বিপু সিন্ডিকেটে ডুবছে ডেসকো
মুজিব মাসুদ
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সিন্ডিকেটে ডুবতে বসেছে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। এ সিন্ডিকেটের ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণে বিদ্যুৎ খাতের সবচেয়ে লাভজনক কোম্পানিটি দিনদিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাড়ছে সিস্টেম লস। এখন সিস্টেম লস গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি। দিনদিন কমছে লাভ। ২০১৪ সালে নসরুল হামিদ মন্ত্রী হওয়ার আগে ডেসকো বছরে আড়াইশ থেকে ৪০০ কোটি টাকার বেশি লাভ করত। এখন মাসে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে।
সিন্ডিকেটের দুর্নীতি, ঘুস বাণিজ্য আর নানা অদক্ষতার কারণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে নেওয়া ৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পটি শুরু করতে পারেনি এ কোম্পানি। কারণ, প্রকল্পের নেতৃত্বে যারা, তাদের অধিকাংশই বিপু সিন্ডিকেটের সদস্য। ফলে গ্রাহক সংখ্যা বাড়ানো যাচ্ছে না। আবাসিক এবং শিল্প খাতের গ্রাহকরা তাদের লোড বাড়াতে পারছে না। ছোটখাটো ঝড়বৃষ্টিতে ট্রিপ করছে লাইন।
ধারণক্ষমতার বেশি লোড হলে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ ঘটছে। দুই বছর আগে নেওয়া এ প্রকল্পের মোট ৭টি লটের মধ্যে এখনো ৩টির কার্যাদেশ দেওয়া সম্ভব হয়নি। বাকিগুলোর কার্যাদেশ দেওয়া হলেও কাজ শুরু হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ প্রকল্পের আওতায় সাব-স্টেশন বসানো, লাইন কনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে সিস্টেমের সক্ষমতা ও ক্যাপাসিটি বাড়ানোর কথা। কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে এখন পিক আওয়ারে অনেক বাসাবাড়ি, শিল্পকারখানা ও মার্কেট প্রতিষ্ঠানে জোর করে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। তা না হলে সিস্টেম পুড়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। এ রিপোর্টের তথ্যগুলো কোনো কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করে বলতে সম্মত হননি।
সিন্ডিকেটের অদূরদর্শিতা আর কমিশন বাণিজ্যের কারণে ডেসকোর ৪০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ কয়েকটি দুর্বল ব্যাংকে ফ্রিজ হয়ে আছে। তারল্য সংকটের কারণে ওই টাকা দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। সম্প্রতি পদ্মা ব্যাংকের একটি বড় এফডিআর মেয়াদপূর্ণ করলে সেটি ভাঙানো যাচ্ছে না ব্যাংকের ফান্ড স্বল্পতার কারণে। বর্তমানে ডেসকোর ৩০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ এফডিআর আকারে ফার্মারস ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, পদ্মা ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে পড়ে আছে। বারবার চিঠি দিয়েও এ টাকা উঠানো যাচ্ছে না। ব্যাংক বলছে তাদের কাছে টাকা নেই।
অথচ এ খাত থেকে এখনো প্রতিমাসে সিন্ডিকেট সদস্যদের পকেটে পৌঁছে যাচ্ছে কমিশন। সিন্ডিকেটের কমিশন বাণিজ্যের কারণে ২ লাখ ২৪ হাজার প্রিপেইড মিটারের ৩টি প্রকল্প তিন কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছে। আর এ খাত থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট।যে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের শ্যালক ও তার এক প্রভাবশালী আবাসন ব্যবসায়ী বন্ধুর মালিকানা আছে। প্রথমে স্ত্রীর ভাই কোম্পানির মালিকানায় ছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুতে স্ত্রীর খালাতো ভাই সেই পদে আসেন। যদিও ডেসকো বলছে, তারা ৮০ হাজার করে ২ লাখ ২৪ হাজার প্রিপেইড মিটার তৈরির কাজ ৩টি সরকারি কোম্পানিকে দিয়ে করিয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড ডেসকো দীর্ঘদিন নিয়মিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বিহীন পরিচালিত হচ্ছে। ছয় মাসেরও বেশি সময় এমডি না থাকলেও এ ব্যাপারে কারও মাথাব্যথা নেই। বরং এ সুযোগে আওয়ামী প্রশাসনের সুবিধাভোগী এক কর্মকর্তা মেতে উঠেছেন নিজের আখের গোছানোর কাজে।
গত ফেব্রুয়ারিতে নিয়মিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ এবং সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়। কিন্তু এরপরও এমডি নিয়োগ না দিয়ে নয়ছয় করে সময় ক্ষেপণের অভিযোগ উঠেছে। সিন্ডিকেট এখন এমডি হিসাবে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য নানা চেষ্টা চালাচ্ছে। এ অবস্থায় প্রশাসন শাখার সাবেক এক শীর্ষ কর্তার নেতৃত্বে সিন্ডিকেট অবৈধ মাস্টার রোলে শতাধিক লোকবল নিয়োগ দেয়। প্রতিটি নিয়োগেই মোটা অঙ্কের লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
ডেসকো একটি সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। এর কর্ণধার না থাকায় সেবাপ্রত্যাশীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়ন। মুখ থুবড়ে পড়ছে নিয়মিত কার্যক্রম। ভুক্তভোগী সেবাগ্রহীতাসহ ডেসকো স্টেকহোল্ডাররা জরুরি ভিত্তিতে একজন উপযুক্ত এমডি নিয়োগের দাবি জানান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সিন্ডিকেট সদস্য হিসাবে ডেসকোতে এতদিন দাপটের সঙ্গে ছিলেন এক নির্বাহী পরিচালক এবং ওজোপাডিকোর এক নির্বাহী পরিচালক। তারা এখনো বহাল তবিয়তে সাবেক সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন।
অভিযোগ আছে, ডেসকোর ওই নির্বাহী পরিচালক পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমানের সান্নিধ্যে থেকে নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসাবে পদোন্নতি হাতিয়ে নেন। তিনিও ছিলেন বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের অন্যতম সদস্য। সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর একান্ত আস্থাভাজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী প্রথমে প্রধান প্রকৌশলীর অতিরিক্ত দায়িত্ব এবং পরে সরাসরি নির্বাহী পরিচালক বনে যান। ডেসকোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রকৌশল বিভাগ।
এ বিভাগের মাধ্যমেই সব প্ল্যানিং, ড্রয়িং, ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন প্রস্তুত ও অনুমোদন এবং প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নির্বাহী পরিচালক হিসাবে ডেসকোতে তার অবদান শূন্য, বরং তার কারণে কোটি কোটি টাকা নয়ছয় হয়েছে। তার এসব কাজে সহযোগিতা করেছেন সাবেক এক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, এক উপবিভাগীয় প্রকৌশলী এবং গুলশান জোনের এক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। অভিযোগ আছে, ডেসকোর নির্বাহী পরিচালক প্রভাব খাটিয়ে তার সিন্ডিকেটের এক সদস্যকে প্রথমে নির্বাহী প্রকৌশলী (উন্নয়ন ও প্রকল্প) ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (উন্নয়ন ও প্রকল্প) এবং বিতরণ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে ভূগর্ভস্থ কেবল লেয়িংয়ের দায়িত্ব দেন।
ডেসকোতে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে বিতরণ প্রকল্পের কেবল লেয়িংয়ে। এর মধ্যে কেবল লেয়িংয়ের পরিমাণ বেশি, বালির পরিমাণ বেশি এবং ঠিকমতো স্লিপার না দিয়ে অতিরিক্ত কেবলের ব্যবহার দেখিয়ে বাইরে পাচার করা হয়েছে। এসব সুবিধা দিয়ে ঠিকাদারের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতি না মেনে কেবল ইস্যু করা হয়েছে এবং কাজ শেষে আজবিল্ড ড্রয়িং করা হয়নি। ফলে ডেসকোর কোটি কোটি টাকার আন্ডারগ্রাউন্ড কেবল নয়ছয় হয়েছে।
কেবল লেয়িংয়ে কোনো নিয়মনীতি না মেনে কেবল ইস্যু এবং কাজ শেষে এজবিল্ড ড্রয়িং না করায় কেবল চুরির বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবু নাসেরকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি এ সিন্ডিকেট সদস্যদের দায়দায়িত্ব রয়েছে মর্মে রিপোর্ট করলে আহ্বায়কের সমপর্যায়ের কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা থাকায় তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী মহিউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে একটি যাচাই কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটিও সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট সদস্যদের দায়দায়িত্ব রয়েছে মর্মে রিপোর্ট দেয়।
রিপোর্টে বিভিন্ন ঠিকাদারের কাছে প্রাপ্য কেবলের পরিমাণ নিশ্চিত করাসহ কমিটির রিপোর্ট পর্যালোচনা করে কেবল চুরির পরিমাণ ও দায়দায়িত্ব নির্ধারণের নিমিত্তে নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) ও নির্বাহী পরিচালককে (সংগ্রহ) আহ্বায়ক করে ২টি কমিটি গঠন করা হয়। ডেসকোর সাধারণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মনে করেন, প্রতিটি বিষয়ে নির্বাহী পরিচালকের (প্রকৌশল) দায়দায়িত্ব রয়েছে বিধায় তিনি সবাইকে সেভ করে নামকাওয়াস্তে রিপোর্ট করেছেন।
দুর্ভাগ্যক্রমে ওই সময়ে নির্বাহী পরিচালকের (সংগ্রহ) মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয় থাকায় তিনিও মেয়াদ বৃদ্ধির প্রলোভনে তাদের খুশি করতে তদন্ত কমিটি ও যাচাই কমিটির রিপোর্ট সঠিকভাবে পর্যালোচনা না করে অভিযুক্তদের দায়দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে রিপোর্ট করেন।
ডেসকোর সৎ কর্মকর্তাদের মতে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তকে সব অভিযোগ থেকে মুক্তি প্রদান করে ডেসকোর সবচেয়ে লোভনীয় পদে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসাবে পোস্টিং প্রদান করে পুরস্কৃত করাসহ দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হয়েছে। লোড ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে প্রথমে বড় ধরনের অর্থসংশ্লিষ্ট প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়, পরে লেনদেনের বিষয় ফয়সালা হলে প্রাক্কলনের অর্থের আকার কমে নতুন করে প্রস্তুত হয়ে যায়।
এভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্র। এ ধরনের অনেক অভিযোগ ডেসকোর শীর্ষ পর্যায় ও মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন সময়ে গেছে, তবে কোনোটির তদন্ত হয়নি। ২০১৬ থেকে ২০২৫ সাল-নয় বছরে টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম, গুলশান, বারিধারা বিওবিবি ভাগের লোড ক্লিয়ারেন্সের ফাইলগুলোর মুভমেন্ট তদন্ত করা হলে অনেক প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি। এ কাজে সিন্ডিকেট নেতাকে এক উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ও এক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
অভিযোগ, আরএমইউ ক্রয়ের ক্ষেত্রে কারসাজি করে মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক মো আখেরুল ইসলাম কর্তৃক অন্য সদস্যদের অন্ধকারে রেখে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে রেসপন্ড করে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে অভিযোগ এলেও বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়।
ডেসকোর সব প্রকল্প গ্রহণ করা হয় নির্বাহী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে। অভিযোগ, সিন্ডিকেটের মূল গডফাদার নিজের আখের গোছানোর জন্য কিছু প্রকল্প সাবেক প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে যোগসাজশে গ্রহণ করেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো হেডকোয়ার্টার প্রকল্প, এমআইসি প্রকল্প এবং ২ লাখ মিটার ক্রয় প্রকল্প, আন্ডারগ্রাউন্ড উপকেন্দ্র, পূর্বাচল আন্ডার গ্রাউন্ড মাস্টার প্ল্যান প্রকল্প।
এখানে উল্লেখ্য, ডেসকো সাড়ে তিন কোটি টাকায় একটি যুগোপযোগী আন্ডারগ্রাউন্ড মাস্টার প্ল্যান করলেও সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও সিন্ডিকেট নেতা একই কাজ ৩০ কোটি টাকায় অন্য একটি কোম্পানিকে দিয়ে করাচ্ছে। এসব প্রকল্প প্রাক্কলন ব্যয়ের কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে।