বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ১০ জনকে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও ১০টি হত্যা মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় চারটি এবং গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও ফতুল্লা, ঢাকার আশুলিয়া, উত্তরা ও চট্টগ্রামে একটি করে মামলা হয়েছে। ঢাকার পাঁচ মামলায় শেখ হাসিনাসহ ১১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। বুধবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চারটি মামলা করা হয়। 

আদালত সংশ্লিষ্ট থানাকে মামলা চারটি এজাহার হিসাবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। এর মধ্যে সূত্রাপুরে একটি, মিরপুরে একটি, তেজগাঁওয়ে একটি ও রামপুরা থানা এলাকায় একটি হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। 
আরেকটি মামলা হয়েছে উত্তরা পূর্ব থানায়। বিভিন্ন মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোহাম্মদ আলী আরাফাত, জুনায়েদ আহমেদ পলক, মহিববুর রহমান, ওয়াকিল উদ্দিন, মাঈনুল হোসেন খান নিখিল, শেখ ফজলে শামস পরশসহ ১১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া বগুড়া ও সিলেটে হামলা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে আরও দুটি মামলা হয়েছে।

এর মধ্যে পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে এলেম আল ফায়দি নামে শিক্ষানবিশ টেকনিশিয়ানকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৩৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তরিকুল ইসলামের আদালতে সামসুল আরেফিন নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক শিক্ষার্থী এ মামলা করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে অভিযোগটি সূত্রাপুর থানাকে এজাহার হিসাবে গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। মামলায় ঢাকা-৬ আসনের সাবেক এমপি সাঈদ খোকন, ঢাকা-৭ এর সাবেক এমপি সোলাইমান সেলিম, জবি ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহীম ফরাজী, সাধারণ সম্পাদক এসএম আকতার হোসাইন, কবি নজরুল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি বেলায়েত হোসেন সাগর, সাধারণ সম্পাদক ফারুক হাওলাদারকেও আসামি করা হয়েছে।

মিরপুর থানার মামলায় র‌্যাবের হেলিকপ্টার থেকে গুলিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস সহায়ক ফিরোজ তালুকদারকে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকসহ পাঁচজনকে আসামি করা হয়। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মেহেদী হাসানের আদালতে মামলার আবেদন করেন নিহতের স্ত্রী রেশমা সুলতানা। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অভিযোগটি এজাহার হিসাবে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। 

মামলার অভিযোগে বলা হয়, সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক শেখ হাসিনার নির্দেশে অন্য সব আইনজীবী তথা অ্যামিকাস কিউরিদের মতামত উপেক্ষা করে একতরফাভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। তার জাজমেন্ট আদালতের আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে দেশে অঘোষিত স্বৈরতন্ত্র কায়েমপূর্বক শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের যথেচ্ছভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রয়োগের অনুমতি প্রদান করে। ফলস্বরূপ সরকার খুন, গুম ও ক্রসফায়ারের মাধ্যমে মানুষ হত্যা ও নিষ্পেষণ অব্যাহত রাখে।

রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী মো. তৌহিদুল হক হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনা, নিঝুম মজুমদার ও মুনতাসীর মামুনসহ ৪৯ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নুরুল হুদা চৌধুরীর আদালতে ৪৯ জনের নামসহ অজ্ঞাত ২০০-৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেন নিহতের বড় ভাই তারিকুল ইসলাম। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে তেজগাঁও থানাকে অভিযোগটি এজাহার হিসাবে গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।

এদিকে রাজধানীর রামপুরায় রাসেল মিয়া নামে একজনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আফনান সুমীর আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন নিহতের স্ত্রী শারমিন আক্তার। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে রামপুরা থানাকে অভিযোগটি এজাহার হিসাবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন রাজধানীর উত্তরায় মো. ফজলুল করিম (২৮) নামের এক পোশাককর্মী নিহতের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলায় ৩৯ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা ১০০-১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। বুধবার নিহতের বড় ভাই আনোয়ার হোসেন আয়নাল বাদী হয়ে উত্তরা পূর্ব থানায় এ মামলা করেন। উত্তরা পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদুল হাসান মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নবকিশলয় হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র রোমান মিয়া (১৭) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শেখ হাসিনা ও নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীসহ ১০৫ জনকে আসামি করে রূপগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়েছে। বুধবার নিহত রোমানের খালা রিনা বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় অন্য আসামিরা হলেন সাবেক এমপির ছেলে গোলাম মর্তুজা পাপ্পা, পিএস এমদাদুল হক দাদুল প্রমুখ।

ফতুল্লা (নারায়ণগঞ্জ) : ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের সাইনবোর্ড এলাকায় গুলিতে বাসচালক আবুল হোসেনকে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, ভাতিজা আজমেরী ওসমানসহ ৮০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে। বুধবার দুপুরে ফতুল্লা মডেল থানায় নিহতের মা সাহিদা বেগম বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় আরও ১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম : কোটা সংস্কার আন্দোলনে মো. ফজলে রাব্বি নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যুর ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের ২৭০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। বুধবার নগরীর চান্দগাঁও থানায় মামলাটি করেন নিহত ফজলে রাব্বির বাবা মো. সেলিম মিয়া। এতে অজ্ঞাতনামা আরও ১০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন-হাছান মাহমুদ, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, আ জ ম নাছির উদ্দীন, এমএ লতিফ, এমএ সালাম প্রমুখ।

আশুলিয়া : সাভারের আশুলিয়ায় ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় এক সেলুনকর্মীকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সাংবাদিকসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করা হয়েছে। মঙ্গলবার নিহতের ছোট ভাই আনারুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি করেন। আদালত ৩ দিনের মধ্যে আশুলিয়া থানাকে মামলাটি রেকর্ড করার আদেশ দিয়েছেন। নিহতের নাম জাহিদুল ইসলাম সাগর (২৮)। তিনি রংপুরের তাজহাট থানাধীন দুর্গাপুর এলাকার মো. রফিকুল ইসলামের ছেলে। পেশায় একজন সেলুন কর্মী। তিনি পরিবারের সঙ্গে আশুলিয়ার বাইপাইল বগাবাড়ি এলাকায় বসবাস করতেন।

গাজীপুর : গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নূর আলম (২২) নিহতের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আ ক ম মোজাম্মেল হক, সিমিন হোসেন রিমি, মেহের আফরোজ চুমকি, রুমানা আলী টুসি, আজমত উল্লাহ খান, আসাদুর রহমান কিরণ, মতিউর রহমান মতিসহ ১৩৯ জনের নামে হত্যা মামলা করা হয়েছে। মামলায় আওয়ামী লীগের অজ্ঞাতনামা আরও প্রায় ১৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে। 

মঙ্গলবার রাতে গাজীপুর মেট্রোপলিটন বাসন থানায় মামলাটি রেকর্ড হয়। মামলার বাদী হয়েছেন নিহত নূর আলমের বাবা মো. আমির আলী (৪৪)। ২০ জুলাই সকাল পৌনে ১০টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের তেলিপাড়ার হানিমুন রেস্টুরেন্টের সামনে রাস্তায় অবস্থানরত আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান নূর আলম।

সিলেট : সিলেটে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৮৭ জনের নামোল্লেখ করে মামলা করা হয়েছে। বুধবার দুপুরে সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ১ম ও দ্রুত বিচারিক আদালতে মামলাটি করেন জেলা ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. জুবের আহমদ। 

৪ আগস্ট সিলেট নগরীর বন্দরবাজার এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের গুলি ও হামলা করার অভিযোগে মামলাটি করা হয়। মামলায় আজ্ঞতনামা আরও ৫০০-৬০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় স্থানীয় পর্যায়ের আসামিদের মধ্যে রয়েছেন-সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক এমপি হাবিবুর রহমান হাবিব, সাবেক এমপি শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন খান প্রমুখ।

বগুড়া : বগুড়ায় এবার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ১৪০ জনের নাম উল্লেখ করে ৩৪০ জনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শিবগঞ্জ উপজেলার সমন্বয়ক শাহীনুর ইসলাম মঙ্গলবার বগুড়ার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ মামলা করেন।