রাজনাথের মন্তব্যে ঢাকায় প্রতিক্রিয়া
গাজা কিংবা ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা অনুচিত
প্রতিবেশী দেশের নেতাদের কাছে সবাই দায়িত্বশীল আচরণ আশা করে
মাসুদ করিম
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সাম্প্রতিক মন্তব্যে ঢাকায় বেশ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজা কিংবা ইউক্রেনের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা মোটেও সমীচীন নয়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন যে দিল্লির পছন্দ হয়নি তারই প্রতিফলন ভারতের প্রভাবশালী এই নেতার মন্তব্যে স্পষ্ট। বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, দুই প্রতিবেশী দেশের নেতাদের কাছে সবাই দায়িত্বশীল আচরণ আশা করে। বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বৃহস্পতিবার দেশটির সশস্ত্র বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, ভারত শান্তিপ্রিয় দেশ। শান্তিরক্ষার জন্য ভারতের সশস্ত্র বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ভারতের উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্ণৌতে সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনীর শীর্ষ কমান্ডারদের সঙ্গে কনফারেন্সে সভাপতির বক্তব্যে এ কথা বলেন রাজনাথ। এ সময় তিনি ইউক্রেন এবং গাজায় চলমান সংঘাতের পাশাপাশি বাংলাদেশের পরিস্থিতি উল্লেখ করে সামরিক বাহিনীকে এসব ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে তাদের এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বিশিষ্ট কূটনীতিক ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘ভারতের নেতাদের এটা বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশের জনগণ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নিজস্বতা নিয়ে বসবাস করতে চায়। বাংলাদেশিরা ভয় কিংবা চাপ উপেক্ষা করে নিজেদের মতো নীতিনির্ধারণ করবে।’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলের ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় একতরফা নীতির পরিবর্তে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য আনয়ন করা হবে বলে এই বিশ্লেষকের অভিমত।
এ বিষয়ে ড. ইফতেখার চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের চারটি অগ্রাধিকার রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, অর্থনীতিকে গতিশীল করা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সাধন এবং পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য আনয়ন।’ নিউইয়র্কে অবস্থানরত ইফতেখার চৌধুরী টেলিফোনে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় আরও বলেন, জাতিসংঘে ড. ইউনূসের বক্তৃতা শোনার জন্য বিশ্বনেতারা অপেক্ষা করে আছেন।
রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্যকে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মুনিরুজ্জামান। তিনি শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘গাজা এবং ইউক্রেনের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতির তুলনা করা অযৌক্তিক। বাংলাদেশ একটি শান্তিপ্রিয় দেশ। ভারতের বক্তব্যে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে। কারণ বক্তব্যটি উচ্চপর্যায় থেকে এসেছে। ভারত থেকে এহেন বক্তব্য কেন দেওয়া হলো সেটা আরও বোঝার প্রয়োজন। তিনি একা বক্তব্য দেননি। তিন বাহিনীর প্রধানরা ছিলেন। সিনিয়র কমান্ডাররা উপস্থিত ছিলেন।’
মুনিরুজ্জামান মনে করেন, বিভিন্ন ধরনের অপতথ্যের কারণে ভারত সম্ভবত চিন্তিত। বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাবে তারা মনে করতে পারেন যে, বাংলাদেশ ভুল পথে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সঠিক চিত্র তুলে ধরার জন্যে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক চ্যানেলে আলোচনা প্রয়োজন বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেছেন, রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্যটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে এখানে গাজা কিংবা ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা সমীচীন নয়। দুই প্রতিবেশী দেশের নেতাদের মন্তব্য করার সময় সংবেদনশীলতা বজায় না রাখলে অপ্রয়োজনীয় জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। বর্তমানে দুদেশের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস বিদ্যমান।
সাবেক রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমান বলেছেন, প্রতিবেশী দুদেশের নেতাদের দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত। রাজনাথ সিংয়ের বক্তব্য দায়িত্বশীলতার পরিচয় নয়।
রাজনাথের মন্তব্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনা হচ্ছে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, রাজনাথের মন্তব্য উসকানিমূলক। যদিও বাংলাদেশের সরকারের তরফে এ বিষয়ে ভারতকে কিছু বলা হয়নি। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে রাজনাথ সরাসরি কিছু বলেননি। সশস্ত্র বাহিনীর মনোবল চাঙা রাখার জন্যে তিনি বক্তৃতা করেছেন।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বর্তমান অবস্থা ভারতের পছন্দ নয়। এই বাস্তবতায় রাজনাথের বক্তব্য একটি রাজনৈতিক কথামালা ছাড়া কিছু নয়। ফলে বিষয়টা খুব বেশি সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই। সামনের দিনে আরও এ ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্য আসতে পারে। আমাদের এ নিয়ে অসহিষ্ণু হওয়ার কিছু নেই। আর সবকিছুতে সরকারিভাবে রিঅ্যাক্ট করার দরকার নেই। তবে মাঝে মাঝে বিভিন্ন পর্যায় থেকে কিছু প্রতিক্রিয়া দেখানো যেতে পারে।
এদিকে, ভারতের এক সাংবাদিক যুগান্তরকে বলেছেন, সামরিক কমান্ডারদের মনোবল চাঙা রাখতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ ধরনের বক্তব্য অনেকটাই রুটিন কথাবার্তা। এটাকে অতি ব্যাখ্যা করে উদ্বেগজনক মনে করা ঠিক নয়। এটা বাংলাদেশকে কোনো হুমকিও নয়।
তিনি বলেন, ভারতের কাছে চীনের সীমান্ত নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। ৪ বছরের বেশি সময় ধরে চীন সীমান্তে প্রায় ৬০ হাজার সৈন্য মোতায়েন আছে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর এত বেশি সৈন্য সমাবেশ কখনও হয়নি। ভারতের কাছে এটাই মূল উদ্বেগের বিষয়। চীন ও পাকিস্তান সীমান্ত নিয়ে উদ্বেগ ভারতের থাকবে। বাংলাদেশে বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার আছে। ভবিষ্যতে বিএনপি, জামায়াত কিংবা ছাত্র-জনতার সরকার ক্ষমতায় গেলে গত ১৫ বছরের মতো নিবিড় সম্পর্ক না হলেও ওয়ার্কিং সম্পর্ক অবশ্যই থাকবে।