শেরপুর নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহে বন্যা
পানি কিছুটা কমলেও বেড়েছে দুর্ভোগ
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শেরপুরে বন্যার চিত্র
বৃষ্টি বন্ধ হওয়ায় শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় বন্যার পানি কিছুটা কমলেও মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকে গবাদিপশু নিয়েও বিপাকে পড়েছেন। কেউ কেউ বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্র বা উঁচু স্থানে ঠাঁই নিয়েছেন। কিন্তু খাবারের অভাবে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে। সরকারি- বেসরকারি ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বন্যায় রাস্তাঘাট ডুবে থাকায় যাতায়াতেও মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। পানিতে ভেসে গেছে ফসলে মাঠ, সবজিখেত ও মাছের খামার। এতে অনেক খামারি ও কৃষক নিঃস্ব হয়েছেন। এদিকে রংপুরের রৌমারীতে ২০ গ্রামের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
শেরপুর ও নালিতাবাড়ী : ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদীতে বন্যার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। একই সঙ্গে উজান থেকে ঢলের পানি নামা অব্যাহত থাকায় নতুন করে শেরপুর সদর উপজেলার গাজীরখামার, ধলা, বাজিতখিলা ও পাকুরিয়া ইউনিয়ন, নকলার নকলা, উরফা, গণপদ্দী ও গৌরদ্বার ইউনিয়ন ও নকলা পৌরসভার আংশিক প্লাবিত হয়েছে।
নালিতাবাড়ীর গাগলজানি গ্রামের কৃষক অমিজ উদ্দিন বলেন, গরু-বাছুর নিয়া কষ্টে আছি। আন্দাবারী (রান্না) কইরা খাওন যায় না। কৃষক মোতালেব বলেন, ধানের খেত ডুইব্বা গেছে গা। বাড়িঘর ডুইব্বা যাওয়ায় অন্যের বাড়িতে থাকতাছি। অনেক কষ্টে আছি। উত্তর নাকশি গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, ধান লাগাইছিলাম এক কোমর উচা অইয়া গেছিল প্রায়। বন্যা আইয়া পানির তলে গেল গা। পানি ঘরে উট্টা পড়লে গরু-বাছুর নিয়া সড়কও আইয়া পড়ছি। গরু নিয়া সড়কই আছি। খাওয়া যা পাই তাই খাইয়া থাহি।
উত্তর নাকশি গ্রামের মাজেদা বলেন, ঘরের মধ্যে গলা পানি। কোনো কিছু বাঁচাবার পাই নাই। সব ডল আইয়া নিয়া গেছে গা। অহন রাস্তার পাশে একজনের খালি ঘরও আশ্রয় নিছি। খাওয়াদাওয়া নাই। শুকনা জিনিসই খাইতাছি। গাগলাজানি গ্রামের কৃষক আব্দুল মতিন বলেন, বন্যায় আমার যে ক্ষতি অইছে তা বলার বাইরে। মনে করুন একমন পেঁয়াজ লাগাই ছিলাম। দশ কাডা খেত বেগুন লাগাই ছিলাম। চাইড্ডা বেগুনের চারা করছিলাম উজানের খেতে লাগানোর জন্য। এইল্লা সব অহন এক বুক পানির নিচে। অহনা আমার মুখ দিয়া কতাই আইতাছে না, কী কমু। মৎস্যচাষি হাজি আব্দুল জব্বার বলেন, গাগলাজানি আর নাকশিতে ৫০ একর জমির পুকুর মাছ চাষ আছিল। ওই প্রজেক্টে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার মাছ আছিল মিনিমাম। এহন কিছু নাই। সব চইলা গেছে মাছ বন্যায়। আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছি। নালিতাবাড়ীর ঘোনাপাড়া গ্রামে নানার বাড়িতে বেড়াতে এসে জিমি আক্তার (৮) নামে এক শিশু বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে। সে শেরপুর সদরের চান্দেরনগর কড়ইতলা গ্রামের জামান মিয়ার মেয়ে। আগেরদিন রোববার নকলা উপজেলার গণপদ্দী ইউনিয়নের গজারিয়া গ্রামের মৃত তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক (৬০) মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা গেছেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা তার লাশ উদ্ধার করে। এ নিয়ে চার দিনে জেলায় বন্যার পানিতে ডুবে ৭ জনের মৃত্যু হলো।
জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, বৃষ্টি না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা পুরোদমে চলছে।
নেত্রকোনা : নেত্রকোনা সদর, দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, পূর্বধলা ও বারহাট্টা উপজেলার অন্তত ৩৫টি ইউনিয়নের ১২৫ গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে ৩৯টি পরিবার। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ২ শতাধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান। সোমবার বিকাল ৩টার দিকে কলমাকান্দা উব্দাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। স্থানীয় বাসিন্দা ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বন্যায় বেশি ক্ষতি হয়েছে দুর্গাপুরের কুল্লাগড়া, কাকৈইগড়া ও গাঁওকান্দিয়া; কলমাকান্দার লেঙ্গুরা, খারনৈ, কৈলাটি, পোগলা ও বড়খাপন; পূর্বধলার জারিয়া ধলামূলগাঁও; নেত্রকোনা সদরের কালিয়ারাগাবরাগাতি, মৌগাতি, মেদনি; বারহাট্টার বাউসী ও রায়পুর ইউনিয়নে। এসব ইউনিয়নের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পুকুরসহ আমন ফসল ডুবে গেছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোফাজ্জল হোসেন বলেন, বন্যার পানির কারণে ১৮৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নুরুজ্জামান বলেন, ৫টি উপজেলায় ১৮ হাজার ১০৪ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে।
হালুয়াঘাট ও ফুলপুর (ময়মনসিংহ) : কৈচাপুর, ধারা, ধুরাইল, স্বদেশি, নড়াইল, বিলডোরা, শাকুয়াই ও হালুয়াঘাট ইউনিয়নের কালিয়ানীকান্দাসহ বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় কষ্টে জীবনযাপন করছেন। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। বিভিন্ন পুকুর তলিয়ে ভেসে গেছে মাছ। গবাদি পশু নিয়েও বিপাকে পড়েছেন মানুষজন। এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের সংকট। ঘরের মধ্যে পানি প্রবেশের কারণে রান্নার কাজও ব্যাহত হচ্ছে, তাই অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে অনেকে। মানুষের এত দুর্ভোগেও নেই পর্যাপ্ত ত্রাণ তৎপরতা। বন্যাকবলিত মানুষরা সেখানে দ্রুত ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর জোর দাবি জানান। স্থানীয়রা বলছেন, চারদিক পানিতে থইথই করছে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার রাস্তাও পানির নিচে। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. এরশাদুল আহমেদ জানান, সরকারি সহায়তার পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করছে। এদিকে ফুলপুর উপজেলার ছনধরা, সিংহেশ্বর ও ফুলপুর ইউনিয়নের প্রায় সব গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া ফুলপুর পৌর সদর, রূপসী, বালিয়া, বওলা, ভাইটকান্দি ও রামভদ্রপুর ইউনিয়নের অনেক গ্রামে বন্যা হয়েছে। এসব এলাকার আমন ফসল, সবজি খেত ও মাছের ঘের পানিতে ভেসে গেছে।
রৌমারী (কুড়িগ্রাম) : রৌমারী সদর, যাদুরচর ও শৌলমারী ইউনিয়নের নওদাপাড়া, চান্দারচর, রতনপুর, বেহুলারচর, মোল্লারচর, খাটিয়ামারী, বোল্লাপাড়া, ব্যাপারীপাড়া, ভুন্দুরচর, ইজলামারী, পূর্ব ইজলামারী, বারবান্দা, উত্তর বারবান্দা, দক্ষিণ বারবান্দা চুলিয়ারচর, ঝাউবাড়ী, বড়াইবাড়ী, কলাবাড়ী, আগলারচর এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ২০টি গ্রামের ৫০ হাজার মানুষ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকে নৌকা বা ভেলা দিয়ে পারাপার হচ্ছে। পাশাপাশি তলিয়ে গেছে আমন ধান, বাদাম, মরিচ, মাষকালাই, খেসারি, কালাই, সবজির টাল ও বিভিন্ন শাকসবজির খেত।