন এসেট ডেভেলপার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিজালক রাজীব চন্দ্র পোদ্দার উল্লেখ করেন, ‘৮ আগস্ট বিকালে অপরিচিত চারজন লোক দুটি মোটরসাইকেলে পূর্ব রামপুরা এলাকায় আমার প্রকল্পে আসে। তারা আমার সহকারী মাসুমের কাছে আমার মোবাইল নম্বর চায়। পাশাপাশি ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দিলে কোম্পানির মালিকসহ যাকেই সাইটে পাওয়া যাবে তাকেই গুলি করে হত্যা করা হবে বলে হুমকি দিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় ছইয়া বাবু নামের এক ব্যক্তি মোবাইল নম্বর দিয়ে যায়। আমি ওই নম্বরে যোগাযোগ করলে আমাকে বলা হয়, ‘দুইদিনের মধ্যে ১০ লাখ টাকা না দিলে আপনাকে গুলি করে হত্যা করা হবে।’ জানতে চাইলে রাজীব চন্দ্র পোদ্দার বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, রামপুরা-বাড্ডা এলাকার সন্ত্রাসী পরিচয় দিয়ে ছইয়া বাবু পিস্তলের ভয় দেখিয়ে আমার কাছে চাঁদা দাবি করেছে।

৫ অক্টোবর হাতিরঝিল থানায় দেওয়া এক অভিযোগে রাইম রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম খান বলেন, পশ্চিম রামপুরাতে আমার একটি সাইট আছে। সম্প্রতি সেখানে সন্ত্রাসী, মাদকাসক্ত ও চাঁদাবাজ চক্রের দৌরাত্ম বেড়েছে। ৩০ সেপ্টেম্বর বিকালে কতিপয় সন্ত্রাসী সাইটের লোকদের মারধর করে। সেখান থেকে পিকআপ ভ্যানে করে রড, সিমেন্ট ও অন্যান্য মালামাল নিয়ে যায়। প্রতিদিন সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজরা সাইটে এসে ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে ও হুমকি দিচ্ছে। এতে লেবার ও মিস্ত্রিরা আতঙ্কে আছে। যে কারণে সাইটের কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। টোটাল রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের হেড অব এইচ আর সালেহ আহমেদ ১ অক্টোবর এক অভিযোগে বলেন, মগবাজারের নয়াটোলায় আমাদের প্রজেক্ট। সেখানে উচ্ছৃঙ্খল ও নেশাগ্রস্ত সন্ত্রাসীরা আড্ডা দেয়। প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার ও গার্ডরা বাধা দিলে তাদের মারধর করা হয়। তারা প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ারকে হত্যার হুমকিও দিয়েছে। এতে প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার ও নিরাপত্তাকর্মীদের জীবন হুমকির মধ্যে রয়েছে।

কারাসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত দুই মাসে যেসব শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে বের হয়েছে তাদের মধ্যে আছে-কিলার আব্বাস, খোরশেদ আলম রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু, সাঈদ হোসেন, সানজিদুল হাসান ইমন, নাইম আহমেদ ওরফে টিটন, পিচ্চি হেলাল, সাজু, আক্তার হোসেন প্রমুখ। ফ্রিডম সোহেল, হাবিবুর রহমান তাজ ও এসএম আরমান জামিনের চেষ্টা চালাচ্ছে।

সূত্র জানায়, গ্রেফতার হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীকে মুক্তি দেওয়ার প্রথম ঘটনা ঘটে ২০১২ সালে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ২০১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রাডো জিপে করে কারাগার থকে রেবিয়ে যায় শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ কুমার বিশ্বাস ওরফে বিকাশ। ওই ঘটনাটি তখন ছিল টক অব দ্য কান্ট্রি। রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় ২০১৮ সালের ২৭ মে গোপনে জেল থেকে ছাড়া পান সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ। ওই ঘটনাটিও ছিল ব্যাপক আলোচিত। এই দুজন ছাড়াও বেশকিছু সন্ত্রাসী ছাড়া পান গত ১৫ বছরের বেশি সময়ে। এদের মধে গোপীবাগ-মতিঝিলের আতঙ্ক নাসির উদ্দিন অন্যতম। ২৩ বছর পর সে ইতালি থেকে দেশে ফেরে গত নির্বাচনের আগে। জামিনের পর কথা না রাখার কারণে ফের গ্রেফতারও হয় কেউ কেউ। এদের মধ্যে অন্যতম খারশেদ আলম ওরফে রাশু। গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর জেল থেকে ছাড়া পেলেও ২৭ সেপ্টেম্বর ফের অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয় তাকে। পরে প্রায় ১১ মাস জেল খাটার পর সম্প্রতি সে জামিন পায়। মিরপুর ও কাফরুল এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস টানা ২৩ বছর কারাগারে ছিল। তার বিরুদ্ধে থাকা ১১টি মামলার ১০টিতেই ছিলেন জামিনে। তুলনামূলক দুর্বল মামলাটিতে জামিন নেওয়ার পর গত ১২ আগস্ট সে কারাগার থেকে বের হয়। জি

সানজিদুল ইসলাম ইমন কারাগার থেকে ছাড়া পান গত বছরের মাঝামাঝি। গত সেপ্টেম্বরে রাজধানীর তেজগাঁও বিজি প্রেস এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ মামুনের ওপর গুলির ঘটনায় তাকে ফের গ্রেফতার করা হয়। মামুন ছিল চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ও টিপু (সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই) হত্যা মামলার আসামি। গত সেপ্টেম্বরে খুন হওয়ার কিছুদিন আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিল মামুন। সেপ্টেম্বরে গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত চিত্রনায়ক সোহেল হত্যা মামলায় ইমন ১৯৯৮ সাল থেকে কারাগারে ছিল। মাঝে কয়েক মাস বাইরে থাকার পর গ্রেফতার হয়ে টানা ১১ মাস জেলে থেকে সম্প্রতি মুক্তি পায় সে। ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকার ২ নম্বরে টিটনের নাম রয়েছে। ২০০৩ সালে গ্রেফতারের পর থেকেই সে কারাগারে ছিল। সম্প্রতি কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে পুলিশের আইজি ময়নুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, যেসব সন্ত্রাসী ছাড়া পাচ্ছে তাদের বিষয়টি আমরা অবগত। তাদের আমরা কঠোর নজরদারিতে রেখেছি। আশা করছি, আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা কোনো অপকর্ম চালাতে পারবে না। র‌্যাব মহাপরিচালক একেএম শহিদুর রহমান বলেন, জামিনপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আমরা মনিটরিংয়ের মধ্যে রেখেছি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম