কর্মেই চিরকাল বেঁচে থাকবেন নুরুল ইসলাম
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একজন নুরুল ইসলাম। সাহসের বাতিঘর। একাত্তরের রণাঙ্গনের প্রথম সারির বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। এসব পরিচয় ছাড়িয়ে তিনি দেশের অর্থনীতির সফল আইকন। শিল্পের এ মহানায়কের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ২০২০ সালের এই দিনে (১৩ জুলাই) চিরবিদায় নেন। পরের দিন ১৪ জুলাই গভীর শোক, বিনম্র শ্রদ্ধা এবং হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় (গার্ড অব অনার) রাজধানীর বনানী কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
নিজের মেধা, সততা, পরিশ্রম ও সাহসিকতার সঙ্গে একে একে ৪২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন আপসহীন এই কর্মবীর। দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ এ কণ্ঠস্বর আজীবন নির্দ্বিধায় ‘কালোকে কালো ও সাদাকে সাদা’ বলে গেছেন। গত ৪ বছরে শিল্প খাতে তার শূন্যতা গভীরভাবে উপলব্ধি করছে দেশ। কর্মই চিরকাল তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। অপ্রতিরোধ্য এই উদ্যোক্তার মৃত্যুতে দেশের সর্বস্তরে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে, তিন মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তার স্ত্রী মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান। ছেলে শামীম ইসলাম যমুনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিন মেয়ে-সোনিয়া সারিয়াত, মনিকা নাজনীন ইসলাম এবং সুমাইয়া রোজালিন ইসলাম যমুনা গ্রুপের গ্রুপ পরিচালক। জন্ম নিলে মৃত্যু নিশ্চিত-এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম সত্য। কিন্তু কিছু মানুষের মৃত্যু যেন একটি বিপ্লবকে থামিয়ে দেয়। ব্যক্তি যখন একটি ‘ইনস্টিটিউশন’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তার মৃত্যু হাজারো মানুষের স্বপ্নকে করে দেয় ক্ষতবিক্ষত। তেমনই এক সিংহপুরুষ ছিলেন নুরুল ইসলাম। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এ উদ্যোক্তার কাছে স্বপ্ন এসে ধরা দিত। তিনি স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারতেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি বিপ্লব যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। তবে তার রেখে যাওয়া যাবতীয় কাজ অত্যন্ত সুনিপুণভাবে এগিয়ে নিচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম। তিনি শিল্প খাতের একটি বিপ্লবের নাম। একজীবনে হাতভরে দেশকে শুধু দিয়েই গেছেন। যৌবনে অস্ত্র হাতে ১৯৭১ সালে দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন রণাঙ্গনের প্রথম সারির এই যোদ্ধা। আর স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শুরু করেন নতুন যুদ্ধ। এ যেন অবিরাম পথচলা। মেধা, সততা, পরিশ্রম ও সাহসিকতার সঙ্গে একে একে ৪২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন আপসহীন এই কর্মবীর। তার মালিকানাধীন যমুনা ফিউচার পার্ক এশিয়ার সবচেয়ে বড় শপিংমল। এছাড়া যমুনা ইলেকট্রনিক্স, যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশনের মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ তালিকায়। সৃষ্টি করেছেন অর্ধলক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান। দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ এ কণ্ঠস্বর আজীবন নির্দ্বিধায় ‘কালোকে কালো ও সাদাকে সাদা’ বলে গেছেন। রক্তচক্ষুর ভয়ে নীতি থেকে কখনো একচুলও পিছপা হননি। দেশকে নিয়ে বিশাল স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণের আগেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন তিনি। আর সাহসী কর্মই শিল্পের এ মহানায়ককে অমর করে রেখেছে।
২০২০ সালের ১৪ জুন নুরুল ইসলামের করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। ওইদিনই তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। করোনায় তার কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশিষ্ট এ শিল্পোদ্যোক্তার চিকিৎসায় এভারকেয়ারে ১০ সদস্যবিশিষ্ট মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। এর বাইরে চীনের ৪ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের দুজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহতায়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে ‘না ফেরার দেশে’ পাড়ি জমান আজীবন সংগ্রামী মানুষটি।
জন্ম ও পারিবারিক জীবন : নুরুল ইসলাম ১৯৪৬ সালের ৩ মে ঢাকার নবাবগঞ্জের চুড়াইন ইউনিয়নের কামারখোলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আমজাদ হোসেন এবং মাতা জোমিলা খাতুন। বিশিষ্ট শিল্পপতি নুরুল ইসলাম যেমন দেশকে ভালোবাসতেন, তেমনই ভালোবাসতেন জন্মদাত্রী জননীকেও। স্রষ্টা তাকে মায়ের প্রতি সেই ভালোবাসার প্রতিদানও দিয়েছেন অকুণ্ঠ হস্তে। দেশের শিল্প খাতে মহিরুহ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
কর্মজীবন : তিনি যে শিল্পই গড়ে তুলতে চেয়েছেন, সেখানেই সফল হয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত দূরদর্শী ছিলেন। দেখতেন অনেক বড় স্বপ্ন। ব্যবসায়িক জীবনে অত্যন্ত সফল মানুষটি উদ্যোক্তা হয়ে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির চিন্তা লালন করতেন। শিক্ষাজীবনে এসব স্বপ্নের কথা শেয়ার করতেন সহপাঠীদের সঙ্গে। তবে কর্মজীবনের শুরুতে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। এর মধ্যেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দেশমাতৃকাকে রক্ষায় অস্ত্র হাতে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধু যখন সবাইকে দেশগড়ার কাজে আত্মনিয়োগের আহ্বান জানালেন, সেই ডাকে সাড়া দিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম মাতৃভূমির রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যেমন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তেমনই যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে দেশমাতৃকার অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য গভীর দেশপ্রেম নিয়ে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন তার শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। শেষ বয়সে এসেও অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন তিনি। সপ্তাহে ৭ দিন অফিস করতেন ‘কাজপ্রেমিক’ এ মানুষটি।
শিল্প খাতে একটি বিপ্লবের নাম নুরুল ইসলাম : দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মানুষের কর্মসংস্থান তৈরিতে নুরুল ইসলাম একজন আধুনিক চিন্তার সাহসী উদ্যোক্তা। স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাতের আলোচিত ও উজ্জ্বল মুখ তিনি। ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন যমুনা গ্রুপ। তারপর সব বাধা উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছেন শিল্প খাতের এই আপসহীন উদ্যোক্তা। এশিয়ার সর্ববৃহৎ শপিংমল যমুনা ফিউচার পার্ক, যমুনা ইলেকট্রনিক্স, যমুনা ডিস্টিলারি, বস্ত্র, ওভেন গার্মেন্টস, রাসায়নিক, চামড়া, বেভারেজ, টয়লেট্রিজ, মোটরসাইকেল এবং আবাসন খাতে ব্যবসাসহ যেখানেই হাত দিয়েছেন, সেখানেই সফলতার স্বর্ণশিখরে পৌঁছেছেন এ কর্মবীর। যমুনা গ্রুপে বর্তমানে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ কাজ করছেন। এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো শিল্প ও সেবা খাতে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। অন্যান্য শিল্পের পাশাপাশি দেশের গণমাধ্যমেও তিনি বিশাল বিনিয়োগ করেছেন। দুদশক আগে প্রতিষ্ঠা করেন পাঠকপ্রিয় দৈনিক যুগান্তর। এছাড়া বাংলাদেশে বিশ্বমানের একটি টিভি চ্যানেল তৈরি করা ছিল তার বিশাল এক স্বপ্ন। তা বাস্তবায়নে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন যমুনা টেলিভিশন। নুরুল ইসলাম মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন বাংলাদেশ স্বাবলম্বী হবে, মাথা তুলে দাঁড়াবে। শুরু থেকেই তার আগ্রহের পুরোটাই ছিল ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। তাই যমুনা ফ্যান, অ্যারোমেটিক সাবান এবং পেগাসাস কেডসের মতো জনপ্রিয় বাংলাদেশি ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন তিনি। শুধু গার্মেন্টস বা ডেনিম নয়, উৎপাদনে নানা বৈচিত্র্য এনেছিলেন এই স্বপ্নসারথি। গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন ফ্রিজ ও মোটরসাইকেলসহ নানা প্রয়োজনীয় সামগ্রী। পণ্যের মানের ব্যাপারে কখনো আপস করতেন না। সব সময় বলতেন, যে পণ্যই তিনি বানাবেন, সেটি হতে হবে নাম্বার ওয়ান। গুণগত মানের কারণে যিনি একবার ব্যবহার করবেন, তিনি পণ্যের সুনাম ছড়াবেন।
পরিচ্ছন্ন ব্যবসায়ী : ব্যক্তিগত জীবনে নুরুল ইসলাম ছিলেন একজন পরিচ্ছন্ন ব্যবসায়ী। তার সব অর্থ, মেধা ও পরিশ্রম দেশেই বিনিয়োগ করেছেন। খেলাপি ঋণ এবং বিদেশে টাকা পাচারের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোনো ব্যাংকে তার এক টাকাও খেলাপি ঋণ ছিল না। বিদেশে টাকা পাচারের কোনো অভিযোগ নেই তার বিরুদ্ধে। এ কারণে তার মালিকানাধীন দুটি গণমাধ্যম দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টিভি খেলাপি ঋণ ও টাকা পাচারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সংবাদ প্রচার করেছে।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী কণ্ঠস্বর : জীবনে কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। নির্দ্বিধায় ‘কালোকে কালো ও সাদাকে সাদা’ বলেছেন। এজন্য তাকে মূল্যও দিতে হয়েছে। কিন্তু পিছপা হননি আপসহীন এই যোদ্ধা। নিশ্চিত ঝুঁকি জেনেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীর কর্মসূচি : অভিভাবকের মৃত্যুবার্ষিকী ও তার স্মৃতিকে আরও অম্লান করে রাখতে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে যুগান্তর ও যমুনা পরিবার। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল ৭টায় যুগান্তরে পবিত্র কুরআন খতম, সকাল ৯টায় বনানী কবরস্থানে কবর জিয়ারত, বেলা ১১টায় যুগান্তরে প্রয়াত চেয়ারম্যান মহোদয়ের ম্যুরালে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং বেলা ১২টায় যুগান্তরে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল। এছাড়া সারা দেশে যুগান্তর এবং পত্রিকাটির পাঠক ফোরাম ‘স্বজন সমাবেশ’ জেলা ও উপজেলায় স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে।