অঢেল সম্পদের মালিক
টাকা উড়িয়েই মহারাজ রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত
টাকা দিয়ে কিনতেন সবাইকে, এমপি হতে ব্যয় শতকোটি * ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে পালটেছেন দল * প্রতিপক্ষকে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানোর অভিযোগ আছে
আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল
প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজনীতির শুরু ছাত্রদলের হাত ধরে। তারপর জাতীয় পার্টি হয়ে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে পালটেছেন দল। শতকোটি টাকা ব্যয় করে হয়েছিলেন এমপি। রাজনীতিতে আসার পরপরই যেন পেয়েছিলেন আলাদিনের চেরাগ। চেরাগের দৈত্য তাকে এনে দেয় শত শত কোটি টাকা। সেই সঙ্গে হন বিপুল বিত্তের মালিক। কেবল নির্বাচনি হলফনামায়ই ৩০ কোটি ২৩ লাখ টাকার সম্পদ থাকার হিসাব দিয়েছেন মহারাজ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর-২ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে থাকা এই নেতার সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা (বিএফআইইউ)। আগস্ট বিপ্লবের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলাও হয়েছে তার বিরুদ্ধে। তবে সব ছাপিয়ে সামনে আসছে তার দুহাতে টাকা ওড়ানোর বিষয়টি। যে টাকা উড়িয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন রাজনীতির মাঠে।
যেভাবে উত্থান: পুরো নাম মহিউদ্দিন মহারাজ। বাবা শাহাদাৎ হোসেন ছিলেন আবাসিক হোটেলের ম্যানেজার। ছাত্রজীবনে ছিলেন ছাত্রদলের নেতা। ১৯৯১ সালে অংশ নেন পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে। ছাত্রদলের মনির-মান্নান-মহারাজ প্যানেলে হন সহসাধারণ সম্পাদক প্রার্থী। তথ্যটি জানিয়েছেন ওই প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আব্দুল মান্নান। যিনি এখন ভাণ্ডারিয়া পৌর বিএনপির আহ্বায়ক। রাজনীতিতে ওপরে ওঠার নেশায় মত্ত মহারাজ ভিড় জমান প্রভাবশালীদের কাছে। এক সময় নজরেও পড়ে যান অনেকের। তখনই হাতেখড়ি ঠিকাদারিসহ নানা ব্যবসায়। ’৯৬ সালে হন মঠবাড়িয়া উপজেলা শাখা বাস মালিক সমিতির সদস্য। মাঝারি আকারের বিত্তশালী হিসাবেও পরিচিতি তখন তার। প্রভাবশালীদের বলয়ে থাকায় আধিপত্য গড়েন ঠিকাদারি বাণিজ্যে। তখন পর্যন্ত অবশ্য রাজনীতিতে খুব একটা নজর ছিল না। ছুটছিলেন কেবল টাকার পেছনে। অপ্রতিরোধ্য এই ছোটায় ছেদ পড়ে ওয়ান-ইলেভেনে। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রোষানলে পড়েন মহারাজ। জান বাঁচাতে মহারাজ পালিয়ে যান মধ্যপ্রাচ্যে। ২০০৮-র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের জয়লাভের পর দেশে ফেরেন মহারাজ। এরপর সুকৌশলে বনে যান তৎকালীন সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফার ব্যক্তিগত সহকারী। ভাণ্ডারিয়ার মহারাজ কী করে সুদূর সিলেট-১৭ আসনের এমপি এনামুল হকের এপিএস হয়েছিলেন তা এখনো রহস্য পিরোজপুরের মানুষের কাছে। অর্থবিত্তে মহারাজের ফুলেফেঁপে ওঠার শুরুটাও এই এনামুল হক মোস্তফার আমলেই। ২-৩ বছর পর অবশ্য এনামুলের কাছ থেকে চলে আসেন মহারাজ। ততদিনে তার মুখস্থ হয়ে গেছে মন্ত্রণালয় বা সচিবালয়সহ টাকা আয়ের সব বৈধ-অবৈধ পথ। সেসব পথে শুরু হয় তার বিত্তশালী হওয়া।
রাজনীতির মাঠে আধিপত্য : বিপুল অর্থের মালিক হওয়ার পর রাজনীতিতে স্থায়ী আসন পেতে মাঠে নামেন মহারাজ। শুরুতে তার টার্গেট ছিল পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) নির্বাচনি এলাকা। সেখানেই শুরু করেন প্রচার-প্রচারণা। সেই সঙ্গে শুরু তার টাকার খেলা। রাজনীতির সঙ্গে টাকা মিশিয়ে নেন মঠবাড়িয়ার নিয়ন্ত্রণ। অবস্থান শক্ত করার মিশন অবশ্য আরও আগেই শুরু হয়েছিল তার। ২০০৩ সালে ভোটে নামিয়ে বাবা শাহাদাৎ হোসেনকে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বানান। ২০১৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একটানা চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে চেয়ারম্যান হন ছোট ভাই শামসুর রহমান। ২০২১-র নির্বাচনেও জয়ী হয় সে। এরই মধ্যে ২০১৪ সালে পিরোজপুর-১ আসনের তৎকালীন এমপিকে ম্যানেজ করে আওয়ামী লীগে যোগ দেন মহারাজ। আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন তিনি। ঢাকা ম্যানেজ করে হন কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক। সেই সঙ্গে পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও হন। স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র পর্যন্ত ম্যানেজ করে ভাগান পদ-পদবি। এই অভিযোগ পিরোজপুরের আওয়ামী লীগ নেতাদের। ছোট ভাই মিরাজুল ইসলামকেও মাঠে নামান মহারাজ। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভাণ্ডারিয়া উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান বানান তাকে। ২০১৯-র নির্বাচনে করেন উপজেলা চেয়ারম্যান। ২০১৬ সালের জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান মহারাজ। তবে তাকে না দিয়ে সাবেক এমপি অধ্যক্ষ শাহ আলমকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে গিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে জেলা চেয়ারম্যান হন মহারাজ। পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, ‘দলের সবাই মিলেও সেবার নির্বাচনে হেরে যায় মহারাজের কাছে। ভোট পেতে চেয়ারম্যান, মেম্বার, মেয়র আর উপজেলা চেয়ারম্যানদের চাহিদামতো সুবিধা দেন তিনি। একই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালেও জেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেন তিনি। স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি হিসাবে পিরোজপুরের ৭৪৭ জন ভোটারের মধ্যে ৭০৪ জন মহারাজকে দলীয় প্রার্থী চেয়ে চিঠি দেয় ঢাকায়। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছেও পাঠানো হয় ওই চিঠি। তবে সেবারও তাকে মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটের মাঠে নামা মহারাজকে অবশ্য পরে বসিয়ে দেয় কেন্দ্র। নৌকার মনোনয়নে জেলা চেয়ারম্যান হন সালমা রহমান হ্যাপী। নাজিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘ঠিক কতটা বিক্রি হলে ৭৪৭ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ৭০৪ জন মহারাজের পক্ষে রেজুলেশন দেয় তা কি আলাদা করে বলার দরকার আছে? নির্বাচন করতে না পারলেও শুধু সমর্থন নিশ্চিত করতে সেবারও টাকার বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন মহারাজ। তবে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে আর এগোতে পারেননি।’ এরপর থেকেই পিরোজপুর-২ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয় তার।
বিপুল সম্পদের উৎস নিয়ে প্রশ্ন-টাকা দিয়ে কিনতেন রাজনীতি : মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে মহারাজ কী করে শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক হলেন তা এখনো রহস্য পিরোজপুরের মানুষের কাছে। এই টাকার জোরেই পিরোজপুরের রাজনীতি আর প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। এই সুযোগে প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক নেতাদের হয়রানি আর মামলা দিয়ে জেলে পাঠানোর অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। ২০১৬ সালে জেলা পরিষদ নির্বাচনে হলফনামায় স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে ৪ কোটি ৭০ লাখ টাকার সম্পদ থাকার তথ্য দেন মহারাজ। তখন তিনি ও তার পরিবারের বার্ষিক আয় ছিল ১৭ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। মাত্র ৭ বছরের ব্যবধানে সংসদ নির্বাচনকালে তার দেওয়া হলফনামায় এই আয় বেড়ে যায় প্রায় ১৪ গুণ। সেবার নিজের এবং তার স্ত্রী ও পুত্র মিলিয়ে আয় দেখানো হয় ৩ কোটি ৮ লাখ ৩৫ হাজার ২৫৭ টাকা। সেই সঙ্গে সম্পদের বর্ণনাও ছিল চমকে ওঠার মতো। তিনি ও তার পরিবার মিলিয়ে মোট ৩০ কোটি ২৩ লাখ ৭৮ হাজার ৮০৫ টাকার সম্পদের মালিক বলে উল্লেখ করা হয় হলফনামায়। এর পাশাপাশি ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মহারাজের ১২ কোটি ৪ লাখ ৪৯ হাজার টাকার ঋণ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। দাখিল করা ওই হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নগদ অর্থ শেয়ার, স্থায়ী আমানত এবং আসবাবসহ আনুষঙ্গিক মিলিয়ে মোট ১৭ কোটি ৬ লাখ ৫৪ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদের মালিক এই পরিবার। এছাড়া তাদের মালিকানায় প্রায় ২শ ভরি স্বর্ণ থাকার কথা বলা হলেও পুরোটাই উপহার বলে উল্লেখ রয়েছে। বাড়ি, জমি, অ্যাপার্টমেন্ট ও দোকান মিলিয়ে এই পরিবারের রয়েছে আরও ১৩ কোটি ১৭ লাখ ২৪ হাজার ৮৬ টাকার সম্পদ। এসব সম্পদের মধ্যে কেবল কৃষিজমি আর বসতবাড়ি মিলিয়ে রয়েছে প্রায় ১৫ একর জমি। এছাড়া ঢাকার পান্থপথ, বসুন্ধরা ও নির্বাচনি এলাকার ৩ উপজেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দোকান, ভবন, মার্কেট, প্লট, ফ্ল্যাটসহ বিপুল স্থাপনা। বিপুল এই ভূসম্পত্তির মূল্যমান প্রশ্নে ক্রয়কালীন সময়ের দাম উল্লেখ করা হলেও বর্তমানে তার বাজার মূল্য শতকোটি টাকারও বেশি বলে জানা গেছে। পিরোজপুরের এক নেতা বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার নির্বাচনি হলফনামায় ৩০ কোটি টাকার সম্পদের হিসাব দেয় তার প্রকৃত সম্পদ যে এর চেয়ে অনেক গুণ বেশি তা কি আলাদা করে বলতে হবে? টাকার জোরে পিরোজপুরের সুস্থ রাজনৈতিক ধারা নষ্ট করেছেন মহারাজ। এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হওয়া দরকার বলেন ওই নেতা।’
মাত্র কয়েক বছরে মহারাজ ও তার পরিবারের এত বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প অনুমোদন এবং তার ঠিকাদারি কাজের নামে এসব সম্পদ বাগিয়েছেন। কাজ না করে শতকোটি টাকার বিল তুলে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। পিরোজপুর-২ নির্বাচনি এলাকার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, দরকার নেই এমন সব স্থানে নির্মিত হয়েছে সড়ক ব্রিজ-কালভার্টসহ নানা স্থাপনা। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) আওতায় হয়েছে এসব কাজ। কথিত আছে এলজিইডির একক নিয়ন্ত্রক ছিলেন মহারাজ ও তার ভাই মিরাজ। মন্ত্রণালয় কিংবা সচিবালয় নয়, প্রধান প্রকৌশলীসহ দপ্তরের অন্যদের ম্যানেজ করে এককভাবে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন দুই ভাই। এই এলজিইডিকে ব্যবহার করেই শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন এরা দুজন। এছাড়া গত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্যসচিব তোফাজ্জেল হোসেনকে ম্যানেজ করে চলত তাদের এসব বৈধ-অবৈধ কর্মকাণ্ড। এক্ষেত্রে তাকেও খুশি রাখতেন ৭ মাসের এমপি মহারাজ। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থ আয়ের বৈধ-অবৈধ সব ক্ষেত্রেই কোটি কোটি টাকা ছড়িয়ে স্বার্থ আদায় করতেন এই নেতা। এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য মোবাইল ফোন আর হোয়াটস্ অ্যাপসহ সব মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি সাবেক এমপি মহারাজকে। তবে সর্বশেষ পাওয়া তথ্যানুযায়ী তাদের বৈধ-অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছে দেশের রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক গোয়েন্দা সংস্থা। এছাড়া আগস্ট বিপ্লবের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখায় মহারাজের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকায় দায়ের হয়েছে হত্যার অভিযোগসহ দুটি মামলা।