এমপি আনার হত্যা
আরও কয়েকজন ডিবির নজরদারিতে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ-সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আরও অন্তত সাতজন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে। তারা আনার হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনের ঘনিষ্ঠ। রাজধানীর গুলশানে আনারের ফ্ল্যাটে তাদের অবাধ যাতায়াত ছিল। আনার হত্যার আগে পরে তারা ওই ফ্ল্যাটে একাধিকবার বৈঠক করেছে বলে ধারণা ডিবির। শাহীনের গুলশানের বাসায় নিরাপত্তা প্রহরীদের কাছে থাকা নিবন্ধন খাতা সূত্রে তাদের নাম ও ফোন নম্বর সংগ্রহ করেছে ডিবি। যে কোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের ডাকা হতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে কলকাতায় আনার হত্যার সব আয়োজন সম্পন্ন করে মাস্টারমাইন্ড শাহীন ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসেন। দেশে এসে ওঠেন গুলশান দুই নম্বরের ৬৫ নম্বর রোডের ১৭ নম্বর হাউজের দ্বিতীয় তলার বি-১ ফ্ল্যাটে। আনার নিখোঁজের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর শাহীন বুঝতে পারেন তিনি গ্রেফতার হতে পারেন। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়ার আগে গত ২০ মে রাতে গুলশানের বাসা ছেড়ে বান্ধবী চেলসি চেরী ওরফে আরিয়াকে নিয়ে রাজধানীর একটি হোটেলে রাত কাটান। শাহীনের গুলশানের বাসা ছাড়ার একটি ভিডিও ফুটেজ এসেছে যুগান্তরের হাতে। সেখানে দেখা গেছে, ২০ মে রাত ১টা ২৫ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডের দিকে গুলশানের ফ্ল্যাটের ফটকের সামনে পায়চারি করছেন শাহীন। এ সময় তাকে বিষণ্ন দেখাচ্ছিল। প্রায় এক মিনিট পায়চারি করার পর ফ্ল্যাট থেকে বের হতে দেখা যায় শাহীনের বান্ধবী আরিয়াকে। তার সঙ্গে ছিল বাসার কাজের ছেলেও। এ সময় আরিয়ার হাতে ট্রলি ও ভ্যানেটি ব্যাগ দেখা গেছে। ডিবি সূত্র বলছে, তারা ওই রাতে একটি হোটেলে থাকে। পরদিন ভারত-নেপাল ও দুবাই হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায় শাহীন। আর বান্ধবী আরিয়া চলে যান তার বাসায়। রাজধানীর মধ্য বাড্ডার বাসিন্দা এই আরিয়া এর আগে শাহীনের সঙ্গে ভারতেও গিয়েছিলেন। আদালতের মাধ্যমে আরিয়ার ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখার অনুমতি পেয়েছে ডিবি। আরিয়াকে এর আগে ডিবি জিজ্ঞাসাবাদও করেছে।
আনার হত্যা মামলার তদন্ত প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে বলে জানিয়েছে ডিবি। এ মামলায় কোনো ধরনের চাপ নেই এবং অহেতুক কাউকে হয়রানি করা হবে না বলেও জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
রোববার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ের কনফারেন্স রুমে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এ মামলায় কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হয়রানি করা হবে না এবং কাউকে অযথা ডাকাডাকি করা হবে না। সুস্পষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা যাকে প্রয়োজন মনে করবে তাকে আদালতের অনুমতি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, আমরা মনে করি গ্যাস বাবুর মোবাইলে অনেক ডিজিটাল এভিডেন্স আছে। ইতোমধ্যে আমরা অপর পক্ষের মোবাইলের ডিজিটাল এভিডেন্স পেয়েছি। গ্যাস বাবুর মোবাইলে আরও কোনো ডিজিটাল এভিডেন্স আছে কি না তা জানতে মোবাইল উদ্ধারে অভিযান চালানো হবে। গ্যাস বাবুকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমরা আদালতের অনুমতি চেয়েছি। অনুমতি পেলে তাকে নিয়ে সশরীরে অভিযান চালাব এবং ওই জায়গাগুলোতে নিয়ে আলামতগুলো (মোবাইল) উদ্ধারের চেষ্টা করব।
এমপি আনার হত্যা মামলায় গ্রেফতার ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর রিমান্ড শেষ হওয়ার আগে তাকে কারাগারে পাঠানোর পেছনে কোনো চাপ ছিল কি না জানতে চাইলে ডিএমপির ডিবি প্রধান বলেন, এখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় হয়নি। তদন্তকারী কর্মকর্তা কাউকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করে তখন তার সেটিসফেকশনের ওপর নির্ভর করে। তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি মনে করে রিমান্ডে তার যা যা জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার সেটা জিজ্ঞাসাবাদ হয়ে গেছে, সে ক্ষেত্রে আদালতের মাধ্যমে আসামিকে জেলহাজতে পাঠাতে পারেন। তবে আবার যদি বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে তদন্তকারী কর্মকর্তা মনে করেন ওই আসামিকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন তখন তিনি জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ পেতে পারেন।
মিন্টুকে গ্রেফতারের পর থেকে ডিবি কোনো চাপে আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর আগেও মতিঝিলের টিপু হত্যা, কামরাঙ্গীচরের শিল্পপতি হত্যা, ফারদিন হত্যাকাণ্ডসহ অনেক হত্যাকাণ্ড ঢাকা শহরে ঘটেছে। ডিবির চৌকশ টিম তদন্ত করে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের মোটিভ বের করেছে। বাংলাদেশের একজন সংসদ-সদস্য কলকাতার মাটিতে খুন হয়েছেন। সেই হত্যাকাণ্ডের ক্লু বের করতে ডিবি পুলিশের টিম রাত-দিন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের টিম নেপালে গিয়েছে এবং আমাদের তথ্যের ভিত্তিতে নেপালে সিয়াম গ্রেফতার হয়েছে। এছাড়া কলকাতায় গিয়েও আমরা বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছি আলামত উদ্ধারে। এই হত্যাকাণ্ডের মূল কিলার শিমুল ভুঁইয়াসহ আরও অনেককে আমরা গ্রেফতার করেছি। এর মধ্যে চারজন আসামি বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আমরা যদি চাপ অনুভব করতাম তাহলে আমাদের এত অ্যাচিভমেন্ট হতো না এই মামলায়। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন কোনো চাপ নেই এই মামলার তদন্তকাজে। আমাদের প্রতি নির্দেশ হচ্ছে নিরপেক্ষভাবে মামলাটি তদন্ত করা। ডিবির চৌকশ টিম নিরপেক্ষভাবে এ মামলার তদন্তকাজ করছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা রাতদিন পরিশ্রম করছে। আরও যে আসামি আছে তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছে।
মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কোনো অগ্রগতি আছে কি না জানতে চাইলে হারুন অর রশীদ বলেন, মামলার তদন্তকাজ অনেকটা চূড়ান্ত পর্যায়ে, আমরা অনেককে গ্রেফতার করেছি। কিছু কিছু নাম আমরা পেয়েছি তাদেরও গ্রেফতারে চেষ্টা করছি। এ ঘটনার মাস্টারমাইন্ড শাহীন যুক্তরাষ্ট্রে আছে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের একটা বন্দিবিনিময় চুক্তি আছে সেহেতু আমরা ভারতীয় পুলিশকে বলেছি যেন তাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে আমরা টিম নিয়ে গিয়ে কথা বলেছি। এ ছাড়া পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি শাখার মাধ্যমে আমরা ইন্টারপোলে চিঠি দিয়েছি তার বিষয়ে। শাহীনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা সবাই কাজ করছি। আরও এক-দুজন আসামি বাকি রয়েছে তাদেরকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছি। আশা করছি অতি দ্রুতই মামলাটি নিষ্পত্তির দিকে যেতে পারব।
এমপি আনারের মেয়ে ডরিন ডিএনএ নমুনা দেওয়ার জন্য কলকাতায় যাওয়ার কথা রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হারুন বলেন, ভারতীয় পুলিশ দূতাবাসের মাধ্যমে ডরিনকে জানিয়েছে ভারতে যাওয়ার জন্য। ডরিনের সঙ্গে আমারও কথা হয়েছে। ডরিন জানিয়েছে কয়েক দিন ধরে তিনি জ্বরে ভুগছেন। তার স্বাস্থ্য ভালো হলে মনে হয় শিগগিরই ভারতে যাবেন।
উল্লেখ্য, এমপি আনার ১২ মে ভারতে যান। পরদিন ১৩ মে কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন তিনি। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে ২২ মে। ওইদিন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় আনারের মেয়ে ডরিন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করেন। এ ছাড়া ভারতে একটি হত্যা মামলা হয়।
কালীগঞ্জে প্রতিবাদ সমাবেশ : কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি জানান, এমপি আনার হত্যার প্রতিবাদে রোববার বিকালে শহরের মেইন বাসস্ট্যান্ডে উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশের আয়োজনে সমাবেশ হয়েছে। সমাবেশে এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন এই হত্যার ঘটনায় আটক ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছেন।
ডরিন বলেন, আমি কাউকে ইঙ্গিত করে কখনো কথা বলিনি। কাউকে ফাঁসানোর জন্য কোথাও কিছু বলিনি। তদন্তকারী সংস্থা তদন্ত করে যার সংশ্লিষ্টতা পাচ্ছে, তাকেই আটক করছে। তবে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু ৮ দিনের রিমান্ড হওয়া সত্ত্বেও তিনদিনের মাথায় কারাগারে কেন চলে গেলেন-এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।
তিনি বলেন, আমার বাবা হত্যার শিকার হয়েছেন। স্বর্ণ চোরাচালানের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমার বাবার ইমেজ ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। আমি চাই সুষ্ঠু তদন্ত হয়ে এর বিচার হবে এবং যারা জড়িত, আওয়ামী লীগে তাদের জায়গা দেবে না।
উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিদ্দিকী ঠান্ডুর সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য দেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শিবলী নোমানী, মেয়র আশরাফুল আলম, ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুজ্জামান রাসেলসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা।