১৪৮২ কোটি টাকার সার গায়েব
১৪৮২ কোটি টাকার সার গায়েব, উদ্ধার হয়নি ৩ বছরেও
গায়েব হওয়া আড়াই লাখ টন সার উদ্ধারে তিন বছরেও অগ্রগতি নেই। সরকারি দুই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) এবং বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) থেকে ২০২১ সালে এই সার গায়েব করে পোটন ট্রেডার্স। এর মধ্যে বিএডিসির ১ লাখ ৭৯ হাজার টন এবং বিসিআইসির ৭২ হাজার টন। এই পরিমাণ সারের মূল্য ১ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির মালিক নরসিংদী-২ আসনের সাবেক এমপি আওয়ামী লীগ নেতা কামরুল আশরাফ খান পোটন।
সার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনেরও সভাপতি তিনি। গত ২৭ বছর পর্যন্ত সার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন পোটন। বিষয়টি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার পর বর্তমানে তিনি কারাগারে। আর দুদক বলছে, শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
জানতে চাইলে এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মো. রফিকুজ্জামান সোমবার যুগান্তরকে বলেন, বিএডিসি এবং বিসিআইসি দুটি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। আশা করছি দ্রুতই প্রতিবেদন দেওয়া যাবে। তিনি বলেন, কয়েকজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আরও কয়েকজন বাকি আছে। এছাড়া কিছু ডকুমেন্ট যাচাই দরকার। এরপর প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত পোটন ট্রেডার্সের সার কেলেঙ্কারি নিয়ে গত বছরের ৩ জানুয়ারি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুগান্তর। এরপর আরও দু-একটি গণমাধ্যম এই রিপোর্টের ফলোআপ করে। এই ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে ৫ জানুয়ারি স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন উচ্চ আদালত। কেন পোটন ট্রেডারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না-দুদককে তা ব্যাখ্যা করতে বলা হয়।
পরবর্তী সময়ে নড়েচড়ে বসে দুদক। প্রাথমিক তদন্তের পর গত বছরের ২৬ নভেম্বর ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে সংস্থাটি। মামলায় কামরুল আশরাফ খান পোটন ছাড়াও অপর চার আসামি হলেন-পোটন ট্রেডার্সের মহাব্যবস্থাপক মো. শাহাদাত হোসেন ও মো. নাজমুল আলম, প্রতিষ্ঠানটির উত্তরবঙ্গ প্রতিনিধি মো. সোহরাব হোসেন এবং খুলনা প্রতিনিধি মো. আতাউর রহমান। এই মামলায় চলতি বছরের ১৫ মে ৫ জনকে কারাগারে পাঠায় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত।
তবে কারাগারে যাওয়ার আগেই রিপোর্ট বন্ধ করতে পোটন আদালতের আশ্রয় নেন। পোটনের ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে কোনো রিপোর্ট প্রকাশ না করতে ওই বছরের ২৫ জুলাই যুগান্তরকে ৬ মাসের নিষেধাজ্ঞা দেয় বিচারপতি বিশ্বদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি মো. আলী রেজার দ্বৈত বেঞ্চ।
জানতে চাইলে বিএডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আসাদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ঘটনাটি তিন বছর আগের। তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তবে সার গায়েবের ঘটনাটি তিনি অবগত আছেন বলে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, এ ঘটনাটি দুদক তদন্ত করে পোটনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে। কামরুল আশরাফ খান পোটন এখন কারাগারে। বিষয়টি মামলার মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়ায় চলে গেছে। এখন আদালত যে সিদ্ধান্ত দেন, সেই অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, বর্তমানে দেশে চার ধরনের সার বাংলাদেশে বেশি ব্যবহার হয়। এগুলো হলো-ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি এবং এমওপি (পটাশ)। এর মধ্যে ইউরিয়া সার আমদানি করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিসিআইসি। বাকি সার আমদানি করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিএডিসি। বর্তমানে দেশে মোট সারের চাহিদা ছিল ৫৯ লাখ টন। এর মধ্যে ইউরিয়া ২৭ লাখ টন, টিএসপি ৭ দশমিক ৫০ লাখ, ডিএপি ১৫ লাখ এবং এমওপি ৯ দশমিক ৫০ লাখ টন। এর বড় অংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। যার বেশির ভাগই পোটন সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে।
২০২১ সালের নভেম্বরে বিদেশ থেকে নন-ইউরিয়া (টিএসপি, ডিএপি, এমওপি) ১ লাখ ৭৯ হাজার মে. টন সার আমদানি করে বিএডিসি। এই সার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পরিবহণ ঠিকাদার পোটন ট্রেডার্সের দেশের বিভিন্ন সার গুদামে পৌঁছে দেওয়ার কথা। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসব সার দেশে আসে। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে সে সময় পোটন ট্রেডার্স সার বুঝে নেয়। কিন্তু পরবর্তী তিন বছরেও ১ লাখ ৭৯ হাজার টন সার বিএডিসিকে এখন পর্যন্ত বুঝিয়ে দেননি। এই সারের কোনো হদিস নেই।
কোথায় আছে বিএডিসির কর্মকর্তারা তা জানেন না। সার মূলত গায়েব হয়ে গেছে। তবে সূত্র বলছে, বিশাল এই দুর্নীতির সঙ্গে বিএডিসির কিছু অসৎ কর্মকর্তা জড়িত। ঘটনার সময় অর্থাৎ ২০২১ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার জোরে কামরুল আশরাফ খান পোটন অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। ফলে তার বিরুদ্ধে বিএডিসির বা বিসিআইসির কোনো কর্মকর্তা মুখ খুলতে সাহস করতেন না।
অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ইউরিয়া সার আমদানির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি দেশের সঙ্গে চুক্তি করে (জিটুজি) সরকার। চুক্তি অনুসারে সার সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো হলো-সৌদি আরবের সাবিক, কাতারের মুনতাজাত এবং সংযুক্ত আবর আমিরাতের ফার্টিগ্রোব। এই সার পরিবহণের জন্য ড্রাই বাল্ক শিপিং প্রাইভেট লিমিটেডের স্থানীয় প্রতিনিধি পোটন ট্রেডার্সের সঙ্গে ১৩টি চুক্তি করে সরকার। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে আমদানির পর জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করে সরকারি গুদামে পৌঁছে দেওয়ার কথা। মোট আমদানিকৃত সারের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৯৩ হাজার ২৪৪ টন। আর পুরোটাই বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে বুঝে নিয়ে পরিবহণ করে বাংলাদেশে আনে। কিন্তু গুদামে সরবরাহ করে ৩ লাখ ২১ হাজার ৩২৮ টন। অর্থাৎ বিদেশ থেকে নিয়ে এলেও ৭১ হাজার ৯১৬ টন সার তারা গুদামে দেয়নি পোটন ট্রেডার্স। এসব সরকারি বেসরকারিভাবে বিক্রি করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এই সারের ক্রয় মূল্য ৫৫৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
এর সঙ্গে অন্যান্য খরচ ২৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে সরকারের ক্ষতির পরিমাণ ৫৮২ কোটি টাকা। তবে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় মূল্য এর চেয়ে আরও অনেক বেশি। এরপর সার সরবরাহের কয়েক দফা চিঠি দেওয়া হলেও একেবারে গুরুত্ব দেয়নি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি। বারবার ওয়াদা দিয়েও সার পৌঁছাতে ব্যর্থ হয় তারা। এর মধ্যে বাজারে সারের কিছুটা সংকট দেখা দেয়। ডিলাররাও এর সুযোগ নিয়ে দাম বাড়িয়েছে।
এরপর ২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর শিল্প মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানানো হয়। পাশাপাশি ঘটনার রহস্য উদঘাটনের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিসিআইসি। ওই বছরের ৮ ডিসেম্বর এ ব্যাপারে প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। সেখানে পোটন ট্রেডার্সকে দায়ী করা হয়।
সবমিলিয়ে বিসিআইসির ৭২ হাজার টন ইউরিয়া ও বিএডিসির ১ লাখ ৭৯ হাজার টন নন-ইউরিয়া সার তার কাছে পাওনা। দুই প্রতিষ্ঠানের পাওনা সারের দাম ১ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা। এই মূল্য সরকার ভর্তুকি দেওয়ার। আমদানিকৃত দাম আরও বেশি। কারণ সার কেনায় প্রতিবছর সরকার বিশাল অঙ্কের টাকা ভর্তুকি দেয়।
২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নরসিংদী-২ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন পোটন। এ সময়ে শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্য, আত্মীয় এবং আওয়ামী লীগের কয়েকজন বড় নেতাকে ম্যানেজ করে সার কেলেঙ্কারির ঘটনা চাপা দিয়েছেন। ফলে সার গায়েব হলেও তাকে প্রশ্ন করার সাহস কারও ছিল না। বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান পদে তিনি কয়েকবার দায়িত্বে থেকে ক্ষমতার দাপটে ছিলেন।
এ পদটি তিনি ক্ষমতা দেখিয়ে বারবার টিকিয়ে রেখেছেন। গত ২৭ বছর পর্যন্ত সার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন পোটন। এই ঘটনা বেশ কয়েকবার তদন্ত হয়েছে। কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই। সার বুঝিয়ে দিতে বিএডিসি ও বিসিআইসি তাকে কয়েকবার চিঠি দিয়েছে। কিন্তু নানা অজুহাতে সময় পার করেছেন তিনি। কামরুল আশরাফ খান পোটন বর্তমানে বিসিআইসির মামলায় কারাগারে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তার ম্যানেজার হারুনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।