তিতাসের সাবেক এমডি হারুনের দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদকে চিঠি
নসরুল হামিদ বিপুর চাপে আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট

বিশেষ প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

তিতাস গ্যাস কোম্পানির অপসারিত এমডি হারুনুর রশীদ মোল্লার ঘুস দুর্নীতি অনুসন্ধান করতে দুর্নীতি দমন কমিশনে চিঠি দিয়েছে পেট্রোবাংলা। সংস্থাটির চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার মঙ্গলবার যুগান্তরকে এই তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, হারুনুর রশীদ মোল্লার বিরুদ্ধে গ্যাস সংযোগ, লোড বৃদ্ধি, অবৈধভাবে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে শত শত কোটি টাকা দুর্নীতি করার অভিযোগ তারা পেয়েছেন। এছাড়া অবৈধ সংযোগ দিয়ে সেখানে কোনো অভিযান না চালিয়ে ঘুস বাণিজ্য ও সাপ্তাহিক মাসোহারা আদায় করার অভিযোগও পাওয়া গেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ভাঙিয়েও বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে শিল্প সংযোগ দিয়েছেন তিনি। ঘুস আদায় করার জন্য শিল্প মালিকদের নানাভাবে হয়রানি করার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। অনেক শিল্প মালিক অভিযোগ করে বলেছেন, হারুন মোল্লাহকে ঘুস না দিলে তিনি তাদের কারখানার গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতেন। এরপর মিটার টেম্পারিংসহ নানা অভিযোগ এনে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করতেন। তদন্তে এসব অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগের সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্তসহ সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে চিঠি দেয় পেট্রোবাংলা।
এদিকে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আশা করছেন দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের অভিযোগটি অনুসন্ধান করে হারুনুর রশীদ মোল্লার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবে।
জানা গেছে, ২০২৩ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ভাঙিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার ঘটনায় হারুনুর রশীদ মোল্লার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়। নির্দেশনা পেয়ে ওই বছরের আগস্ট মাসে পেট্রোবাংলাকে এক মাসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে চিঠি দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। এ ঘটনায় পেট্রোবাংলা পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরে সিলভার নিট কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেডের কারখানায় বয়লার ও গ্যাসচালিত জেনারেটরের জন্য নতুন গ্যাস সংযোগের আবেদন করা হয়। ওই আবেদনের ওপর নির্দেশনা দিয়ে তিতাসের এমডি লিখেছেন, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের অফিস হতে প্রেরিত। আলাপ করবেন।’ এই নির্দেশনা সংবলিত আবেদনটি তিতাসের গাজীপুরের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মোহাম্মদ সাইদুল হাসানকে পাঠানো হয়। যেহেতু বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, তিতাসের এমডি প্রধানমন্ত্রীকেই ইঙ্গিত করেছেন।
বিষয়টি নজরে আসায় গত বছর ২৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জ্বালানি বিভাগের সচিবকে চিঠি পাঠানো হয়। রূপালী মণ্ডল (পরিচালক-১১) স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) নাম ব্যবহার করে ঘুস গ্রহণ করে শিল্প প্রতিষ্ঠানে তিতাস গ্যাসের সংযোগ প্রদানসহ নানা অনিয়মের বিষয়ে পরীক্ষা করে বিধি মোতাবেক যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের চিঠি পেয়ে বিষয়টি এক মাসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য পেট্রোবাংলাকে নির্দেশ দেয় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।
জ্বালানি বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে তিতাসের এমডির বিরুদ্ধে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে শিল্প প্রতিষ্ঠানে তিতাস গ্যাসের সংযোগ দেওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলা হয়।
এ ঘটনায় পেট্রোবাংলা গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, মেসার্স সিলভার নিট কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেডে নতুন গ্যাস সংযোগের জন্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী বরাবর লেখা আবেদনপত্রটি সাবেক এমডি হারুনুর রশীদ গাজীপুর লোকাল অফিসে পাঠান। আবেদনপত্রে তিনি লেখেন, সাবেক মন্ত্রীর (প্রধানমন্ত্রী) অফিস থেকে প্রেরিত। চিঠিতে তিনি আলাপ করবেন লিখে জোনাল অফিসকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাঠান। গাজীপুর জোনাল অফিস ওই ফাইলটিতে প্রয়োজনীয় নোট লিখে ফের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে নথি অনুমোদনের জন্য পাঠান। এরপর হারুনুর রশীদ মোল্লা ফাইলটি অনুমোদন দেন। তবে ওই ফাইলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর থেকে প্রেরণ বা গ্রহণের কোনো সিল স্বাক্ষর ছিল না। একইভাবে এসএম এক্সেসরিজ লিমিটেডের দুটি আবেদনও একইভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে অনুমোদন দেন হারুনুর রশীদ মোল্লা। ওই দুটি ফাইলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অফিসের কোনো সিল-স্বাক্ষর ছিল না। সেই দুটি ফাইলও হারুনুর রশীদ মোল্লা একইভাবে ‘মন্ত্রী মহোদয়ের অফিস থেকে প্রেরিত, আলাপ করবেন লিখে’ ফাইল পাঠান গাজীপুর জোনাল অফিসে। সেখান থেকে নথি অগ্রগামী করার জন্য নির্দেশনা দিলে জোনাল অফিস প্রয়োজনীয় নোট লিখে ফাইল পাঠান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে। এভাবে সাবেক তিতাস এমডি হারুন বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীদের নাম ব্যবহার করে অসংখ্য শিল্প সংযোগের অনুমোদন দেন।
এ ঘটনায় তিতাস এমডি হারুনুর রশীদের বিরুদ্ধে চাকরিচ্যুতসহ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ও ফৌজদারি মামলা দায়ের করার জন্য তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে জোরালো সুপারিশ করলেও তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর চাপে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়নি।
এদিকে সোমবার হারুনুর রশীদ মোল্লার চুক্তি বাতিল করে তাকে তিতাস গ্যাসের এমডি থেকে অপসারণ করে সেখানে নতুন এমডি নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে মঙ্গলবার তিতাসের হারুনুর রশীদ সিন্ডিকেটের সদস্যরা পেট্রোবাংলায় হামলা চালান। তারা পেট্রোবাংলার বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর চালান।
তারা গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহনেওয়াজ পারভেজকে তিতাস গ্যাসের নতুন এমডি হিসাবে যোগদান করতে দেননি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তিতাসের ২০-৩০ জনের একটি দল পেট্রোবাংলার কর্মকর্তা আর স্টাফদের ওপর হামলা চালান। ভাঙচুর করা হয় অফিসে। মূলত তিতাসের নতুন এমডি শাহনেওয়াজ পারভেজকে যোগদান করতে বাধা দিতেই এ হামলা চালানো হয়।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে জানান, তিতাসকে দুর্নীতিমুক্ত করতে আগের এমডিকে সরিয়ে নতুন এমডি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যারা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী, তারা এটা মানতে না পেরে হামলা চালিয়েছেন। এর আগে সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় জিটিসিএল এমডি শাহনেওয়াজ পারভেজকে তিতাস গ্যাসের এমডি হিসাবে বদলির আদেশ জারি করে। এতে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত জিটিসিএলের এমডি পদে চলতি দায়িত্বে নিয়োজিত পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (কারিগরি ক্যাডার) শাহনেওয়াজ পারভেজকে জিটিসিএল থেকে বদলিপূর্বক তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন পিএলসির (টিজিটিডিপিএলসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদের চলতি দায়িত্ব দেওয়া হলো।
এক্ষেত্রে শর্তযুক্ত হবে যে, চলতি দায়িত্ব একটি সাময়িক ব্যবস্থা এবং তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পারস্পরিক জ্যেষ্ঠতার ক্ষেত্রে কোনো অন্তরায় হবে না এবং নিয়মিত পদোন্নতির ক্ষেত্রে কারও কোনো অধিকার সৃষ্টি বা ক্ষুণ্ন করবে না। এ ছাড়াও চলতি দায়িত্ব দেওয়ার পর ওই ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে কোনো কর্মকর্তা নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি বা পদায়ন করা হলে শাহনেওয়াজ পারভেজ তার পূর্বতন পদ বা মূল পদ অর্থাৎ মহাব্যবস্থাপক পদে ফিরে যাবেন। সে অনুযায়ী, তিনি টিজিটিডিপিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে চলতি দায়িত্বে যোগদান করবেন। কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে জারি করা এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।