বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম
দূরদর্শী-সফল এক সাহসী কর্মবীর
সালমা ইসলাম
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
করোনা আমার স্বামীকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে-দেখতে দেখতে ৪টি বছর চলে গেল। তিনি (নুরুল ইসলাম) নেই, এটি কখনোই ভাবতে পারি না। জগতের নিয়মে তিনি আমাদের কাছ থেকে দূরে চলে গেলেও যমুনা পরিবার ও দেশবাসীর মন তিনি (নুরুল ইসলাম) এমনভাবে জয় করেছেন যে, আমাদের সবার ভাবনায় তিনি সব সময় বেঁচে আছেন। তীব্র শোকে অনেকেই দিশেহারা হন। আমার স্বামীকে হারিয়ে আমিও দিশেহারা হয়েছিলাম। এক সময় মনে হয়েছে, তিনি তো আমাদের সামনে কর্মময় জীবনের ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা অনুসরণ করলে হয়তো শোকের তীব্রতা কিছুটা কমবে। বাস্তবেও হয়েছে তা-ই। তার অসম্পূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন করার চেষ্টা করায় শোকের তীব্রতা কিছুটা কমেছে। তার স্মৃতি আমাদের অনন্ত প্রেরণার উৎস। সব সময় মনে হয়, তিনি আমার পাশে আছেন, সঙ্গেই আছেন। তার সঙ্গে এত স্মৃতি-কোন বিষয় আগে বলব, ভেবে পাচ্ছি না। মাতৃভূমিকে তিনি এত ভালোবেসেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি ও তার সঙ্গীরা পাক বাহিনীর সদস্যদের হাতে ধরা পড়ে যান। এরপর তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন করা হয়। তিনি যে বেঁচে ফিরবেন সে আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। নির্যাতনের একপর্যায়ে শত্রুরা তাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সময় পাকিস্তান আর্মির এক কর্মকর্তা চিনতে পেরে সেদিন তাকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনেন। আল্লাহর অশেষ রহমত-আমার স্বামী আমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন। হানাদার বাহিনী তার ওপর এমনভাবে নির্যাতন চালিয়েছিল যে, চিকিৎসকদের বহু প্রচেষ্টার পর আস্তে আস্তে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। তার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি অনেক ঘটনাবহুল, যা নিয়ে একটি বই লেখা যাবে। সুস্থ হওয়ার পর তিনি আমার শ্বশুরের ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হন। জীবনে তিনি কোনোদিন অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, তারপরও তিনি সত্য প্রকাশে ছিলেন অবিচল।
আমরা লক্ষ করছি, দেশে ডলার সংকটের কারণে আরও নানা সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সংকটের এ সময়ে আমার স্বামীর বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যগুলো মনে পড়ছে। আমরা লক্ষ করছি, ডলার সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানিনির্ভর শিল্পগুলো সংকটে পড়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তারা। কারণ তাদের অনেকে নির্ভর করেন যেসব ব্যবসায়ী বাণিজ্যিকভাবে কাঁচামাল আমদানি করেন তাদের ওপর। বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থানীয় পর্যায়ে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে না পারায় উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে, নতুন কর্মসংস্থানেও এর প্রভাব পড়েছে। বস্তুত দেশের শিল্প খাতকে সাম্প্রতিক সময়ে এক ধরনের বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। সবার প্রত্যাশা, এ পরিস্থিতি থেকে দ্রুতই উত্তরণ ঘটবে। এ সংকট আমাদের যে বার্তা দিয়েছে তা হচ্ছে, আমরা যদি বিভিন্ন খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে না পারি, তাহলে যে কোনো সময় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে নতুন নতুন সংকট দেখা দিতে পারে। আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে বিভিন্ন খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কাজটি সহজ নয়। যেসব উদ্যোক্তা দেশের রপ্তানি খাতকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, যমুনা গ্রুপের স্বপ্নদ্রষ্টা তাদের অন্যতম।
আমার স্বামী ব্যবসাকে সেবা হিসাবে দেখতেন। যে ব্যবসা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখে, তিনি তেমন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হতে বেশি পছন্দ করতেন। তিনি বলতেন, অতিরিক্ত আমদানিনির্ভরতা দেশের অর্থনীতিতে নানা ঝুঁকি সৃষ্টি করে। তিনি বলতেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে যত দ্রুত সম্ভব আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা দরকার। তিনি কথার চেয়ে কাজকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। এ কারণেই তার পক্ষে একের পর এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। নিরন্তর পরিশ্রম করে তিনি সাফল্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। দেশের স্বার্থকে তিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে বিবেচনা করতেন। আমাদের দুর্ভাগ্য নুরুল ইসলাম তার সব স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করার আগেই করোনা তাকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিল। সবার উদ্দেশে বলব, নুরুল ইসলামের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে আসুন সবাই তার মতোই নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করি; পরের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিই।
আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকার বিকল্প নেই। বিশ্বে বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) প্রভাব বাড়ছে। আগামী দিনে এআইয়ের প্রভাব আরও তীব্র হবে এটি এখন স্পষ্ট। মানুষ যাতে জীবনব্যাপী শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রেরণা পায়, তা নিশ্চিত করতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি যমুনা গ্রুপের স্বপ্নদ্রষ্টা নুরুল ইসলাম যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। উন্নত দেশগুলোতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি উন্নত মানবিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ সমাজ গড়ার প্রচেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। উন্নত মানবিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ সমাজ গড়ার পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে যমুনা গ্রুপের স্বপ্নদ্রষ্টা মিডিয়ায় বিনিয়োগ করেছেন। মিডিয়া এমন এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা সব বয়সি মানুষকে জীবনব্যাপী শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি সব সময় অভয় দিয়ে বলতেন, সত্য প্রকাশে কখনো পিছপা হওয়া যাবে না। যত বাধা আসুক না কেন, সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতেই হবে।
২
যমুনা গ্রুপের স্বপ্নদ্রষ্টা কত দূরদর্শী ছিলেন তার একটি নিদর্শন যমুনা ফিউচার পার্ক। এক ছাতার নিচে সবকিছু নিয়ে এলে উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি ভোক্তারা উপকৃত হন। এ দৃষ্টান্ত অন্য খাতেও কাজে লাগানো যেতে পারে। যমুনা ফিউচার পার্ক দেশে-বিদেশে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করেছে। তার প্রতিষ্ঠিত হবিগঞ্জের শিল্প পার্কটিও ইতোমধ্যে দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। মানুষের কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে তিনি একটার পর একটা নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মতো কঠিন কাজ শুরু করতেন। সিঙ্গাপুরের চেয়েও উন্নতমানের হাসপাতাল করার স্বপ্নও ছিল তার। আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই করোনা তাকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে।
কাজের মধ্যে ডুবে থেকে তিনি প্রকৃত আনন্দ খুঁজে পেতেন। তবে সবকিছু ছিল তার গোছাল। যখন যে কাজটা করতেন, তা শতভাগ মনোযোগ দিয়েই করতেন। তার ‘সময় জ্ঞান’ ছিল প্রবাদতুল্য। তিনি কোথাও কোনো মিটিং কিংবা কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্টে গেলে নির্ধারিত সময়ের অন্তত ১৫ মিনিট আগে উপস্থিত হতেন। রাস্তার যানজট হিসাব করে সেভাবেই বের হতেন। তিনি সবার আগে অফিসে আসতেন এবং অফিস ত্যাগ করতেন সবার পরে। হয়তো মাঝেমধ্যে বিশেষ কারণে ব্যতিক্রম হতো। ছুটি কিংবা ছুটির দিন বলে তার কাছে কোনো শব্দ ছিল না। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার ভোরে তিনি সড়কপথেই ছুটে যেতেন যমুনা গ্রুপের কোনো না কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। পণ্যের গুণগত মানেও সারা জীবন এক নম্বর থাকতে চেয়েছেন। কীভাবে তার পণ্যসামগ্রী সব পরীক্ষায় সেরা হবে, এটি ছিল তার লক্ষ্য।
ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য ব্যস্ত সময় পার করলেও পরিবারের প্রতিটি কাজকেই তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। তার একটি বিশেষ গুণ ছিল, অফিসের কোনো বিষয় তিনি বাসায় আনতেন না। খাবার টেবিলে পরিবারের সবার মধ্যে পিকনিক মুডে অন্যরকম আড্ডা হতো, যা হয়তো আর কোনোদিন সেভাবে ফিরে আসবে না। তবে আমাদের সন্তানদের তিনি শুধু উচ্চশিক্ষিতই করেননি, আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে সব চেষ্টা করেছেন। নুরুল ইসলামের মতো এমন একজন কীর্তিমান মানুষকে স্বামী হিসাবে পেয়ে আমি গর্বিত, আমি ধন্য। ব্যবসা-বাণিজ্য বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন, কিন্তু কখনোই ঋণখেলাপি হননি তিনি। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন। কখনো দেশের বাইরে টাকা পাচারের কথা ভাবতেও পারতেন না। সব সময় চেষ্টা করতেন দেশে কী করে নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়। আমাদের সৌভাগ্য, তিনি তার প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের যেভাবে চলতে বলেছেন, সবাই তার দিকনির্দেশনা মতোই চলছেন।
৩.
কঠিন বিপদের মধ্যেও তিনি এতটুকু ধৈর্য হারাতেন না। দীর্ঘ পথচলায় গ্রুপের ওপর যতবার বড় কোনো বিপদ কিংবা সংকট এসেছে, তিনি দক্ষ অধিনায়কের মতো নেতৃত্ব দিয়েছেন। কোনো বিপর্যয় হলে তাকে সান্ত্বনা দিতে হতো না। বরং উলটো তিনি আমাদের বোঝাতেন। বলতেন, চিন্তা করো না, আবার নতুন করে হবে, হয়তো এর চেয়ে ভালো হবে। আজ তার চলে যাওয়ার ৪ বছর পূর্তির দিনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে আমাদের চাওয়া-আল্লাহ যেন নুরুল ইসলামকে জান্নাত নসিব করেন। আমিন। আমরা যারা বেঁচে আছি, সবাই যেন নুরুল ইসলাম সাহেবের সব ভালো গুণ ধরে রাখতে পারি, আমাদের সে চেষ্টা করা উচিত।
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম : চেয়ারম্যান, যমুনা গ্রুপ
জাতীয় সংসদ-সদস্য; সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী