ইডিএফ থেকে ঋণ ও তহবিলের আকার কমানো
বড় অঙ্কের এলসি খুলতে বিপাকে রপ্তানিকারকরা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ বিতরণ কমিয়ে দেওয়ায় বড় অঙ্কের এলসি খুলতে বিপাকে পড়েছেন রপ্তানিকারকরা। একদিকে ডলার সংকটের কারণে উদ্যোক্তারা নতুন এলসি খুলতে ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত ডলারের জোগান পাচ্ছেন না, অন্যদিকে ইডিএফ থেকেও ব্যাংকগুলোর নতুন ঋণের জোগান চাহিদা অনুযায়ী দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে রপ্তানি খাতে বড় অঙ্কের এলসি খুলতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ডলারের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এতে কাঁচামাল আমদানিতে বিলম্ব ঘটছে।
সংশ্লিষ্ট এলসির বিপরীতে রপ্তানিতেও দেরি হচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রপ্তানি খাতে। সূত্র জানায়, করোনার সময় রপ্তানি খাতকে উৎসাহিত করতে তহবিলের আকার বাড়িয়ে ৭০০ কোটি ডলার করা হয়। একই সঙ্গে সুদের হার কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এতে রপ্তানিকারকরা এ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে সহজে এবং কম সুদে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণের জোগান পেতেন। ফলে দ্রুত এলসি খুলে কম সময়ের মধ্যে পণ্য আমদানি করে রপ্তানি করতে পারতেন।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফ-এর সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির সময়ে তারা শর্ত আরোপ করে রিজার্ভ থেকে ডলার নিয়ে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা অর্থ বাদ দিয়ে নিট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করতে হবে। যেহেতু রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে ৭০০ কোটি ডলারের তহবিল গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এ কারণে ওই পরিমাণ ডলার রিজার্ভ থেকে বাদ দিতে হবে। এতে রিজার্ভ অনেক কমে যাবে। ওই সময়ে রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে মোট ৮০০ কোটি ডলার দিয়ে কয়েকটি তহবিল গঠন করা হয়েছিল। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইডিএফ তহবিলের আকার ছোট করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ওই তহবিল থেকে যেসব ডলার ঋণ হিসাবে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো ফেরত আসার পর আর নতুন করে ঋণ দেওয়া কমিয়ে দেয়। ওইসব ডলার রিজার্ভে যোগ করা হয়। এতে নিট রিজার্ভ কিছুটা বাড়ানো সম্ভব হয়েছে।
তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া কমানোর ফলে এর আকার কমে ৫০০ কোটি ডলারের নিচে নেমেছে। এর আকার আরও কমিয়ে ৩০০ কোটি ডলারের মধ্যে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে তহবিলের সুদের হার ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে এখন করা হয়েছে ৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এতে একদিকে সুদের হার বৃদ্ধি, অন্যদিকে তহবিল থেকে ঋণের জোগান কমিয়ে দেওয়ায় রপ্তানিকারকদের খরচ যেমন বেড়েছে, তেমনই ডলার প্রাপ্তিতেও সমস্যা হচ্ছে।
আগে ব্যাংক নিজস্ব উৎস থেকে ডলারের জোগান দিয়ে দ্রুত এলসি খুলত; পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিল থেকে সমপরিমাণ ডলার ঋণ হিসাবে নিয়ে নিত। ডলার সংকট শুরু হলে ব্যাংকগুলো নিজস্ব উৎস থেকে ডলারের জোগান কমিয়ে দেয়। এ কারণে ইডিএফ তহবিলের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ডলারের জোগানের জন্য। কিন্তু তহবিলের আকার ছোট করার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চেয়েও ওই তহবিলের ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে নতুন এলসি খুলতে গিয়ে রপ্তানিকারকরা বিপাকে পড়েন।
এদিকে রপ্তানিকারকরা রপ্তানি আয় বাবদ যেসব ডলার পাচ্ছেন, এর বিপরীতে সুদসহ ব্যাক টু ব্যাক এলসির দেনা কেটে নেওয়ার পর ১৫ শতাংশের কম ডলার নিজেদের কাছে রাখতে পারছেন। ফলে ওই ডলার ভাঙিয়ে তারা স্থানীয় খরচ মেটাচ্ছেন। বাড়তি ডলার না থাকায় নতুন এলসি খুলতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে যাচ্ছেন।
এদিকে ইডিএফ-এর আকার ছোট করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছরের ১ জানুয়ারি ১০ হাজার কোটি টাকার একটি রপ্তানি খাতে ব্যবহারের জন্য প্রাক-জাহাজীকরণ তহবিল গঠন করে। ওই তহবিল থেকে রপ্তানিকারকদের টাকায় ঋণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওই তহবিল থেকে টাকায় ঋণ নিয়ে তা দিয়ে ডলার কিনতে হয়। ডলার কেনা সম্ভব না হলে এলসি খোলা যাচ্ছে না। আর এখন ডলার সংকটের কারণে তহবিল থেকে ঋণ পেলেও ডলারের জোগান সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। এতে রপ্তানি খাতের এলসি খোলার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
একই সঙ্গে ইডিএফ তহবিল থেকে ঋণসীমা কমানো হয়েছে। আগে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ), বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সদস্যরা আড়াই কোটি ডলার ঋণ পেতেন প্রতি এলসির বিপরীতে। গত বছরের এপ্রিল থেকে এই সীমা ৫০ লাখ ডলার কমিয়ে দুই কোটি ডলার করা হয়। বাংলাদেশ ডাইড ইয়ার্ন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ (বিডিওয়াইইএ) অন্য সদস্যরা আগে ঋণ পেতেন দেড় কোটি ডলার। গত বছরের এপ্রিল থেকে পাচ্ছেন ১ কোটি ডলার।
এর ফলে যারা বড় অঙ্কের এলসি খোলেন, তারা সমস্যায় পড়েছেন। কারণ, তারা একসঙ্গে ২ কোটি ডলারের বেশি এলসি খোলেন। ফলে চাহিদা অনুযায়ী তারা ডলার পাচ্ছেন না।
রপ্তানি খাতের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে মঙ্গলবার বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ-এর একটি প্রতিনিধিদল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে তারা ইডিএফ-এর আকার ছোট না করার দাবি করে বলেছেন, রপ্তানি খাতে ডলারের জোগান বাড়াতে এর আকার আগের মতো ৭০০ কোটি ডলার করা জরুরি।
কয়েকটি ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ট্রেজারি প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকগুলোয় ডলারের প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে। তবে তা চাহিদার তুলনায় একেবারেই কম। রপ্তানির এলসি খুলতে আগে ইডিএফ থেকে সহজেই ডলার পাওয়া যেত। এখন তহবিলের আকার ছোট করায় এবং নতুন ঋণ বিতরণ কমিয়ে দেওয়ায় আগের মতো ইডিএফ থেকে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে রপ্তানির এলসি খোলার ক্ষেত্রে ডলার সংস্থানে একটু সময় লাগছে। বিশেষ করে বড় গ্রুপগুলোর বড় বড় এলসি খোলার জন্য ডলার সংস্থান করার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, রপ্তানি খাতকে সহায়তা করতে ১৯৮৯ সালে ৩৮ লাখ ৭২ হাজার ডলার নিয়ে ইডিএফ গঠন করা হয়। রপ্তানিকারকদের কাছে এ তহবিলের ব্যাপক চাহিদা থাকায় এর আকার পর্যায়ক্রমে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ৭০০ কোটি ডলার করা হয়। এখন আকার কমানো হচ্ছে।