ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফারহান ফাইয়াজ হত্যা
হাসিনাসহ ৫৪ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি গণহত্যার অভিযোগ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে কলেজছাত্র ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া ওরফে ফারহান ফাইয়াজকে হত্যার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৫৪ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দায়ের হয়েছে। নিহত ওই ছাত্রের বাবা শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন কার্যালয়ে মঙ্গলবার আবেদনটি করেন। এ সময় ফারহানের মা ও বোন উপস্থিত ছিলেন। ফারহান ফাইয়াজ ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের এইচএসসি ২৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিল। এ নিয়ে ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি অভিযোগ দায়ের হলো।
এ উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার দুপুরে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেন। তিনি বলেন, আজকে প্রথম একটা ভিকটিম ফ্যামিলি আমাদের (প্রসিকিউশন) কাছে তাদের অভিযোগ নিয়ে এসেছেন। সেই ঘটনা বাংলাদেশর অধিকাংশ মানুষকে কাঁদিয়েছিল। ১৮ জুলাই ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডে কোটাবিরোধী আন্দোলন যখন চলছিল তখন রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া ওরফে ফারহান ফাইয়াজকে পুলিশ সরাসরি গুলি করে হত্যা করে। গুলিটি ফারহান ফাইয়াজের বুকে লাগার পর সে মাটিতে পড়ে যায়। এ সময় সহপাঠী বন্ধু যারা ছিলেন, তারা তাৎক্ষণিক ফারহান ফাইয়াজকে সিটি হাসপাতালে নিয়ে যান। ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়েছিল বলে ডাক্তার জানান।
তাজুল ইসলাম বলেন, সে (ফারহান ফাইয়াজ) একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিল। তার মিষ্টি হাসির ছবি গোটা জাতি মিডিয়ার কল্যাণে দেখেছেন। প্রসিকিউশন অভিযোগটি তদন্ত করবে। এটা বুঝা যাচ্ছে, সরকারের নির্দেশে মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে পুলিশ বাহিনী, তাদের সহযোগী বাহিনী হিসাবে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা এই ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। কমন অভিযোগ, কমন আসামি, তাদের নির্দেশেই এটা হয়েছে। চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, আজ থেকে প্রসিকিউশনে একটি ডেক্স চালু হয়েছে। কোনো ভিকটিম চাইলে আমাদের কাছে এসে অভিযোগ করতে পারবেন। এক প্রশ্নের জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আইনজীবী বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষে আসে। আইনজীবীর কাজ হচ্ছে তার মক্কেলের প্রতি সুবিচার করা। আমি, আমার দায়িত্ব আইন অনুযায়ী পালন পারছি কিনা, যে ভিকটিম পরিবার আছেন, তাদের অভিযোগ যথাযথভাবে আইনসঙ্গত উপায়ে ট্রাইব্যুনালের কাছে উপস্থাপন করতে পারছে কিনা, ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার লক্ষে ভূমিকা পালন করছি কিনা, সেটাই এখানে বিবেচ্য হওয়া উচিত। বাকি বিষয় নিয়ে বাইরে কে কি বলছেন, এটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। এ সময় প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম, বি এম সুলতান মাহমুদ ও তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক আতাউর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
ফাইয়াজের বোন সায়ীমা ইসলাম ফারিন বলেন, ভাইয়া আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমি আর সাধারণ জীবনযাপনে ফিরতে পারিনি। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ক্ষণে ভাইয়ার স্মৃতি ভেসে ওঠে। ওর জন্য আমার মন সারাক্ষণ কাঁদে। এখন পর্যন্ত আমার পড়ালেখা শুরু করতে পারিনি। আমি আজ আদালতে এসেছি ভাইয়ার হত্যার যেন বিচার হয়। এই বিচার যেন ঝুলে না থাকে।
ফাইয়াজের মা ফারহানা দিবা বলেন, আমার বুক যারা খালি করেছে, আমি তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। বাবা শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ফাইয়াজ আমার একমাত্র ছেলে ছিল। আমার ছেলে হত্যার বিচারের জন্য আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ যে কত কষ্টের তা বুঝানো কঠিন। যারাই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি করছি।
ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়, গত ১৮ জুলাই রাজধানী ধানমন্ডি এলাকায় সকাল থেকেই ২৭ নম্বর এলাকায় রাপা প্লাজার সামনে মূল সড়কে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। যেখানে ধানমন্ডি এলাকার কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া ওরফে ফারহান ফাইয়াজও অংশ নেন। সকাল থেকেই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। দফায় দফায় সংঘর্ষ শুরু হয়।
সেই সংঘর্ষে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের এইচএসসি ২৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া ওরফে ফারহান ফাইয়াজ দুপুরে গুলিবিদ্ধ হন। ফারহানের বন্ধুরা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে লালমাটিয়ায় অবস্থিত সিটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ২৩ থেকে ৫৪ ক্রমিক নম্বর আসামিরা ১৮ জুলাই দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে সরাসরি কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন এবং গুলিবর্ষণ করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া ওরফে ফারহান ফাইয়াজ সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
অপরাধের ধরনে যা বলা হয়েছে : আসামিদের পরিকল্পনায় ও নির্দেশে অন্যান্য অজ্ঞাত আসামিরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশে দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে সাধারণ নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা, নির্যাতন, আটক, গুম করার অংশ হিসাবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া ওরফে ফারহান ফাইয়াজকে গুলি করে হত্যা করার মাধ্যমে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করার অভিযোগ।
যাদের আসামি করা হয়েছে : আবেদনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, র্যাবের সাবেক ডিজি হারুন অর রশীদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ, সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, মোহাম্মদপুর জোনের তৎকালীন ডিসি এইচএম আজিমুল হক, এডিসি রওশানুল হক সৈকত, মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন, এসআই শাহরীয়া আলম, ওসি মাহফুজুল হক ভূঁইয়া, ধানমন্ডি থানার ওসি, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি-সেক্রেটারি, যুবলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি-সেক্রেটারি এবং জহির উদ্দিন আহমেদ ওরফে বিচ্ছু জালালসহ ৫৪ জন।