সিপিডির সেমিনারে বক্তারা
ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না
প্রকৃত খেলাপি সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৪ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সিপিডির সংবাদ সম্মেলন
দেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকেও বাড়ছে। অথচ ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য যে আইনি কাঠামো দরকার, সেটা বাংলাদেশে নেই। ঋণখেলাপির মামলাগুলো সহজে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। কারণ সেখানে যথেষ্ট বিচারক নেই। ব্যাংক খাতে সুশাসন, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নেই বললেই চলে। এরই মধ্যে ব্যাংক খাতে তথ্য সংগ্রহের দরজা বন্ধ করা হয়েছে। এ খাত পুনর্গঠনে একটি স্বাধীন ব্যাংক কমিশন গঠনের কোনো বিকল্প নেই। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সামনে কী অপেক্ষা করছে’ শীর্ষক সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমীন, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান, সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা প্রমুখ।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে রিয়েল টাইম তথ্য দেওয়া হয়। অথচ এখানে সেটা নিশ্চিত না করে উলটো তথ্য সংগ্রহের দরজা বন্ধ করা হয়েছে। ঋণ অনুমোদন, পুনঃতফশিল, অবলোপন সবই নিজেদের মতো করে করা হচ্ছে। ব্যাংক খাতের সুশাসন ফেরাতে, নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বাংলাদেশ ব্যাংক) নিজে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। বাংলাদেশে ব্যাংকের বাইরেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় রয়েছে। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করার কথা, সেটা করছে না বা পারছে না। ব্যাংকগুলোর সব তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ পাচ্ছে না। যারা প্রকাশ করে না, তারা লক্ষ্য পূরণ করতে পারে না। যতটুকু প্রকাশিত হয়, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ থাকে। আর একটি বিষয় হচ্ছে তথ্যের দরজা ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া। আমরা তথ্যের জন্য মিডিয়ার ওপর নির্ভর করতাম, সেটাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তথ্যের অভাবের কারণে ভুল নীতি গৃহীত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য ফেরাতে স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কোনো বিকল্প নেই।
খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে ড. ফাহমিদা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে। এ অর্থনীতির আকারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিনিয়োগ ও সাধারণ মানুষদের লেনদেনের জন্য আর্থিক খাতের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা শুধু ব্যাংকিং খাত নিয়ে আলোচনা করি, নন-ব্যাংকিং খাতের সমস্যাও কম নয়। ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্যের অন্যতম মূল নিয়ামক হচ্ছে খেলাপি ঋণ। সেটার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ব্যাংকিং পারফরম্যান্স বিষয়টি বিদেশিরা পর্যবেক্ষণ করে থাকে। তারা সময় সময় এ বিষয়ে রেটিং করে থাকে। সর্বশেষ বিদেশিরা তাদের আউটলুক রেটিং আরও কমিয়ে দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ২০১২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ৪২ হাজার ৭১৫ থেকে বেড়ে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা হয়েছে। এর বাইরে অনেক ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া প্রতিবেদন অনুসারে, পুনঃতফশিল ঋণসহ খারাপ ঋণ যদি যোগ করা হয় তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। যা বড় অঙ্ক। এছাড়াও খারাপ ঋণ রয়েছে। বর্তমানে অর্থ ঋণ আদালতে ৭২ হাজার ৫৪৩টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে, যেখানে অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ যোগ করলে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৫৬ হাজার ২০৯ কোটি টাকা।
অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি একটি ভোগাস আইডিয়া। এটা কেন গঠন করবেন, খরচ কে দেবে? গভর্নরকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন, ১০টা ব্যাংক দুর্বল হয়ে গেছে আপনি কেন বলবেন? হঠাৎ তো দুর্বল হয়নি। এতদিন কোথায় ছিলেন? অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করে খেলাপি কমানোর কথা বলছেন, কিন্তু যারা ব্যাংক খাতে লুটপাট করেছে তাদের তো কিছুই বলছেন না। তিনি বলেন, ব্যাংক খাত থেকে মূল্যবোধ ও বিশ্বাস হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই ব্যবসায়ীদের খেলাপি বানাচ্ছে। কারণ ৬ মাসের মধ্যে ঋণের সুদহার ৯ থেকে ১৪ শতাংশে উঠে গেছে। এখন এই টাকা কে দেবে? ব্যবসায়ীরা কি চুরি করে আনবে? আবার বলা হচ্ছে বিদেশি মুদ্রায় আমানত রাখলে নাকি ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দেওয়া হবে। গতকাল একটা বিজ্ঞাপনে দেখলাম। এই টাকা ব্যাংক কার পকেট থেকে দেবে? এমনিতেই ডলার সংকট। বাংলাদেশে কি সোনার খনি আছে যেখানে বিনিয়োগ করলে ৯ শতাংশ মুনাফা হয়?
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, তথ্য প্রবাহে বাধা, সাম্প্রতিক সময়ে এটা এসেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তথ্যের অবাধ প্রবাহে বিশ্বাসী। কিছু আইনগত বিষয়ে কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখা যেতে পারে। কিন্তু একেবারে ঢুকতে দেব না। এটা ঠিক না। নতুন করে ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে সরকারকে সাবধান হতে হবে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক চর্চা। যারা সংসদে কিংবা সংসদের বাইরে আছেন, আমাদের কিছু কিছু জাতীয় বিষয়ে ঐকমত্য থাকা দরকার। যে দলই হোক না কেন অর্থনৈতিক বিষয়ে ঐকমত্য হওয়ার দরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সিদ্ধান্তের জন্য ব্যবসায়ী ডাকে, রাজনীতিবিদকে ডাকে। সকালে সিদ্ধান্ত নেয় বিকালে পরিবর্তন করে। অবস্থা এমন যে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সমবায় সমিতিতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, এখন ব্যবসার মতোই খেলাপি ঋণ মডেলে পরিণত হয়েছে। সুশাসনের অভাবে রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক কারণে এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমীন বলেন, খুব কঠিন সময়ে শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এটাই বুদ্ধিমানের কাজ। ব্যাংক খাতে তেমন কোনো দূরদর্শী সিদ্ধান্ত দেখিনি। কোনো ঘটনা ঘটে গেলে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আগে নেওয়া হয় না। গত ৫০ বছরে আমরা ব্যাংকগুলোর জার্নি ম্যাপ তৈরি করতে পারিনি। আমাদের ব্যাংকগুলো কিভাবে চলবে। কতগুলো ব্যাংককে লাইসেন্স দেব বা কোন সেক্টরে কিভাবে দেব।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যাংক খাতকে এই অবস্থা থেকে যদি টেনে তুলতে হয়, তাহলে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে হবে না।
রাজনীতিবিদ ড. জাহেদুর রহমান বলেন, সমস্যা ক্যানসারের মতো চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে। আর্থিক খাত এখন অলিগর্কদের দখলে। ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা মিলে একটি নেক্সাস (বলয়) বানিয়েছে। এই নেক্সাসের কথায় ঋণ দেওয়া হয়, ব্যাংক চলে। দুর্নীতি বন্ধ করতে যদি সরকার চায়, তাহলে হবে, না হলে কখনোই হবে না।