পরিস্থিতি দেখতে পাহাড়ে চার উপদেষ্টা
থমথমে তিন পার্বত্য জেলা, বন্ধ যানবাহন চলাচল
সহিংসতায় জড়িত কাউকে ছাড় নয়, শিগগিরই উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি-স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা * সম্প্রীতি নষ্টে বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে-স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: যুগান্তর
তিন পার্বত্য জেলায় সহিংসতা, উত্তেজনা ও নিহতের ঘটনায় শনিবারও থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করে। ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র-জনতার’ ডাকে এদিন সকাল থেকে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে ৭২ ঘণ্টার সড়ক ও নৌপথ অবরোধ শুরু হয়। এছাড়া গাড়িতে আগুন দেওয়ার প্রতিবাদে রাঙামাটিতে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন পরিবহণ শ্রমিকরা। এর প্রভাব বান্দরবানে তেমন না পড়লেও বাকি দুই জেলার জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। সতর্ক অবস্থায় রয়েছে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ। বিশেষ করে সংঘাতপ্রবণ এলাকাতে টহল জোরদার করা হয়েছে।
এদিকে পাহাড়ের পরিস্থিতি দেখতে শনিবার খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি যান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ চার উপদেষ্টা। এ সময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, পাহাড়ে সহিংসতায় জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। ভবিষ্যতে আইনশৃঙ্খলার অবনতির চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি জানান, সহিংসতা তদন্তে শিগগিরই একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হবে। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ বলেছেন, পাহাড়ে সম্প্রীতি নষ্টের জন্য বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, পাহাড়ি-বাঙালি বিভক্তি তৈরি করে অনেক পক্ষ সুবিধা নিতে চায়। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, উসকানি ও গুজবের ফাঁদে পা দিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চেতনা যেন ম্লান না হয়।
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে বৃহস্পতি ও শুক্রবার পাহাড়ি ও বাঙালিদের দফায় দফায় সংঘর্ষে চারজন নিহত ও অর্ধশত আহত হয়েছেন। এ সময় শতাধিক দোকানপাট, বাড়িঘর ও গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
খাগড়াছড়ি : জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে শনিবার বিকালে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে আয়োজিত বিশেষ আইনশৃঙ্খলা সভায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ঘটে যাওয়া সহিংসতা তদন্তে শিগগিরই একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হবে। যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে, যা আগামীর জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়ে আঘাত করা হলে তা কোনোভাবে ছাড় দেওয়া হবে না। এর জন্য সর্বোচ্চ কঠোর হওয়ার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেন তিনি। সহিংসতায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা এবং যারা আহত হয়েছেন তাদের উন্নত চিকিৎসার প্রতিশ্রুতিও দেন এই উপদেষ্টা।
সভায় স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ বলেন, একটি তুচ্ছ ঘটনাকে পরিকল্পিতভাবে বড় সহিংতায় রূপান্তর করা হয়েছে। কেউ চুরি করলে তাকে বিচারবহির্ভূতভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলাও অনেক বড় অপরাধ। তবে যাই ঘটুক না কেন, পাহাড়ে সব সম্প্রদায় যেন একসঙ্গে একই ছাতার নিচে থাকতে পারে সেই বিষয়ে পাহাড়ি-বাঙালি সবাইকে সহনশীল হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, উসকানি ও গুজবের ফাঁদে পা দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চেতনা যেন ম্লান না হয়। এজন্য পাহাড়ি-বাঙালি সবাইকে ভ্রাতৃত্বসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
এদিকে শনিবার সন্ধ্যায় দীঘিনালায় আসেন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তিনি লারমা স্কয়ারে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করেন। এ সময় তিনি বলেন, এখানে পাহাড়ি ও বাঙালির মধ্যে বিভেদ, বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব তৈরি করে অনেক পক্ষ সুবিধা নিতে চায়। আমরা তাদের সুযোগ করে দেব না। আমরা বলব পাহাড় ও সমতল সব মিলে বাংলাদেশ। ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করব। তিনি বলেন, এই ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। যারা দোকানপাট পুড়িয়ে দিয়েছে, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তাদের আমরা বিচারের আওতায় আনব। আমরা বারবার করে বলছি আইন কেউ নিজের হাতে নেবেন না।
সকালে খাগড়াছড়ি সাজেক সড়ক, পানছড়ি ও রামগড় সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করা হয়। অবরোধ কর্মসূচির প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়েছে ইউপিডিএফ। অবরোধের কারণে খাগড়াছড়ির সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙাসহ আন্তঃউপজেলাগুলোতেও সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকে। খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল বলেন, অবরোধে জনজীবন স্বাভাবিক রয়েছে। নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। জেলা সদর ও উপজেলাগুলোতে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে।
রাঙামাটি : এক মতবিনিময় সভায় স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ বলেছেন, আমাদের সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমরা একটা বার্তা দিতে চাই। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে থাকব। এ বিষয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। আমরা সবাই শান্তি চাই।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, রাঙামাটিতে কোনো অবস্থাতেই আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটতে দেওয়া হবে না। এ ধরনের কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারবে না। যারা এখানে আইনশৃঙ্খলার অবনতির চেষ্টা করবে তাদের হাত ভেঙে দেওয়া হবে। তাদেরকে কোনোভাবেই ছাড় দেব না। সম্প্রীতি রক্ষায় সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।
দুপুর ১টার দিকে রাঙামাটি সেনা রিজিয়নের প্রান্তিক মিলনায়তনে দুই ঘণ্টাব্যাপী এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আব্দুল হাফিজ, আইজিপি ময়নুল ইসলাম, মেজর জেনারেল ফয়জুর রহমান (ডিজি, ডিজিএফআই), মেজর জেনারেল আবু মোহাম্মদ সরোয়ার ফরিদ (ডিজি, এনএসআই), মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকীসহ (ডিজি, বিজিবি) সামরিক, প্রশাসনিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। জেলা প্রশাসক মো. মোশারফ হোসেন সভা সঞ্চালনা করেন।
এদিকে রাঙামাটিতে এখনো জনমনে ভয়ভীতি বিরাজ করছে। শহরে ১৪৪ ধারা বলবৎ রয়েছে। সড়ক পরিবহণ মালিকদের ডাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে প্রায় সব ধরনের দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি জুম্ম ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সমর্থনে ৭২ ঘণ্টার অবরোধ চলছে।
বান্দরবান : পার্বত্য চট্টগ্রামে তিন জেলায় ৭২ ঘণ্টা সড়ক ও নৌপথ অবরোধের ডাক দিলেও বান্দরবান জেলায় অবরোধের তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। শনিবার সকাল থেকে বান্দরবান থেকে ছেড়ে গেছে চট্টগ্রাম-ঢাকা ও কক্সবাজারের উদ্দেশে গণপরিবহণ। জেলা শহরসহ অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতেও যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। জেলা সদরের কোথাও কোনো ধরনের কাউকে পিকেটিং করতে দেখা যায়নি। নিত্যদিনের মতো সব ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা ছিল, জনগণের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক চলছে।