Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

সাবেক আইনমন্ত্রীর দুই পিএ ‘টাকার মেশিন’

সাবরেজিস্ট্রার বদলির ৯০ ভাগই হতো বাবু ও সোহাগের হাত ধরে, নিতেন ৪০ লাখ থেকে দুই কোটি টাকা * ঢাকা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট ও বহুতল ভবন * সোহাগ-বাবুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল মন্ত্রণালয় ও এলাকার মানুষ

Icon

মো.ফজলে রাব্বি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাবেক আইনমন্ত্রীর দুই পিএ ‘টাকার মেশিন’

চাকরি ও বদলি বাণিজ্য, মাদকের সিন্ডিকেট পরিচালনা, পাহাড় কাটা, মামলা দিয়ে হয়রানি থেকে শুরু করে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করেননি আলাউদ্দিন বাবু ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ। এ দুজনই ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী ও কসবা-আখাউড়ার সাবেক সংসদ-সদস্য অ্যাডভোকেট আনিসুল হকের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ)। গত এক দশকে বানিয়েছেন ঢাকা ও এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট, বহুতল ভবন ও কোটি কোটি টাকা। একসময় এলাকাজুড়েই ফেসবুকে চলত সোহাগ-বাবুর বন্দনা। তবে বেশির ভাগ মানুষই ছিল তাদের অত্যাচারে বিক্ষুব্ধ, তবে নিশ্চুপ। ধারণা করা হচ্ছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তারা দুজনই বিদেশে পালিয়েছেন।

২০১৩ সালে কিছুটা ভালো থাকার নিশ্চয়তার জন্য বাবু পাড়ি জমান বাহরাইনে। এসএসসি পাশ করতেও একাধিকবার পরীক্ষার হলে বসতে হয়েছে বাবুকে। আনিসুল হক প্রথমবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ-সদস্য ও মন্ত্রী হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে দেশে ফিরে আসেন বাবু। মন্ত্রীর বাসার কাজের লোক হিসাবে তার যাত্রা শুরু হয়। মন্ত্রীর গুলশান অফিসে যাওয়া-আসা ছিল-এমন কয়েকজন জানান, ২০১৫-২০১৮ সালে মন্ত্রীর অফিসে চা পরিবেশন করতেন বাবু। ৫শ/হাজার টাকা পেলেই খুশি হতেন। একসময় বান্ডিল ছাড়া নিতেন না। মন্ত্রীর সাবেক এপিএস রাশেদুল কাওসার কসবা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার পর বাবু হয়ে উঠেন সবকিছুর হর্তাকর্তা। ২০১৮ সালে পিএ পদে নিয়োগ পাওয়ার পর বাবুর অন্যরূপ বেরিয়ে আসতে শুরু করে।

সাবেক এই আইনমন্ত্রীর চাচাতো ভাই শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, বাবু এবং সোহাগের অপকমের্র কথা বলে শেষ করা যাবে না। কী হতো না তাদের ইশারায়। তাদের অপকমের্র কারণে আজ আনিসুল হকের এই অবস্থা। তাদের অত্যাচারের ক্ষোভে মন্ত্রীর বাড়িটাও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে এলাকাবাসী। ১০ বছর বাবু-সোহাগের ভয়ে এলাকায় কথা বলতে পারেনি কেউ।

কর্কশ আচরণের কারণে মানসম্মান হারানোর ভয়ে মন্ত্রীর গুলশানের অফিসে যাওয়া ছেড়ে দেন অনেকেই। মন্ত্রীর পিএসসহ অন্য স্টাফরা বাবুর কাছে হয়ে পড়েন অসহায়। এদিকে পিএ হওয়ার পরই যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পান বাবু। থানার দারোগা-ওসি, সাবরেজিস্ট্রার, জেলা রেজিস্ট্রার বদলি বাণিজ্য, সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ার দোকান খুলে বসেন। সাবরেজিস্ট্রার বদলির জন্য সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। সাবরেজিস্ট্রার বদলির ৯০ ভাগই হতো বাবু আর সোহাগের মাধ্যমে। স্থানভেদে ৪০-৬০ লাখ-এমনকি দুই কোটি টাকা পর্যন্ত নেওয়া হতো সাবরেজিস্ট্রার বদলিতে। টাকা কম দিলে বেশি টাকা দেওয়ার লোক আছে বলে টাকার অঙ্ক বাড়ানো হতো। তেজগাঁও রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্স, খিলগাঁও, উত্তরা, বাড্ডা, পল্লবী, গুলশান, শ্যামপুর, মিরপুর, সাভার, রূপগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ-এসব স্থানে বদলির জন্য একেকজন সাবরেজিস্ট্রারকে ২ কোটি টাকার ওপরে দিতে হয়েছে। বিচারাঙ্গনের লোকজনও ভালো পোস্টিংয়ের জন্য ধরনা দিয়েছেন বাবু আর সোহাগের কাছে। তার জন্য গুলশান অফিসে এসি রুম এবং একটি জিপ বরাদ্দ ছিল।

হিমেল নামের একজন ভুক্তভোগী জানান, ফেসবুক পর্যন্ত মনিটরিং করতেন বাবু। কেউ যদি তার বিরুদ্ধে কিছু পোস্ট দিতেন, সেটারও কড়া বিচার করতেন তিনি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কসবার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের সীমান্তঘেঁষা কাজিয়াতলা গ্রামের ইদ্রিস মিয়ার ছেলে আলাউদ্দিন বাবু। তাদের আদিবাড়ি ত্রিপুরার মতিনগর থানার ধনছড়ি গ্রামে। বাবা ইদ্রিসের নানার বাড়ি কসবার পানিয়ারূপে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের গ্রামে। তার নানা-মামা ইদ্রিসকে অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের (আইনমন্ত্রীর প্রয়াত বাবা) বাড়িতে কাজের ছেলে হিসাবে নিযুক্ত করে দেন। ঢাকার গুলশান থানার শাহজাদপুর (বাঁশতলা) এলাকার খ-৪০/১-এ বাবুর ২টি বিশাল ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া কসবা পৌর এলাকার আড়াইবাড়ির কদমতলী এলাকায় রাস্তার পূর্বপাশে আজিজুর রহমান টুটুলের কাছ থেকে ৬ কাঠার একটি বাণিজ্যিক জায়গা কিনেন। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৫ কোটি টাকার ওপরে। ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গোপীনাথপুরের জগন্নাথপুর মৌজায় ৫৭৪নং দাগে ১০৮৮নং দলিলে বাবু তার শ্বশুর দলিল লেখক ফরিদ মিয়ার নামে ১৬ কানি সমতল পাহাড় কিনেন। ওই জমিতে রয়েছে মাল্টা বাগান। সেখানে যাওয়ার জন্য করা হয়েছে পাকা রাস্তা। যার বর্তমান বাজার মূল্য আড়াই কোটি টাকারও বেশি। কসবার আড়াইবাড়ি মাঠের পাশেই রয়েছে ১৮ শতক জায়গা। কসবা পৌরশহরের ইমামপাড়ায় রয়েছে ভগিনীপতি আমজাদ হোসেন মাস্টারের নামে বাবুর কেনা ৫ তলা একটি বাড়ি। এছাড়াও নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার আরও অনেক জমি রয়েছে এলাকায়।

আইনমন্ত্রীর পাশের বাড়ির মনোয়ারা বেগম (৫৫) জানান, নিয়োগ আর বদলিতে বস্তা বস্তা টাকা কামিয়েছেন তিনি। আমার মেয়ে তাহমিনা আক্তার লিজার একটি চাকরির জন্য মন্ত্রীর কাছে ১০ বছর ঘুরেছি। বাবুর বাবা ইদ্রিসকে একটি জায়গা না লিখে দেওয়ায় সেই চাকরি আর হয়নি।

এদিকে পানিয়ারূপ গ্রামের কৃষক মৃত হাছু মিয়ার ছেলে শফিকুল ইসলাম সোহাগ। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট সোহাগ। একসময় কসবার কায়েমপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।

আনিসুল হকের গ্রামের বাড়ির কয়েক শ গজ সামনেই সোহাগের বাড়ি। সোহাগের বড় ভাই মতিন কাজ করতেন আইনমন্ত্রীর মামা সাংবাদিক আতাউস সামাদের বাসায়। সোহাগও প্রায় ২০ বছর আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ছোট ভাই আরিফুল হক রনির বাসার কাজের লোক ছিলেন। আরিফুল হক রনি মারা যাওয়ার পর সোহাগ চলে আসেন মন্ত্রীর বাড়িতে। মন্ত্রীর ঢাকার বনানী বাসার কাজকর্ম ও মন্ত্রীর মাকে দেখাশোনা করতেন সোহাগ। কাজের লোক থেকে হয়ে যান মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী। ব্যক্তিগত সহকারী হয়ে আর পেছন তাকাতে হয়নি সোহাগকে। চাকরি, থানার ওসি ও সাবরেজিস্ট্রার বদলি, বিচারাঙ্গনে ভালো পোস্টিং, এলাকায় মাদকের সিন্ডিকেট পরিচালনা করে কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। ঢাকার গুলশান থানার শাহজাদপুর (বাঁশতলা) এলাকার খ-৪০/১-এ সোহাগের ৪টি বিশাল ফ্ল্যাট রয়েছে। কসবা পৌরশহরে কিনেছেন দুটি ফ্ল্যাট। গ্রামের বাড়ি পানিয়ারূপে করেছেন কয়েক কোটি টাকার ডুপ্লেক্স বাড়ি। তবে সোহাগ তার বেশির ভাগ সম্পত্তি ক্রয় করেছেন তার বড় ভাই মতিনের নামে। মতিন তার বউ ও শাশুড়ির নামে কসবা পৌর শহরের ইমামপাড়ায় কিনেছেন ১৫ শতক জায়গা। মতিন কসবার লক্ষ্মীপুর, পানিয়ারূপ, বিলগর, মাইকার ও মুরাদনগরের ডালপাড়ে কয়েকশ কানি জমি কিনেছেন। এছাড়াও ঢাকার আফতাবনগর ও বনশ্রীতে সোহাগ ও মতিনের নামে শত শত কোটি টাকার জায়গা-সম্পদ রয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানায়।

পানিয়ারূপ গ্রামের আজমল হোসেন জানান, বাবু ও তার বাবা ইদ্রিস চাকরির জন্য এলাকার অনেক মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। তারা মাদকের সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন এলাকাকে। পাহাড় কেটে শেষ করেছেন। বাবু ও সোহাগের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাননি কেউ। মন্ত্রীর পৈতৃক ঘরেই থাকতেন বাবুর বাবা ইদ্রিস। তাদের আলাদা কোনো বাড়ি ছিল না।

পানিয়ারূপ গ্রামের জহিরুল ইসলাম বলেন, ভয়ভীতি দেখিয়ে বাবুর বাবা ইদ্রিস আমার জমি দখলে নেন। ক্ষমতার অপব্যবহারে কেউ তাদের অত্যাচার থেকে রেহায় পাননি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম