Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে রেণু হত্যার রায়

একজনের মৃত্যুদণ্ড যাবজ্জীবন চার জনের

Icon

আদালত প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একজনের মৃত্যুদণ্ড যাবজ্জীবন চার জনের

রাজধানীর বাড্ডায় পাঁচ বছর আগে ছেলেধরা সন্দেহে তাসলিমা বেগম রেণুকে গণপিটুনিতে হত্যার মামল্লায় এক আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং চারজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হলেন ইব্রাহিম ওরফে হৃ দয় মোল্লা। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন রিয়া বেগম ময়না, আবুল কাল্লাম আজাদ ওরফে আজাদ মন্ডল, কামাল হোসেন ও আসাদুল ইসল্লাম। মামল্লায় খাল্লাস পেয়েছেন আটজন।

বুধবার দেওয়া রায়ের আদেশে আদালত বলেন, গণপিটুনির নামে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মানুষ হত্যার ল্লাইসেন্স দেওয়া হলে তা এ সমাজের যে কোনো মানুষের জন্য আতঙ্ক ও অনিরাপত্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গণপিটুনির অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হলে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, একজন মানুষ যখন পশু হয়ে যায়, তখন তার জীবন কেড়ে নেওয়াই শ্রেয়। ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত-৬-এর বিচারক মোহাম্মদ মোরশেদ আলম এ আদেশ দেন। দণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে ১ ল্লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও ১ বছরের কারাভোগ করতে হবে বলে রায়ে উলে­খ করা হয়। আসামিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত জরিমানার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে দিয়ে বাকি টাকা মামল্লার বাদী তথা নিহত স্বামী পরিত্যক্তা রেণুর পরিবারকে দেওয়ার আদেশ দেন আদালত।

এদিন বেল্লা ১১টা ১০ মিনিটে আদালত এ হত্যা মামল্লার রায় পড়া শুরু করেন। শুরুতে বিচারক বলেন, এটি একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামল্লা। টেলিভিশন, পত্রপত্রিকায় দেখেছি। ভাগ্যক্রমে আমিই রায় পড়ছি। এ মামল্লার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ভিডিও ফুটেজ। এটি না থাকলে রায়ের দিকে যাওয়াটা কঠিন হতো। চারটি ভিডিও ক্লিপ। আমি দেখাতে চাই। পরে আদালত ৫ মিনিট করে দুটি ভিডিও ক্লিপ দেখান। ভিডিও দেখে আদালতে কাঁদতে দেখা যায় রেণুর বোন নাজমুন নাহার নাজমাকে। এর মাঝে বিচারক বলেন, আবুল কাল্লাম কে? তখন হাত তোলেন আবুল কাল্লাম। বিচারক বলেন, দেখছেন আপনাকে। আবুল কাল্লাম বলেন, দেখা যায়নি। কামালকে উদ্দেশ করে বিচারক বলেন, আপনি দেখেন তো কী করছেন। কামাল বলেন, আমি সবাইকে বলেছি থাম। দয়া করে থাম। শোনো সে কী বলতে চায়। আমরা শুনতে চাই। কিন্তু কেউ শোনে না। এরপর বিচারক বলেন, তদন্তে কিছু দুর্বলতা আছে। ইব্রাহিমকে উদ্দেশ করে বিচারক বলেন, দেখবা তোমাকে চিনতে পার কি না। ভিডিও দেখা শেষ হলে বিচারক বলেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে সন্দেহ নেই।

রায় পড়ার সময় বিচারক আরও বলেন, কেস ডায়েরি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আসামিরা আইনকানুনের পরোয়া করেননি। আসামি ইব্রাহিম ওরফে হৃ দয় মোল্লা ল্লাঠি দিয়ে নিহতের দুই হাতে, কাঁধে, বুকে, ঊরু ও পা-সহ বিভিন্ন জায়গায় নির্দয় ও নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করেন এবং মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে আঘাত করতে থাকেন। রেণুকে হত্যা বীভৎস, নারকীয় ও নৃশংস ছিল। যেভাবে গণপিটুনি দিয়ে তাসলিমা বেগম রেণুকে হত্যা করা হয়েছে, তা মধ্যযুগীয় বর্বরতা এবং সমাজের প্রত্যেক মানুষের জন্য আতঙ্ক ছড়িয়েছে। আসামি ইব্রাহিম কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া নিষ্ঠুর ও বর্বরভাবে আঘাত করে একজন স্বামী পরিত্যক্তা মহিল্লাকে হত্যা করেছেন, দুই শিশুকে মাতৃহারা করেছেন এবং নিজের পশু মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ করেছেন। তার পূর্ব অপরাধ ও শাস্তির রেকর্ড নেই; কিন্তু নিহতকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করায় তাকে লঘু শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। অপরাধ সংঘটনের সময় তিনি যে নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, উন্মুত্ততা ও পৈশাচিকতা প্রদর্শন করেছেন, সেক্ষেত্রে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া সমীচীন হবে না। সংঘটিত আপরাধের মাধ্যমে তিনি নিজেকে সমাজে কলঙ্কিত করেছেন। একজন মানুষ যখন পশু হয়ে যান এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের কলঙ্কে পরিণত হয়ে যান, তখন তার জীবন কেড়ে নেওয়াই শ্রেয়।

এদিন কারাগার থেকে আসামি ইব্রাহিমকে আদালতে আনা হয়। অপর আসামিরা জামিনে ছিলেন। তারাও আদালতে হাজির হন। রায় ঘোষণা শেষে সাজা পরোয়ানা দিয়ে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। এ সময় আসামি ইব্রাহিম অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে কারাগারে যেতে চাচ্ছিলেন না। বোনকে উদ্দেশ করে বলতে থাকেন, আমার তো ফাঁসি হয়ে গেছে। আজই ফাঁসি দিব। তখন অন্য দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের স্বজনদেরও কান্নাকাটি করতে দেখা যায়।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় রেণুর ছেলে তা-সীন আল মাহির বলেন, এ রায় নিয়ে আমরা প্রতীক্ষায় ছিল্লাম। আমরা সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করেছিল্লাম। এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট না।

এ রায়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী ও বাদীপক্ষের আইনজীবী কেউই সন্তুষ্ট নন। বাদীপক্ষের আইনজীবী জাহিদুল ইসল্লাম বলেন, এ মামল্লায় আট আসামি খাল্লাস পাওয়া এবং একজনকে মাত্র মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে উচ্চ আদালতে যাব।

আসামিপক্ষের আইনজীবী মমিনুর রহমান মমিন বলেন, এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত। শিগ্গিরই আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব।

২০১৯ সালের ২০ জুল্লাই রাজধানীর বাড্ডার একটি স্কুলে সন্তানদের ভর্তির বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হন তাসলিমা বেগম রেণু। এ ঘটনায় অজ্ঞাত ৫০০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামল্লা করেন রেণুর ভাগিনা সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু। পরে ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আদালতে ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন মামল্লার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক আব্দুল হক। এছাড়া অপ্রাপ্তবয়স্ক দুজনের বিরুদ্ধে দোষীপত্র দাখিল করেন। এ দুই শিশুর মামল্লাটি ঢাকার নারী ও শিশু টাইব্যুনাল-৭-এ বিচারাধীন রয়েছে। ২০২১ সালের ১ এপ্রিল ১৩ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার ষষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ফাতেমা ইমরুজ কনিকা। মামল্লাটিতে আদালত চার্জশিটভুক্ত ২৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন।

দুই মাসে সারা দেশে গণপিটুনিতে ৪৯ জনের মৃত্যু : আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ৫ আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজনসহ সারা দেশে গণপিটুনিতে অন্তত ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও দেশে বিভিন্ন কারণে দুই মাসে সংঘবদ্ধ মানুষের অপমান, অপদস্থ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন প্রায় ১০০ জন। এর মধ্যে অনেক স্কুল-কলেজের প্রধান, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বিভিন্ন দপ্তরের প্রধান বা কর্মকর্তাদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। আদালত প্রাঙ্গণে আইনশৃঙ্খল্লা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তাবেষ্টনীর ভেতরেও হামল্লা করা হয়েছে গ্রেফতার অনেক ব্যক্তিকে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম