সওজ প্রকৌশলী জাহাঙ্গীরের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট
৮২ হিসাবে লেনদেন ১৩৮ কোটি টাকা
আয়কর বিবরণীতে ৪ কোটি ১০ লাখ টাকার নিট সম্পদ দেখালেও এফডিআর আছে ৩০ কোটি টাকার * ১০ বছরে বেতন মাত্র ৯৮ লাখ, এ সময়ে অবৈধ আয়ের কোটি কোটি টাকা লেনদেন করেন ৭৭ এফডিআরসহ ৮২ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে
মাহবুব আলম লাবলু
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম যেন ‘টাকার মেশিন’। মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সড়ক উন্নয়ন অংশের প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) দায়িত্বের পর এই কর্মকর্তার অর্থ-সম্পদও বাড়ছে বিদ্যুৎগতিতে। গত ১০ বছরে তিনি বেতন পেয়েছেন মাত্র ৯৮ লাখ টাকা। অথচ তার নামে ৭৭ এফডিআরসহ ৮২ ব্যাংক হিসাবে লেনদেন করেছেন ১৩৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। তার এই বিপুল অর্থ লেনদেন ধরা পড়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্তে।
জানা গেছে, নিজস্ব পদ্ধতিতে একটি ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক অর্থ লেনদেনের সতর্ক সংকেত পায় বিএফআইইউ। এরপর ওই হিসাবের সূত্র ধরে তদন্তে নামার পরই বেরিয়ে আসে ‘থলের বিড়াল’। সামনে আসে প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলমের পরিচয়। একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে তার হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের চিত্র দেখে হতবাক স্বাধীন আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পর প্রতিবেদন তৈরি করে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে উল্লিখিত তথ্য জানা গেছে।
সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় পাঠানো বিএফআইইউর প্রতিবেদন হাতে পেয়েছেন এই প্রতিবেদক। প্রতিবেদনে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্তের তাগিদ দেওয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, তিনি (জাহাঙ্গীর আলম) বাংলাদেশের প্রচলিত আইন, বিধিবিধান ও নিয়মাবলী লঙ্ঘন করে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছেন। এ অর্থ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা, স্থানান্তর ও ব্যক্তিগত সম্পদে রূপান্তরের বিষয়টি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ২(শ)(১) ধারা মোতাবেক ‘দুর্নীতি ও ঘুস’ মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ। একই সঙ্গে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ আয়কর বিবরণীতে প্রদর্শন না করে কর ফাঁকির বিষয়টি একই আইনের ২(শ)(১৯) ধারা মোতাবেক মানি লন্ডারিং সম্পৃক্ত ‘কর সংক্রান্ত অপরাধ’। উল্লিখিত অপরাধের বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধান ও তদন্তপূর্বক আইনি ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘যখন প্রতিরোধ করার সুযোগ ছিল তখন করা হয়নি। দেরিতে হলেও বিএফআইইউ যেহেতু এটা চিহ্নিত করেছে এখন দুদকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার সুযোগ হয়েছে। এখানে কয়েকটি উপাদান আছে, একটি হচ্ছে-তার বৈধ আয়ে এ ধরনের সম্পদ বা অর্থের মালিকানা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। এতএব এখানে পরিষ্কারভাবেই দুদক আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী দুর্নীতি হয়েছে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে-তিনি এসব অর্থ সম্পদ আয়কর রিটার্নে উল্লেখ না করে প্রতারণা করেছেন। অর্থাৎ তিনি নিজেই নিজের অপরাধ স্বীকার করেছেন। কারণ তিনি যে অর্থ সম্পদ অর্জন করেছেন তা যেহেতু বৈধ নয়, তাই তিনি আয়কর রিটার্নেও দেখাননি। এখানে বহুবিধ দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে। তবে এটা যেন বিএফআইইউর প্রতিবেদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে।’
জানা গেছে, জাহাঙ্গীর আলম বিভিন্ন সময়ে ঠাকুরগাঁও, গোপালগঞ্জ ও রাজশাহীতে কর্মরত ছিলেন। এখন তিনি মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সড়ক উন্নয়ন অংশের পিডি। ব্যাংক বিবরণীর হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে প্রকল্প পরিচালক হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তার নামে বেতন ভাতা বাবদ জমা হয়েছে ৯৮ লাখ টাকা। অথচ, তার নামে ৭৭টি এফডিআরসহ মোট ৮২ আমানত হিসাবে (৫টি সঞ্চয়ী ও ৭৭টি স্থায়ী আমানত) লেনদেন হয়েছে ১৩৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাহাঙ্গীর আলম সরকারের দায়িত্বশীল পদে কর্মরত। দুর্নীতির মাধ্যমে তার অবৈধ আয়ের অর্থ এসব ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হতে পারে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ৭৭টি স্থায়ী আমানত হিসাবে এখনো ৩০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জমা থাকলেও তিনি আয়কর বিবরণীতে মাত্র ৪ কোটি ১০ লাখ টাকার নিট সম্পদ প্রদর্শন করেছেন। এতে আয়কর ফাঁকির মাধ্যমে তিনি অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মালিক হয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়। ব্যাংক হিসাবে দেখা যায়, ২০১২ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত হিসাবগুলোতে ৮৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা জমা এবং ৫৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা তোলা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকের ৭ অ্যাকাউন্টে জমা আছে ৩০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।
জানা গেছে, ২০১২ সালের ২১ নভেম্বর ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি বসুন্ধরা শাখায় একটা সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন জাহাঙ্গীর আলম। বিভিন্ন সময় এই হিসাবে ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা জমা হওয়ার পর সব টাকাই তুলে নেওয়া হয়েছে। তিনি গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসির করপোরেট শাখায় আরেকটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর। এই হিসাবে বিভিন্ন সময় ১২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা জমা করার পর তা তুলে নেন। ২০২১, ২০২৩, ২০২৪ সালে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি গুলশান করপোরেট শাখায় ১৮টি এফডিআর এবং একটি সঞ্চয়ী হিসাব খুলে জমা করেন ৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। সমপরিমাণ টাকা এখনও এসব হিসাবে জমা আছে। ২০১২ সালে জাহাঙ্গীর আলম আরেকটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন ন্যাশনাল ব্যাংক পিএলসি প্রগতি সরণি শাখায়। এই হিসাবে ৩৮ কোটি টাকা জমা করা হয়। তুলে নেওয়া হয়েছে ৩৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ২০২৩, ২০২৪ সালে ১১টি এফডিআর এবং ডিপিএস হিসাব খুলে ৮ কোটি ৮ লাখ টাকা জমা করা হয়। সমপরিমাণ টাকা এখনও জমা আছে। ২০২৪ সালের জুন-জুলাইয়ে আইডিএলসি ফিন্যান্স পিএলসি উত্তরা শাখায় ৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকার ১৭টি এফডিআর করেন তিনি। এসব টাকা এখনও স্থিতি আছে। ২০২৩, ২০২৪ সালে ১৩ কোটি ৮ লাখ টাকার ৩১টি এফডিআর করেছেন ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স পিএলসি গুলশান শাখা এবং প্রিন্সিপাল শাখায়। এগুলো এখনও স্থিতি আছে। ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্র্যন্ত সোনালী ব্যাংকের রাজশাহী, গোপালগঞ্জ, ঠাকুরগাঁ এবং ঢাকার বারিধারা শাখায় খোলা হিসাবে ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা জমা করে তা তুলে নেন জাহাঙ্গীর আলম। এসব হিসাবে তিনি মোট ১৩৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা লেনদেন করেন। জমা থাকা ৩০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জব্দ করেছে বিএফআইইউ।
দীর্ঘদিন দুদকের আইনজীবী হিসাবে কাজ করে আসছেন খুরশীদ আলম খান। একজন সরকারি কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে এত বিপুল অর্থের লেনদেনকে বিস্ময়কর বলে মন্তব্য করেন সুপ্রিমকোর্টের এই সিনিয়র আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘বিএফআইইউ এ ধরনের তদন্ত প্রতিবেদন করে থাকলে দায়িত্বশীল সংস্থার উচিত তা আমলে নিয়ে তদন্ত করা। তদন্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অর্থ উপার্জনে অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়লে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। বিএফআইইউ এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরি করে থাকলে তারা নিশ্চয়ই খোঁজ নিয়েই করেছে।’
জানা গেছে, যেসব কারণে অধিকতর তদন্তের তাগিদ দিয়েছে বিএফআইইউ তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৩০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জমা থাকার বাইরে জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী সন্তানের নামে অন্যান্য অবৈধ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ থাকতে পারে বলে ধারণা, যা উদ্ঘাটন করা প্রয়োজন। চাকরির বেতন-ভাতা ব্যতীত বৈধ অন্য কোনো আয়ের উৎস না থাকা সত্ত্বেও ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের আয়কর রিটার্নে জাহাঙ্গীর আলমের ৪ কোটি ১০ লাখ টাকার নিট সম্পদ থাকা অস্বাভাবিক মর্মে এর উৎস চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এছাড়াও তিনি কর ফাঁকির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন, এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। এছাড়া তার ব্যাংক হিসাবে ১৩৮ কোটি টাকা লেনদেন ও এফডিআরের ৩০ কোটি টাকার উৎস দুর্নীতি কিনা তা যাচাই করা দরকার।
জানতে চাইলে মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সড়ক উন্নয়ন অংশের প্রকল্প পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘বিএফআইইউর আমাকে নিয়ে এ ধরনের প্রতিবেদনের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। এটা হয়ে থাকলে তারা (বিএফআইইউ) নিশ্চয়ই কোথাও ভুল করেছে। আমার এত অর্থ নেই। এত অর্থ থাকলে আর চাকরিই করতাম না। আমার এত অর্থ থাকার তথ্য ঠিক না। ফলে এ নিয়ে আমার আর কিছু বলারও নেই।’