সুদহার বাজারভিত্তিক করার প্রভাব
এক মাসের ব্যবধানে বৃদ্ধি ২-৪ শতাংশ
সুদের হার ও ডলারের দাম বৃদ্ধিতে ব্যবসা খরচ বাড়বে, পণ্যের দাম ও চাপ বাড়বে ভোক্তার ওপর * গত জুলাই থেকে মে পর্যন্ত সুদহার বাড়ানো হলেও মূল্যস্ফীতির হার কমেনি, বেড়েছে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ব্যাংকগুলো তারল্য সংকট মোকাবিলায় আমানতের সুদের হার বাড়াচ্ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঋণের সুদের হারও। বিশেষ করে গত ৮ মে থেকে এ হার বাজারভিত্তিক করার পর থেকে ব্যাংকগুলোতে সুদহার বাড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এক মাসের ব্যবধানে সুদহার বেড়েছে গড়ে ২ থেকে ৩ শতাংশ। কোনো কোনো ব্যাংকে ৪ শতাংশও বেড়েছে। এর মধ্যে ঋণের সুদের হার বেশির ভাগ ব্যাংকেই ১৩ থেকে ১৬ শতাংশ। তবে কোনো কোনো ব্যাংক ১৭ শতাংশে উঠেছে। আমানতের সুদহার বেশির ভাগ ব্যাংকেই ৯ শতাংশ। তবে কোনো কোনো ব্যাংকে এ হার বেড়ে ১২ শতাংশে উঠেছে। কিছু দুর্বল ব্যাংক আরও বেশি সুদের আমানত নিচ্ছে।
সুদের হার বাড়ানোর বিষয়ে ব্যাংকগুলো থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যেসব প্রতিবেদন পাঠানো হচ্ছে সেগুলো সমন্বয় করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ওই প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে ঋণের সুদহার বেশি মাত্রায় বৃদ্ধির ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পণ্যের ওপর। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। বিশেষ করে আমদানি পণ্য ও শিল্প পণ্যের দামে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া আমানতের সুদের হার দুর্বল ব্যাংকগুলো বেশি মাত্রায় বাড়িয়েছে। ফলে সবল ব্যাংকগুলোও আমানতের সুদের হার বাড়াতে চাপে পড়েছে। এ অবস্থায় অনেকেই বলেছেন, সুদের হার বৃদ্ধি বাজারভিত্তিক হলেও একটি নীতিমালা থাকা উচিত, যার ভিত্তিতে এটি ওঠানামা করবে। এদিকে মূল্যস্ফীতির হার কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়াচ্ছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার কমছে না। গত বছরের জুলাই থেকে সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। অথচ ওই সময় থেকে এখন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার কমেনি। বরং আরও বেড়েছে। গত জুনে ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। গত মে মাসে তা বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ওই সময়ে এ হার কিছুটা ওঠানামা করেছে। কিন্তু গড়ে সাড়ে ৯ শতাংশের নিচে নামেনি।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, শুধু সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির হার কমানো যাবে না। এ হার কমাতে হলে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। আগে যেসব ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়া হয়েছে সেগুলোর একটি বড় অংশ তুলে নিতে হবে। ঋণের সুদ হার বাড়িয়ে বাজারে টাকার প্রবাহ খুব বেশি কমানো যায় না। টাকার প্রবাহ কমাতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে টাকা ছাপানো বন্ধ করতে হবে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল করতে হবে। ডলারের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির হারও বাড়বে। বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে। কারণ ভর মৌসুমেও পণ্যের দাম বাড়ছে।
সূত্র জানায়, গত ৮ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি সার্কুলার জারি করে সুদের হার নির্ধারণের ব্যাপারে করিডোর প্রথা তুলে নেয়। একই সঙ্গে সুদের হারকে বাজারভিত্তিক করার ঘোষণা দেয়। এরপর থেকে ব্যাংকগুলো নিজস্ব ঋণ বিতরণযোগ্য তহবিল ও চাহিদার ভিত্তিতে সুদের হার নির্ধারণ করছে। গত ১ জুন থেকে অনেক ব্যাংকই নতুন সুদের হার কার্যকর করেছে।
গত ৮ মের আগে সুদের হার নির্ধারিত হতো সরকারের ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হারের ভিত্তিতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি মাসে ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ঘোষণা করত। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো ভিত্তি সুদ যোগ করে ঋণের সুদ নির্ধারণ করত। গত এপ্রিলে সর্বশেষ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ট্রেজারি বিলের সুদহার ঘোষণা করেছে। ওই সময়ে সাধারণ ঋণের সঙ্গে ৩ শতাংশ, ভোক্তা ঋণের সঙ্গে আরও ১ শতাংশ সার্ভিস চার্জসহ মোট ৪ শতাংশ, রপ্তানি খাতের প্রি-শিপমেন্ট ঋণ, কৃষি ও পল্লী ঋণের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ যোগ করে সুদ হার নির্ধারণ হতো। ফলে ওই সময় সাধারণ ঋণের সুদ ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ, পল্লী ও কৃষি ঋণের সুদ ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ, প্রি-শিপমেন্ট ঋণের সুদ ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশে ও ভোক্তা ঋণের সুদ ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশে ওঠে।
মাত্র এক মাসের ব্যবধানে বিভিন্ন খাতে ঋণের সুদহার ২ থেকে ৩ শতাংশ বেড়েছে। কোনো কোনো ব্যাংকে ৪ শতাংশও বেড়েছে। ইতোমধ্যে একটি ব্যাংকে ভোক্তা ঋণের সুদ বেড়ে সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশে উঠেছে। ওই ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করছে ১২ শতাংশের বেশি সুদে।
ব্যাংকগুলোতে গড়ে সাধারণ ঋণের সুদ বেড়ে ১৪ থেকে ১৬ শতাংশে উঠেছে। রপ্তানি ঋণের সুদ সাড়ে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ। কৃষি ও পল্লী ঋণের সুদ সাড়ে ১২ থেকে ১৪ শতাংশে উঠেছে। শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণের সুদ বেড়ে ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ। আমদানি ঋণের সুদ বেড়ে সাড়ে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ।
সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভোক্তা ঋণের সুদ। আগে এ হার ছিল ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এখন তা বেড়ে হয়েছে সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ। তবে বেশির ভাগ ব্যাংকে এ হার ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ। তবে এ ঋণের বিপরীতে বিভিন্ন ব্যাংক এজেন্ট ফি, নিরাপত্তা ফি ও অন্যান্য ফি বাবদ প্রায় ২ থেকে ৩ শতাংশ আরও অতিরিক্ত আদায় করছে। ফলে এ খাতের ঋণের সুদ বেড়ে ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ দাঁড়াচ্ছে।
এদিকে আমানতের সুদহারও বেড়েছে। আগে আমানতের সুদহার সর্বোচ্চ ৭ থেকে ৮ শতাংশ ছিল এখন তা বেড়ে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশে উঠেছে। তবে ভালো ব্যাংকগুলোতে এ হার এখনও ৯ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোতে বেড়ে ১২ শতাংশে উঠেছে। কোনো কোনো দুর্বল ব্যাংক আরও বেশি সুদে আমানত নিচ্ছে। এক্ষেত্রে ওইসব ব্যাংক তিন মাস মেয়াদে চুক্তিতে আমানত নিচ্ছে।
সুদের হার বাজারভিত্তিক করার পর আমানতের ঋণের সুদের হার বেশি বাড়ছে। এতে আমানতকারীরা কম সুদ পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে ঋণের সুদ বেশি দিয়ে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন। ব্যবসায়ীরা বেশি সুদ দিলে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়ে এর দাম বেড়ে যায়। ফলে এর চাপ পড়ে ভোক্তার ওপর। এতে মূল্যস্ফীতির হার আরও বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
এদিকে ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানিসহ সব খাতে ব্যয় বেড়েছে। সুদের হার বাড়ায় ব্যয় আরও এক দফা বাড়বে। এতে ব্যবসা খরচ বেড়ে গিয়ে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। ফলে ভোক্তার ওপর চাপ আরও বাড়বে। এতে মূল্যস্ফীতির হারও বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। গত মাসে ডলারের দামে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর পর এক লাফে এর দাম ১১০ টাকা থেকে ১১৮ টাকায় উঠেছে। তবে ওই দামে ডলার মিলছে না। আমদানিতে ডলার কিনতে হচ্ছে ১২৩ থেকে ১২৫ টাকা করে। কোনো কোনো ব্যাংক আরও বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে।