Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

জাতির উদ্দেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূস

ভুলের কারণে এ বিজয় যেন হাতছাড়া না হয়

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, এনডিটিভি ও দ্য ইকোনমিস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকার: সরকারের ওপর দ্রুত আস্থা ফিরিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ * বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা হলে প্রতিবেশীরাও বিপদে পড়বে * দ্বিতীয়বার মুক্ত বাংলাদেশ, সুযোগ হেলায় হারানো উচিত নয়

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভুলের কারণে এ বিজয় যেন হাতছাড়া না হয়

ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত ড. মুহাম্মদ ইউনূস নতুন এই বিজয়ের সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার নিশ্চিতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। সতর্কবাণী উচ্চারণ করে নোবেলজয়ী ইউনূস বলেন, আমাদের কোনো প্রকার ভুলের কারণে এই বিজয় যেন হাতছাড়া হয়ে না যায়। আমি সবাইকে বর্তমান পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে এবং সব ধরনের সহিংসতা এবং স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। মঙ্গলবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে মনোনীত করার সময় চিকিৎসার জন্য তিনি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে বুধবার দুপুরে ইউনূস সেন্টারের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় ড. ইউনূস এই আহবান জানিয়েছেন। প্যারিস থেকে দেশে ফেরার আগে জনগণের উদ্দেশে তিনি এই বার্তাটি দেন। আজ দুপুরে তার দেশে ফেরার কথা। রাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেওয়ার কথা।

দেশের আপামর জনসাধারণকে অভিনন্দন জানিয়ে ড. ইউনূস বলেছেন, যারা আমাদের দ্বিতীয় বিজয় দিবসকে বাস্তবে রূপ দিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অভিনন্দন জানাই। অভিনন্দন জানাই দেশের আপামর জনসাধারণকে, যারা ছাত্রদের এই আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। ছাত্র-দলমত নির্বিশেষে সবাইকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমাদের প্রিয় এই সুন্দর ও বিপুল সম্ভাবনাপূর্ণ দেশটিকে আমাদের নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রক্ষা করা এবং একে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই এখন আমাদের প্রধান কাজ। একটি নতুন পৃথিবী বিনির্মাণে আমাদের তরুণরা প্রস্তুত। অকারণে সহিংসতা করে সুযোগটি আমরা হারাতে পারি না। সব ধরনের সহিংসতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে ইউনূস বলেছেন, সহিংসতা আমাদের সবারই শত্রু। অনুগ্রহ করে শত্রু সৃষ্টি করবেন না। সবাই শান্ত থাকুন এবং দেশ পুনর্গঠনে এগিয়ে আসুন। অনুগ্রহ করে নিজে শান্ত থাকুন এবং আপনার আশপাশের সবাইকে শান্ত থাকতে সহায়তা করুন।

এদিকে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ড. ইউনূস বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো-

সরকারের ওপর দ্রুত আস্থা ফিরিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ-ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে ড. ইউনূস : সরকারের ওপর দ্রুত আস্থা ফিরিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেছেন, দেশ পুনর্গঠনে আমরা একসঙ্গে কীভাবে কাজ করতে পারি, সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব দলের সঙ্গে কথা বলব। এই অর্থনীতিবিদ বলেন, নতুন নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত হতে কাজ করা দরকার। দেশে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যও একটি রূপরেখা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা হলে প্রতিবেশীরাও বিপদে পড়বে-এনডিটিভিকে ইউনূস : বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা আইনশৃঙ্খলা। এ নিয়ে আপনি কী ভাবছেন? তিনি বলেন, অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এটা তো কিছুটা ভেঙে পড়ছেই। এখন আমাদের একটা উদযাপনের সময় চলছে, যেমনটা ১৯৭১ সালের পর হয়েছিল। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। সবাই স্বাধীনতা উদযাপন করছে। শেষ পর্যন্ত আমরা সব রকম ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়েছি। আমরা এটা উপভোগ করছি। নতুন যুগের সূচনা হয়েছে।

শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ভাঙা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর জন্য শেখ হাসিনাকে দায়ী করুন। তিনি জাতিকে সেদিকে নিয়ে গেছেন, তার পিতার ইমেজ নষ্ট করেছেন। তিনি পুরো দেশের জন্য এমন তিক্ত কিছুই করে গেছেন যে, তারা (আন্দোলনকারীরা) এটা করতেও কিছু মনে করছে না। পুরো দায় এই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর যিনি পুরো দেশকে এই পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করিয়েছেন। ড. ইউনূসকে প্রশ্ন করা হয় বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিতিশীলতা কি আশপাশের দেশগুলোতেও প্রভাব ফেলতে পারে কি না? আপনি কী মনে করেন? তিনি এর জবাবে বলেন, অবশ্যই। এই কথাটাই আমি গত কয়েক দিনের প্রতিটা সাক্ষাৎকারে বলেছি। যদি বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে তবে এটা মিয়ানমার, সেভেন সিস্টারস, পশ্চিমবঙ্গসহ বাংলাদেশের চারদিকে ছড়িয়ে যাবে। সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে। তিনি বলেন, যদি বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ না থাকে, তবে আশপাশের কেউই থাকতে পারবে না। বাংলাদেশ যদি বিপদে থাকে, সবাই বিপদে পড়বে। এটা ১৭ কোটি মানুষের দেশ, যার দুই-তৃতীয়াংশই তরুণ। আপনাকে অবশ্যই এমন কিছু করতে হবে যাতে তরুণরা খুশি থাকে। গণতন্ত্র অবশ্যই থাকতে হবে। এই তরুণরা তাদের জীবনে ভোট দিতে পারেনি। যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তারা ভোট দিতে যায়নি। কারণ তারা জানে, এটা তো নির্বাচন নয়। এটাই তো পরিস্থিতি। তিনি বলেন, অবশ্যই আমাদের তরুণদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। অবশ্যই গণতন্ত্র থাকতে হবে এবং তাদের এই গণতন্ত্রের অংশ বানাতে হবে।

ইউনূসই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বিকল্প-ভারতের বিশেষজ্ঞরা : বাংলাদেশে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভারতের সাবেক কূটনীতিক, সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ড. ইউনূসই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বিকল্প। খবর ডয়চে ভেলের। ওপি জিন্দল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা আছে। ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি হলেন অ্যাসপিরেশনাল ব্যক্তিত্ব, তাকে দেখে তারা উদ্বুদ্ধ হয়।

শ্রীরাধার মতে, ইউনূসকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছেন শেখ হাসিনা। ভারতের সঙ্গে হাসিনা ও আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিতে ড. ইউনূসই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বিকল্প।

সাবেক আইপিএস অফিসার শান্তনু মুখোপাধ্যায় একসময় বাংলাদেশে ছিলেন। এই সুরক্ষা বিশেষজ্ঞও ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ড. ইউনূসই সবচেয়ে ভালো বিকল্প।

শান্তনু মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ড. ইউনূস পশ্চিমা দেশের কাছে গ্রহণযোগ্য। ছাত্ররাও তাকে চাইছে। সেনার কাছেও তিনি গ্রহণযোগ্য। তিনি ব্যালান্স করে চলতে পারবেন। তিনি বলেছেন, তবে ড. ইউনূসের সামনে সবচেয়ে বড় কাজ হলো সহিংসতা বন্ধ করা। সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা।

প্রবীণ সাংবাদিক জয়ন্ত রায় চৌধুরীও মনে করেন, ‘ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেছেন, ‘ড. ইউনূসই বর্তমান পরিস্থিতিতে সেরা বিকল্প। তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও দেশের ভেতরে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ভারতের কাছেও তিনি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। এদিকে বাংলাদেশ নিয়ে ভবিষ্যৎ চিন্তাভাবনা এবং দেশকে এগিয়ে নিতে নানা কর্মপন্থা নিয়ে লন্ডনের দ্য ইকোনমিস্টে নিবন্ধ লিখেছেন ড. ইউনূস।

দ্বিতীয়বার মুক্ত বাংলাদেশ, সুযোগ হেলায় হারানো উচিত নয়- দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল পশ্চাৎগামী। আসুন, আমরা ৫ আগস্ট যে দ্বিতীয় মুক্তির স্বাদ পেয়েছি, আজ তার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি ইতিবাচক ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করি। যারা আমাদের এই গুরুত্বপূর্ণ নতুন বিজয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের মধ্য থেকে নতুন প্রজন্মের তরুণ নেতাদের এগিয়ে আসা উচিত। জাতির জন্য তাদের শক্তি ও স্বপ্ন নতুন সুযোগ সৃষ্টির জন্য এই আন্দোলনে জীবন উৎসর্গকারীদের আত্মত্যাগকে মহিমান্বিত করতে পারে। এমন সুযোগ আমাদের হেলায় হারানো উচিত নয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তীব্র চাপের মুখে সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। এরপর দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান তিনি। বিলুপ্ত হয় মন্ত্রিসভা। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানান, অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করা হবে। পরদিন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনী প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বৈঠকে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম