প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
ঘোষিত পদক্ষেপে লক্ষ্য অর্জন নিয়ে শঙ্কা
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। নতুন অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের ঘরে মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনতে প্রস্তাবিত (২০২৪-২৫) বাজেটে তিনটি পদক্ষেপের ঘোষণা দেন তিনি। এগুলো হচ্ছে-ঘাটতি বাজেট কমিয়ে আনা, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ এবং সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি অব্যাহত রাখা। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি ধরে প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা দিয়েছেন। চলতি বাজেটে ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
অবশ্য মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা প্রসঙ্গে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, ‘ব্যয়ের চাপ কমাতে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার কমিয়ে রাখা হয়েছে। এর প্রভাব পড়বে বাজারে। আশা করি এ বছরের শেষদিকে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। তিনি বলেন, সংকট পার হয়ে আসছি, অর্থনীতি এখন ডায়নামিক মডেলে চলছে।’
অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজেটের ঘাটতির অঙ্ক কম রাখা গেলে সরকারকে ঋণ কম করতে হয় এবং বাজারে অর্থ সরবরাহ কমে। আর মুদ্রার সরবরাহ টেনে ধরলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। প্রস্তাবিত বাজেটের ঘাটতি ধরা হয় জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ, টাকার হিসাবে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেট ঘাটতির হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হলেও সংশোধিত বাজেটে কাটছাঁট করে ৪ দশমিক ৭ শতাংশে আনা হয়।
বাজেট ঘাটতির বাইরে আরও যে দুটি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ঘোষণা দেওয়া হয় সেগুলো হচ্ছে-সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি। এ দুটি পদক্ষেপ অনেক আগেই নেওয়া হয়েছে। বিগত দুটি বাজেটে চাহিদার রশি টেনে ধরা এবং সরবরাহ বাড়ানো দিকে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়। পাশাপাশি ব্যয় হ্রাস, কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় নিরুৎসাহিত করতে কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি পালন করা হয়। কিন্তু মূল্যস্ফীতি অনমনীয় ভাবে ৯ শতাংশের উপরে বিরাজ করছে। সর্বশেষ এপ্রিলের মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই।
অর্থনীতিবিদদের মতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাদের মতে প্রস্তাবিত বাজেটের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল মূল্যস্ফীতি কমিয়ে এনে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া। কিন্তু সে পদক্ষেপ খুব বেশি নেই। বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা বিশাল চ্যালেঞ্জের। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতেই হবে। না হলে সাধারণ মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তি বাড়বে। এক্ষেত্রে সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি আরও শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন। জানতে চাইলে বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে জানান, প্রস্তাবিত বাজেটে ঘোষিত পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নামিয়ে আনা কঠিন হবে। কারণ যে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো বহু আগে থেকে নেওয়া হয়। প্রায় এক বছর আগেই সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হয়েছে। ওই সময় বাজেটে কৃচ্ছ্রসাধন কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু কোনো প্রভাব দেখছি না, মূল্যস্ফীতি কমেনি। মনিটরিংয়ের মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থাপনায় উন্নতির চেষ্টা করা হয়েছে। ভোজ্যতেল ও চিনিসহ কিছু পণ্যের ওপর ডিউটি প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু এতে মূল্য কমেনি যদিও বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের মূল্য কমছে। ফলে নতুন অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে না। তিনি মূল্যস্ফীতি কমাতে নিত্যপণ্য বিশেষ করে চাল ডাল তেল লবণ মরিচ পেঁয়াজ ও বাসাভাড়া ভর্তুকি দেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ ভর্তুকির অর্থ রাজস্ব আদায় বাড়িয়ে ভর্তুকি টাকা দিতে হবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশে দাপটের সঙ্গে মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এর পেছনে তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছে অর্থ বিভাগ। এর প্রথমটি হচ্ছে বাজারে সরবরাহ জনিত ত্রুটি, দ্বিতীয় হচ্ছে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। অর্থ বিভাগের হিসাবে গত মে পর্যন্ত টাকার অবমূল্যায়ন হার হচ্ছে ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আর সর্বশেষ হচ্ছে আমদানিজনিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব।
জানা গেছে, এপ্রিলের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি কমে ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশে নেমে আসছে। পার্শ^বর্তী দেশ ভারতে সেটি ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশে নেমে আসছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবল (আইএমএফ) হিসাবে ২০২৭ সালে বৈশ্বিক গড় মূল্যস্ফীতি কমে ৩ দশমিক ৯ শতাংশে আসবে। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি কমে আসার সাম্প্রতিক প্রবণতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের উপরে বিরাজ করছে।
জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক ও মূল্য হ্রাসের কারণে অনেক দেশে পর্যায়ক্রমে নেমে আসে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি উলটো আরও বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশে নেওয়া হয়। যদিও বিবিএসের হিসাবে এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরি যুগান্তরকে জানান, প্রস্তাবিত বাজেটে নেওয়া পদক্ষেপগুলো হচ্ছে এক ধরনের সহযোগী পদক্ষেপ। তবে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি মিলে সমন্বিত না হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এখন পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতে হবে। সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করছে সেটি যেন উৎপাদনজনিত কার্যক্রম ব্যাহত না হয়। এছাড়া বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা কাটাতে হবে, যাতে উৎপাদিত ও আমদানি পণ্য যাতে সঠিকভাবে বাজারে আসতে পারে।
প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি কমিয়ে মূল্যস্ফীতির কথা বলা হয়েছে। সরকার যদি আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করে তাহলে ঘাটতি হবে। আর ঘাটতি মেটাতে ঋণ করতে হয় ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া মানে টাকা ছাপিয়ে দেওয়া। তবে ঘাটতি কম হলে ঋণ কম গ্রহণ এবং অর্থ সরবরাহ কমে আসবে। আর সেটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে।
জানা গেছে, এর আগেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয় নানা পদক্ষেপ। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হয়। এর অংশ হিসাবে ব্যাংক ঋণের সুদহার উল্লেখযোগ্য বাড়ানো হয়। এছাড়া নীতি সুদহার করিডরের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি ১০ শতাংশ এবং নিম্নসীমা ৭ শতাংশ উন্নীত করে সংস্কার করা হয়। এছাড়া মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলায় ফ্যামিলি কার্ড এবং ওএমএস কর্মসূচি পরিচালনা করা হচ্ছে।