সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম
জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় বিএনপির ৪২২ জন নিহত
নির্বাচনসংক্রান্ত সংস্কার শেষে ভোট দিতে ২ মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয় * ফ্যাসিবাদের দোসরদের ইঙ্গিতে শিল্পাঞ্চলগুলোতে চলমান অস্থিরতা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় বিএনপির ৪২২ জন নিহত
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় বিএনপির ৪২২ জন নিহত হয়েছেন। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসাবে, গণআকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে গণঅভ্যুত্থানে সর্বশক্তি দিয়ে রাজপথে নেমে আসে বিএনপি এবং এর সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল নয়, বিএনপির উদ্দেশ্য ছিল সর্বস্তরের নেতাকর্মী-সমর্থকদের অংশগ্রহণে, গণঅভ্যুত্থানে সাংগঠনিকভাবে সর্বোচ্চ ভূমিকা রেখে, ফ্যাসিবাদের পতনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। আর তাই, বিএনপির যে ৬০ লাখ সদস্যের নামে ফ্যাসিবাদের সময় মিথ্যা মামলা হয়েছে, তার সুবিশাল অংশ সাধারণ মানুষের পাশে থেকে, রাষ্ট্রযন্ত্রের ষড়যন্ত্র ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে রুখে দাঁড়ান। ফলে যার-যার অবস্থান থেকে জনগণের কাতারে নেমে আসে বিএনপি ও সমমনা সব রাজনৈতিক দল, তথা গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিগুলো। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার সংস্কারে হাত দিয়েছে। আমরা মনে করি নির্বাচনসংক্রান্ত সংস্কার শেষে ভোট দিতে ২ মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়।
রোববার দুপুরে বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন। আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষ্যে ‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পথযাত্রায় বিএনপির ভূমিকা, অবদান এবং প্রত্যাশা’র বিষয়গুলো তুলে ধরতে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় সারা দেশে ৮৭৫ জন শহিদ হন। এর মধ্যে কমপক্ষে ৪২২ জন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দেশজুড়ে শহিদ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা-রাজনীতির মানুষের মধ্যে একটা বড় অংশ যে বিএনপির নেতাকর্মী, তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং তা তাদের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের অনিবার্য ফল। পোশাক শ্রমিক কিংবা রিকশচালক, পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বাম কিংবা ডান আদর্শের অনুসারী, সব মত ও পথের রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক ব্যক্তি হতাহতের পরিচয় যাই হোক না কেনা, প্রতিটি প্রাণের মূল্য ও রক্তের মর্যাদা সমান।
মির্জা ফখরুল বলেন, জুলাই-আগস্টে পুরো বাংলাদেশের একদফা দাবি আর বিএনপির ত্যাগের পটভূমি সৃষ্টি হয়েছে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। উত্তাল রাজপথে পুরোটা সময় গুম-খুন, হামলা-মামলা, দমন-দুর্বৃত্তায়নের শিকার হয়েও, জনগণের প্রতিবাদের প্রতিনিধি হিসাবে রক্তøাত সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে বিএনপি। তৃণমূলের স্পন্দন ও গণমানুষের নেতা তারেক রহমানের নেতৃত্বে, অবিরাম জুলুম-অবিচারের মাঝেও, বিএনপির নেতাকর্মীরা মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য অবিচল সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবদানে গড়ে ওঠা দীর্ঘদিনের ঐক্যকে ধারণ করে, গণতন্ত্রের পক্ষের সব শক্তির বলিষ্ঠ ভূমিকায়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে। জনগণের এ বিজয় শুধুই দেশের মালিকানা ফিরে পাওয়ার বিষয় নয়। বরং এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার প্রতিশ্রুতি, যা অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত।
তিনি বলেন, এ বিজয়ের পেছনে রয়েছে অসংখ্য নির্যাতিত মানুষের বেদনার অপ্রকাশিত ইতিহাস। গুম হওয়া ছেলের ফেরার প্রতীক্ষায় ব্যথাতুর মায়ের ডাক। স্বামী হারানো বেদনাবিধুর স্ত্রীর অনন্ত আর্তনাদ। পঙ্গু বাবার জন্য সন্তানের হৃদয়বিদারক হাহাকার। আর কারাগারে বন্দি ভাইয়ের জন্য বোনের নীরব প্রার্থনা। তাদের সবার ১৬ বছরের রক্ত, শ্রম ও অশ্রু দিয়ে, প্রতিটি পরিবারের ক্ষোভ, ক্রোধ ও অব্যক্ত বিস্ফোরণ বুকে ধারণ করে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চলমান ছিল ।
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে বিএনপির ৪২২ জন শহিদ হন। এর আগে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপির ১৫৫১ জন শহিদ হন। গুম হন ৪২৩ জন। আর সব রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ মিলিয়ে এই সময়ে গুমের সংখ্যা প্রায় ৭০০। বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেড় লাখ মামলা হয়। আসামি ৬০ লাখ। এসব শুধু বিএনপির ত্যাগের পরিসংখ্যানই নয়, বরং বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পথে দলটির অবিচল সংগ্রাম ও অবদানের প্রতিফলন।
দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে চলমান অস্থিরতা ফ্যাসিবাদের দোসরদের ইঙ্গিতে হচ্ছে মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে একটা চক্রান্ত চলছে। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সীমান্তের ওপার থেকে কথিত ফ্যাসিবাদী হাসিনার অডিও ফাঁস করে দেওয়া হয়, যেগুলোতে বিভ্রান্তিকর খবর থাকে। অন্যদিকে আবার প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হচ্ছে। যেটা একেবারে বাকাওয়াজ। এটা আমরা শুধু নয়, ভারত থেকে যেসব সাংবাদিক এসেছিলেন, তারা পর্যন্ত দেখে রিপোর্ট করেছেন, যেটা বলা হচ্ছে সেটা সঠিক নয়। যেটা হয়েছে তা, রাজনৈতিক কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেটা হতেই পারে। সুতরাং চক্রান্তটা ওই জায়গায়। আমরা চক্রান্ত পছন্দও করি না।
সংস্কার শেষে নির্বাচন দিতে ২ মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয় : মির্জা ফখরুল বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন কাজ করতে পারে, তাদের কাজ করতে দিন। সংস্কার কাজে তারা হাত দিয়েছেন। এই কাজগুলো অতি দ্রুত শেষ করে একটা নির্বাচনের দিকে যাওয়া। যে নির্বাচনটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হবে এবং জনগণ অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনে ভোটে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবে। তারপরই বাকি কাজগুলো তারা সম্পন্ন করবে। আমরা পরিষ্কার করে বলেছি, নির্বাচনকেন্দ্রিক যে সংস্কারগুলো, অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যেমন, আমাদের অনেককেই শাস্তি দিয়ে দিয়েছে। আমাদের শাস্তি দেওয়ায় ২ বছর তো নির্বাচন করতে পারব না। সেটার সংস্কার প্রয়োজন। আর অন্যান্য সংস্কার যেগুলো আছে তা সরকার জনগণের ভোটে আসবে তারা করবেন। আমি মনে করি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত নির্বাচন। এসংক্রান্ত সংস্কার শেষে নির্বাচন দিতে ২ মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো রাষ্ট্র মেরামতে প্রণীত ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের কথাও বলেন বিএনপি মহাসচিব।
মির্জা ফখরুল বলেন, প্রশাসন এখনও ফ্যাসিবাদ মুক্ত হতে পারেনি বলেও মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল। নিজের মধ্যকার সম্মিলিত ঐক্যের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আমরা ফ্যাসিবাদকে সরিয়েছি, হাসিনাকে সরিয়েছি। এখন একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আছে, যে সরকার অতি দ্রুত সবার মতামত নিয়ে একটি সংস্কারের মধ্য দিয়ে নির্বাচনে যাবে। যে নির্বাচনটা অবাধ নিরপেক্ষ হবে, জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। সেখানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। একটু খোলামেলা বলছি, অনেক সময় দেখা যায় অত্যন্ত দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলেরা নেতারা এমন এমন কথা বলেছেন যেটা সামগ্রিক ঐক্যের জন্য উপযোগী নয়। এটা একটা সমস্যা। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন-বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ।