Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়

সুবিধাভোগী দলবাজরা এখনো বহাল

Icon

বিএম জাহাঙ্গীর

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সুবিধাভোগী দলবাজরা এখনো বহাল

ফাইল ছবি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার ১০ দিন পার হয়ে গেছে। কিন্তু প্রশাসন এখনো দুর্বৃত্তায়নের খোলসমুক্ত হতে পারেনি। স্বৈরাচারী সরকারের দোসরদের বেশির ভাগ বহাল-তবিয়তে বসে থাকায় সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত দলমত নিরপেক্ষ আমলাদের অনেকে যুগান্তরকে জানিয়েছেন, গত ১৬ বছরে শেখ হাসিনার সরকার পিয়ন থেকে সচিব পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে নিজের লোকদের পুনর্বাসন করেছে, বসিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। আর তাদের দলীয় ক্যাডারের মতো লালন-পালন করা হয়েছে।

এর ফলে এরা একদিকে নির্বিঘ্নে দুর্নীতি করে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থসম্পদ বানিয়েছেন, অন্যদিকে এক একজন স্বৈরশাসক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। কখনো তারা নিজেকে জনগণের সেবক মনে করেননি। জনগণকে তারা ক্রীতদাস মনে করে চলতেন। এখানেই শেষ নয়, এরা ব্যাচমেটদের অনেক ক্ষতি করেছেন। যারা মেধা তালিকার ওপরের দিকে কিংবা চাকরি জীবনে এসে অধিকতর দক্ষ আমলার পরিচিতি পেয়েছেন তাদের সব সময় কোণঠাসা করে রাখতেন। সরকারবিরোধী ট্যাগ লাগিয়ে শত শত কর্মকর্তার প্রাপ্য পদোন্নতি তারা কেড়ে নিয়েছেন। দফায় দফায় পদোন্নতিবঞ্চিত করে তাদের সামাজিক ও পারিবারিকভাবে চরম হেনস্তা করেছেন। তাই এদের কোনো ক্ষমা নেই। তারা বলেন, কেউ কেউ এখন রাতারাতি খোলস পালটে ভালো মানুষ সাজার চেষ্টা করছেন।

উপদেষ্টাদের সঙ্গে আত্মীয়তা কিংবা পুরোনো সখ্যের লিংক দিয়ে সেফজোনে ঢুকে পড়তে মরিয়া। ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের সাফ কথা-যদি বিগত সরকারের সবক’টা চাটুকারকে বিদায় করা না হয় তাহলে তারাও হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবেন না। ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে সচিবালয় ঘেরাও করবেন। প্রথম ধাপে ভুক্তভোগী কর্মকর্তাদের অনেকের আজ রোববার সচিবালয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করার কথা ছিল। তবে সরকারে দায়িত্বশীল মহলের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ২০ আগস্ট বিকাল পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের এক বিবৃতিতে শনিবার রাতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বঙ্গভবন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনসহ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর ও প্রাইজপোস্টিংয়ে থাকা কর্মকর্তাদের এ সপ্তাহের মধ্যে সরাতে হবে। তা না হলে বেশির ভাগ কর্মকর্তা কাজ করবে না। প্রয়োজনে সাধারণ কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন। কেউ কেউ বলেন, আওয়ামী দোসদের রোববার থেকে আর অফিস করতে দেওয়া হবে না। তাদের নেত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। ফলে তাদের আর এক মুহূর্ত চেয়ারে থাকার নৈতিক অধিকার নেই।

সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের একটি অংশ শুক্রবার অফিসার্স ক্লাবে বৈঠক করেন। শনিবারও তারা বৈঠক করে রোববার সচিবালয়ে সমবেত হওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। সভায় যোগ দেওয়া কয়েকজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের প্রায় দু’সপ্তাহ পার হতে চলেছে। কিন্তু বিগত সরকারের সুবিধাভোগীরা দিব্বি আগের চেয়ারে বসে আছে। তাদের সরানো তো দূরের কথা, বরং তাদের সঙ্গে নিয়ে উপদেষ্টারা মিটিং করছেন। কী বিব্রতকর পরিস্থিতি। যেখানে তাদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হওয়ার কথা, সেখানে তারা এখনো অফিস করছেন(!) এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা ও ভুল কী হতে পারে।

তারা মনে করেন, উপদেষ্টা পরিষদের নীতিনির্ধারক মহলকে বুঝতে হবে-এরা তো ষড়যন্ত্রকারী। একটু সুযোগ পেলে ছোবল বসিয়ে দেবে। ছাত্র-জনতার তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত নতুন স্বাধীনতা তারা নস্যাৎ করে দেবে। আমাদের কাছে খবর আছে, চক্রান্তকারী কর্মকর্তারা এখনো প্রতিবিপ্লবের স্বপ্নে বিভর। এজন্য তারা নানা প্রক্রিয়ায় গোপনে একত্রিত হচ্ছেন। তারা কিন্তু বসে নেই। ফলে আর সময় দেওয়া হবে না। হয় তারা থাকবে, না হয় আমরা। তারা বলেন, শুধু পদ থেকে সরানো নয়, ওদের বাসা বাড়িতেও অবিলম্বে অভিযান চালাতে হবে। ঠিকমতো অভিযান চালালে ওদের বাসায় নগদ কোটি কোটি টাকা ও বিদেশি মুদ্রা পাওয়া যাবে। ইতোমধ্যে একজনের বাসা থেকে তিন কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে।

এছাড়া বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যে বা যারা সুবিধা নিয়ে সরকারের উচ্চপদে ছিলেন তারা এ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদসহ কোনো পদে থাকতে পারবেন না। অথচ এমন কিছু করার অপচেষ্টা হচ্ছে। কারণ, যিনি বা যারা শেখ হাসিনা সরকারের বিশেষ সুবিধাভোগী তারা কিভাবে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মর্ম বুঝবেন। তাই এসব সুবিধাভোগী আমলাদের কোথাও জায়গা হবে না। তাদের সুবিধাভোগীর পিএস এপিএসরা এখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বসে আছেন। অন্তত দু’জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির পিএস এখন আনন্দে আত্মহারা অবস্থা। তারা বসে আছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। যারা বিগত স্বৈরাচার সরকারের দোসরদের অন্যতম সহচর ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বসে ছড়ি ঘুরিয়েছেন। বহু কর্মকর্তাদের পদোন্নতিবঞ্চিত করার পেছনে ১৮ ব্যাচের এই কর্মকর্তাদের সরাসরি ইন্ধন ছিল। অতএব সাধু সাবধান! ভুলেও খোলস পালটে নতুন শিবিরে ভেড়ার অপচেষ্টা করবেন না।

একজন কর্মকর্তা বলেন, তাকে উপসচিব পদে চার দফায় পদোন্নতি বঞ্চিত করেছেন তারই কিছু ব্যাচমেট। এদের অনেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এখনো বহালতবিয়তে বসে আছেন। ওদের ক্ষমা নেই। যেখানে পাব সেখানেই ধরব। কারণ তারা আমার চোখের সব পানি কেড়ে নিয়েছেন। আমি এখন কাঁদতেও ভুলে গেছি। এত কেঁদেছি যে, আমার চোখে আর কোনো পানি নেই। লজ্জায় সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে যেতে পারিনি। সবাই ভেবেছেন, আমি অযোগ্য। তাই আমার পদোন্নতি হচ্ছে না।

অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করে আসছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। যার নেতৃত্বে রয়েছেন ১৭ ব্যাচের শায়লা ফারজানা। যিনি বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া পুলিশের অতিরিক্ত আইজি এবং পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলামের স্ত্রী। বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা যাকে সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দপ্তর থেকে বের করে দিয়েছেন। কিন্তু বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কে তার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব এখনো বহাল আছে। এখানে তার অন্যতম সহযোগী হিসাবে আছেন উম্মে সালমা তানজিয়া ও শেখ মোমেনা মনি। প্রায় সাড়ে পাঁচশত নারী কর্মকর্তার এই গ্রুপের এডমিন ৯ জনের হাতে জিম্মি। সম্প্রতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে এরা গ্রুপে পোস্ট দেওয়া ব্লক করে রাখেন। এখনো ব্লক আছে।

এছাড়া আরও কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, বিগত সরকারের সচিবরা এখনো কিভাবে চেয়ারে বহাল আছেন-এটা তারা কোনোভাবে মানতে পারছেন না। কোথায় মন্ত্রীদের পিএসরা। তাদেরও ধরতে হবে। ১৬ বছর ধরে যারা রামরাজত্ব কায়েম করেছিলেন। ডিসি, বিভাগীয় কমিশনারদেরও ছাড়া যাবে না। এরা এক একটা টাকার কুমির। সবকটি দুর্নীতিবাজ। বেশির ভাগ ডিসি পোস্টিং নিয়েছেন টাকা দিয়ে। অনেকে মন্ত্রীর পিএস থাকা অবস্থায় পুরস্কার হিসাবে ডিসি হয়েছেন। এছাড়া বিগত সরকারের সময় ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের সময় যারা নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন তাদের কাউকে ছাড়া যাবে না। জনগণের বড় আমানত ভোট চুরির দায়ে প্রত্যেককে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। রাজউক, সিটি করপোরেশন, ওয়াসাসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে পোস্টিং পাওয়া দলবাজদের ধরতে হবে। প্রশাসনের ২০ ব্যাচের কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম ছয় বছরের বেশি সময় কিভাবে রাজউকে প্রাইজপোস্টিং নিয়ে চাকরি করলেন, কারা তাকে এতদিন সেখানে বসিয়ে ঘুসের ভাগ নিয়েছেন তাদেরও চিহ্নিত করতে হবে। এরকম শত নুরুল ইসলাম রয়েছেন প্রশাসনে।

এদিকে যেসব কর্মকর্তা দফায় দফায় পদোন্নতিবঞ্চিত অবস্থায় চোখের পানিতে চাকরি থেকে অবসরে গেছেন তাদের আক্ষেপ ও ক্ষোভ সবচেয়ে বেশি। এরকম ভুক্তভোগীদের মধ্যে কয়েকজন যুগান্তরকে বলেন, তারা এখন ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিসহ চাকরিতে ফিরতে চান। উপদেষ্টা পরিষদে তারা দাবি জানিয়েছেন, যাদেরকে চাকরি করার শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা আছে এবং অধিকতর দক্ষ ও মেধাবী বলে সবার কাছে সুপরিচিত তাদের সরকার প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়োগ দিয়ে কাজে লাগাতে পারে। তাহলে তাদের ক্ষোভ ও কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হতে পারে।

তারা আরও বলেন, এ ধরনের সরকার দায়িত্ব নিয়ে দ্রুত শুদ্ধি অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বিলম্ব হলে জনগণের মধ্যে নতুন করে হতাশা ও নানা সন্দেহ দানাবেঁধে উঠবে। এ সুযোগে ষড়যন্ত্রকারীরা নতুন করে ফিরে আসার চেষ্টা করবে। এজন্য প্রশাসনসংশ্লিষ্ট সব সেক্টরে দ্রুত সাঁড়াশি অভিযান চালানোর দাবি জানিয়েছেন প্রশাসনে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের ভুক্তভোগী কর্মকর্তারা।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম