বিশেষজ্ঞদের অভিমত
মব ট্রায়ালে হত্যা মানবাধিকার লঙ্ঘন
রাষ্ট্রের দায়িত্ব হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া -মনজিল মোরসেদ
আলমগীর মিয়া
প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
মব ট্রায়াল বা জনতার বিচারে মানুষ হত্যাকে বেআইনি উল্লেখ করে তা আইনের শাসন তথা মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে মনে করছেন আইনবিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, গণপিটুনি আইনশৃঙ্খলা ও আইনের শাসন-সবকিছুর ন্যূনতম সভ্যতার পরিপন্থি। যদি এসব কর্মকাণ্ড চলতে তাকে, তাহলে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, এগুলো ভুল ছিল কি না-এ নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। যুগান্তরকে দেওয়া পৃথক সাক্ষাৎকারে তারা এসব কথা বলেন।
প্রসঙ্গত, মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) সেপ্টেম্বর মাসের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, সেপ্টেম্বরে দেশে গণপিটুনির ৩৬ ঘটনায় অন্তত ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত করা হয়েছে আরও ১৪ জনকে। একই মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় সারা দেশে নিহত হয়েছেন অন্তত ১৬ জন, আহত ৭০৬ জন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে মানবাধিকার পরিস্থিতির কিছু বিষয়ে উন্নতি ঘটলেও সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। বরং কিছু ক্ষেত্রে অবনতি ঘটেছে।
এতে তারা বলেছে, সেপ্টেম্বরে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আধিপত্য বিস্তারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সহিংসতা, গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা, রাজনৈতিক মামলা ও গ্রেফতার, সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ, শ্রমিক হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, কারা হেফাজতে মৃত্যু, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশি নির্যাতন ও হত্যা এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা অব্যাহত আছে।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী জেডআই খান পান্না যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি সারা দেশে মব ট্রায়াল তথা ক্ষুব্ধ জনতা কর্তৃক মানুষকে হেনস্তা বা সাজাদানের ঘটনার বিস্তার ঘটেছে। মব ট্রায়াল কোনো ট্রায়াল (বিচার) নয়, এটি সমাজের কলঙ্কজনক অধ্যায়। এ ট্রায়ালের মাধ্যমে এমনকি ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডও ঘটেছে। কিছু মানুষ একত্র হয়ে এসব ঘটাচ্ছে।
জেডআই খান পান্না বলেন, রাজশাহীতে ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাকেও মব ট্রায়াল করে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। শুধু তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে কয়েকজন শিক্ষার্থীদের গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা গেছেন তোফাজ্জল নামে এক যুবক, যা মানবাধিকার লঙ্ঘন।
তিনি বলেন, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে মানুষ সেসব ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে প্রকাশ করতে শুরু করে। এর মধ্যেও আবার অনেক দুষ্কৃতকারী সুযোগ নিয়েছে, এখনো নিচ্ছে। তবে সে যাই হোক, আইনের বাইরে কোনো কিছু ঘটতে দেওয়া যাবে না। কারও অপরাধ থাকলে মব ট্রায়াল নয়, তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ যুগান্তরকে বলেন, মব ট্রায়াল বা গণপিটুনি দিয়ে যেসব মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, তা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। মানবাধিকার লঙ্ঘন। সংবিধান অনুযায়ী কোনো মানুষকে বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারেন একমাত্র আদালত। রাষ্ট্রের দায়িত্ব এসব হত্যাকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, মামলা দেওয়া। তিনি বলেন, গণপিটুনি নিয়ে উচ্চ আদালতের বেশকিছু নির্দেশনা রয়েছে।
২০১৯ সালের ২০ জুলাই উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফটকে ৪২ বছর বয়সি তাসলিমা বেগম রেণুকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি তার মেয়েকে ভর্তির খবর নিতে ওই বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। রেণুকে পিটিয়ে হত্যার সময় প্রত্যক্ষদর্শীদের ধারণ করা কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
এদিকে রেণুকে পিটিয়ে হত্যা মামলায় বুধবার এক আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়া চার আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন আট আসামি। ঢাকার ষষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ মোরশেদ আলম এ আদেশ দেন।
এছাড়া রেণুর বড় বোন নাজমুন নাহার নাজমা ও আরেক বড় বোনের ছেলে সৈয়দ নাসিরুদ্দিন টিটো ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। ওই বছরের ২৭ আগস্ট রেণুর পরিবারকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইশরাত হাসান।
জানতে চাইলে মঙ্গলবার ইশরাত হাসান যুগান্তরকে বলেন, রেণু হত্যায় আমি একটি রিট দায়ের করেছিলাম। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্র বা সরকার ব্যক্তির নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীনভাবে ব্যক্তির জীবনধারণের অধিকারকে খর্ব করেছে। এই গ্রাউন্ডে আমরা রিটটি করেছিলাম। আদালত শুনানি শেষে রুলসহ অন্তর্বর্তী আদেশ দিয়েছিলেন। পরে গণপিটুনি রোধে প্রতিটি জেলায় পুলিশ সুপারের নিচে হবে না, এমন পদমর্যাদার একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে পর্যবেক্ষক হিসাবে দায়িত্ব দিয়ে পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন আদালত।
তিনি বলেন, রেণুর পরিবারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণের একটি রিট দায়ের হয়েছিল। সেই রিটের শুনানি নিয়ে আদালত রুল জারি করেছিলেন। পরে ওই রুলের আর শুনানি হয়নি। ইশরাত হাসান আরও বলেন, গণপিটুনি দিয়ে মানুষ হত্যা করা ফৌজদারি অপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন। এসব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার হকদার।