প্রার্থীপ্রতি সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা
প্রশ্নফাঁস ৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার
মোহাম্মদপুরের এক বাসায় রাতভর প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করানো হয় * প্রশ্নফাঁসের কলঙ্ক মুছতে চায় পিএসসি
ইকবাল হাসান ফরিদ
প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ৪৬তম বিসিএস-এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। তবে ফাঁসের ধরন ভিন্ন। প্রার্থীর কাছে প্রশ্ন দেওয়া হয়নি।
মোহাম্মদপুরের একটি বাড়িতে রাতভর প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করিয়ে সকালে পরীক্ষার হলে পাঠানো হয়েছে। এজন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা। প্রার্থীরা হলে গিয়ে রাতে মুখস্থ প্রশ্নের সঙ্গে হুবহু মিল পেয়েছেন। পিএসসির গ্রেফতার কর্মকর্তা এবং কিছু পরীক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে সিআইডি এ তথ্য পেয়েছে।
এদিকে প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন-পিএসসি। প্রশ্নফাঁস কলঙ্কের দাগ মুছতে চায় তারা। এদিকে ফাঁসচক্রে আরও কোনো কর্মকর্তা এবং প্রশ্ন প্রণয়নকারীদের কেউ জড়িত কি না, এ বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একাধিক ইউনিট অনুসন্ধানে নেমেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশ্ন প্রণয়নকারী এবং কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া পিএসসি থেকে প্রশ্ন ফাঁস হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না। ড্রাইভার কিংবা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী যারা চক্রে আছে, তাদের বেশির ভাগই প্রার্থী সংগ্রহকারী এবং প্রশ্নপত্র সরবরাহকারী।
তবে চক্রে যারা জড়িত, তাদের কেউই ছাড় পাবেন না। সিআইডির মামলায় সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিলসহ পলাতক ১৪ জনকে ধরতে অভিযান অব্যাহত।
অন্যদিকে তদন্তে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। এ অবস্থায় ফেঁসে যেতে পারেন যে কেউ-এমন শঙ্কায় পিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে ভয় ও অস্বস্তি বিরাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২৬ এপ্রিল ৪৬তম বিসিএস-এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়। পিএসসির অধীনে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ এ পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয় বলে প্রমাণ মিলেছে। তবে প্রশ্নফাঁসকারীরা অনেক চতুর। তারা প্রশ্নপত্র প্রার্থীদের হাতে দেয়নি। পরীক্ষার আগের রাতে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে প্রশ্ন এবং উত্তরসহ মুখস্থ করিয়ে পরীক্ষা দেওয়াতেন।
পিএসসির কর্মচারী সাজেদুল ইসলাম সাজুর কাছ থেকে ৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান।
নাটোরের বাসিন্দা মাহমুদুল সম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্যামেরা পারসন হিসাবে কাজ শুরু করেছেন। তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, পিএসসির কর্মচারী সাজেদুল ইসলাম এক লাখ টাকার বিনিময়ে তাকে মোহাম্মদপুরের একটি বাসায় নিয়ে ২০০ নম্বরের এমসিকিউ প্রশ্ন দেন। ওইটা পড়ে পরীক্ষার হলে গিয়ে মাহমুদুল দেখতে পান সব কমন পড়েছে।
রুবেল নামে আরেক প্রার্থী জানান, দুই লাখ টাকা চুক্তিতে পরীক্ষার আগের রাতে তাকেও মোহাম্মদপুরের ওই বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সারা রাত প্রশ্ন মুখস্থ করে সকালে গিয়ে তিনি পরীক্ষা দেন। ওই বাসায় তার মতো আরও অনেক পরীক্ষার্থী ছিলেন। তাদের কাছ থেকেও বিভিন্ন অঙ্কের টাকা নিয়ে প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করানো হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কলঙ্কমোচনে যতটুকু শুদ্ধি অভিযান সম্ভব, এর পুরোটাই করা হবে। এ লক্ষ্যে সিআইডির পাশাপাশি পিএসসির গঠন করা তদন্ত কমিটিও কাজ করছে। কর্মচারী থেকে কর্মকর্তা পর্যায়ের সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত আছে। নানান কৌশলে চলছে তদন্তকাজ।
প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে প্রশ্ন প্রণয়নকারীদের কারও যোগসাজশ থাকতে পারে। তাদেরও খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। এ লক্ষ্যে গাড়িচালক থেকে শুরু করে প্রশ্ন প্রণয়নকারীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সন্দেহে রেখে তদন্তকাজ চালাচ্ছে কমিটি।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। যারা কারাগারে রয়েছেন, তাদের প্রয়োজনে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
পিএসসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ঘটনা যে ঘটে না তা নয়, ঘটছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। এজন্য যতটুকুর প্রমাণ পাওয়া যাবে, ততটুকুর বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, যুগ্মসচিব ড. আব্দুল আলীমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির কাজ চলমান। প্রয়োজন হলে তারা সিআইডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পর গ্রেফতার কর্মকর্তাদের সঙ্গে জেলগেটে কথা বলবে। বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিক যারা প্রতিবেদন করেছেন, তাদের মধ্যে যাদের প্রয়োজন মনে হবে, তাদের সঙ্গে কথা বলবে তদন্ত কমিটি।
৮ জুলাই সিআইডির হাতে ১৭ জন গ্রেফতার হওয়ার পর পল্টন থানায় একটি মামলা হয়। ওই ঘটনায় পিএসসির ছয় কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ গ্রেফতার ব্যক্তিরা কারাগারে। গা-ঢাকা দিয়ে আছেন মামলার আসামি সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিলসহ আরও ১৪ জন। এছাড়া অজ্ঞাত আরও ৬০ জনকে শনাক্তে তদন্ত অব্যাহত রেখেছে সিআইডিসহ আইন-প্রয়োগকারী একাধিক সংস্থা।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে। মামলায় পলাতক আসামিদের গ্রেফতারেও অভিযান অব্যাহত আছে।
রিটের শুনানি আজ : পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষা বাতিলসহ বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে দায়ের করা রিটের শুনানি হবে আজ। বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে রিটটি শুনানির জন্য কার্যতালিকার ৩৭ নম্বরে রয়েছে।
বৃহস্পতিবার সারডা সোসাইটি নামে বেসরকারি একটি সংগঠনের পক্ষে এর নির্বাহী পরিচালক আরিফুর রহমান মুরাদ ভূঁইয়া হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিটটি দায়ের করেন। রিটে পিএসসির চেয়ারম্যান, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ও রেল সচিবকে বিবাদী করা হয়েছে।
প্রশ্নফাঁসচক্রের আ.লীগ নেতা বহিষ্কার : লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, পিএসসির প্রশ্নফাঁস ও চাকরি বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মিজানুর রহমানকে শনিবার তার পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।