শিমুল ভূঁইয়ার বাড়ির সবাই পলাতক
দক্ষিণাঞ্চলের মূর্তিমান আতঙ্ক ফুলতলার ভূঁইয়া পরিবার
খুলনা ব্যুরো
প্রকাশ: ২৪ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমানুল্লাহ সাঈদ থেকে শিমুল ভূঁইয়া
ভারতে এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আমানুল্লাহ সাঈদ-ই খুলনার শিমুল ভূঁইয়া। পুরো নাম ভিন্ন থাকলেও ছবি দেখে এলাকার মানুষ শিমুল ভূঁইয়াকে শনাক্ত করেছেন। তবে খুলনার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে মুখ খুলছে না। শিমুল ভূঁইয়ার পরিবারের সদস্যরাও এ বিষয়ে কথা বলতে নারাজ।
স্থানীয় ও গোয়েন্দা বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, কলকাতায় এ হত্যার মিশনে যাওয়ার আগে নিজের নাম পরিবর্তন করেন শিমুল ভূঁইয়া। ভাই শিপলু ভূঁইয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে জন্মসদন পরিবর্তন করেন সহজেই। এরপর সেই জন্মসনদ দিয়ে ভোটার আইডি কার্ডও পরিবর্তন করেন। আগে ভোটার আইডি কার্ডে তার নাম ছিল শিহাব মোহাম্মদ ভূঁইয়া। বর্তমানে জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম হয়েছে আমানুল্লাহ সাঈদ। শিমুলের এই নাম পরিবর্তনের বিষয়টি অনেক আগে থেকেই শুরু হয়। পৃথক পৃথক মামলায় তিনি ভিন্ন নাম ব্যবহার করতেন। কখনও তিনি নাম ব্যবহার করেছেন মাহমুদ হাসান, কখনও শিহাব মাহমুদ আবার কখনও ফজল মোহাম্মদ। তবে তার এসএসসি পরীক্ষার সনদপত্রে নাম রয়েছে শিহাব মোহাম্মদ ভূঁইয়া। ১৯৮৫ সালে তিনি ফুলতলার এমএম মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসপি পাশ করেন। ১৯৮৭ সালে দৌলতপুরের দিবা-নৈশ কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন।
এদিকে শিমুল ভূঁইয়ার নাম নিয়ে এমন বিভ্রাট হলেও স্থানীয় লোকজন ছবি দেখে ঠিকই চিনতে পেরেছেন। বৃহস্পতিবার ফুলতলা উপজেলায় গিয়ে শিমুল ভূঁইয়ার ছবি দেখালে স্থানীয় সৌরভ ইসলাম ও মনোয়ার হোসেনসহ একাধিক ব্যক্তি তাকে চিহ্নিত করেছেন।
এদিকে এমপি আনোয়ারুল আজিম হত্যাকাণ্ডের বিষয় নিয়ে শিমুলের পরিবারের বিষয়ে জানতে চাইলে ফুলতলা থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, শিমুল ভূঁইয়া ও আমানউল্লাহ দুজনেই একই ব্যক্তি কিনা এ বিষয়ে কোনো সংস্থাই আমাদের নিকট তথ্য চায়নি। যেহেতু এটি জাতীয় ইস্যু এজন্য আমাদের নিকট কেউ তথ্য না চাইলে আমরা নিজে থেকে সেটি যাচাই করতে চাচ্ছি না।
এদিকে দক্ষিণাঞ্চলের মূর্তিমান আতঙ্ক হিসাবে পরিচিত ফুলতলার ভূঁইয়া পরিবার। এই পরিবারের প্রায় সব সদস্যের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে চরমপন্থি দলের নাম। পরিবারটির দুই প্রজন্ম ধরেই টার্গেট কিলিং, চাঁদাবাজি, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, খুন ও গুমের সঙ্গে জড়িত। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও অবস্থানের পরিবর্তন হয়। পুরো দক্ষিণাঞ্চলের ত্রাস হিসাবে পরিচিত ভূঁইয়া পরিবারের সদস্যরা। এই পরিবারের হাতে খুনের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন হলেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ-সদস্য আনোয়ারুল আজিম। ভূঁইয়াদের পরিবারে রয়েছে একাধিক জনপ্রতিনিধি। যারা এখন সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে খুন-গুমের মতো এমন ঘটনা বারবার ঘটালেও তারা সহজে পার পেয়ে যায় বলে স্থানীয়দের মন্তব্য।
শিমুল ভূঁইয়ার ভাই চরমপন্থি দলের এক সময়কার নেতা শিপলু ভূঁইয়া এখন খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার তালিকাতেও তাকে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) খুলনার আঞ্চলিক নেতা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
চরমপন্থিদের নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার ওই তালিকার ৩ নম্বরে রয়েছে শিপলু ভূঁইয়ার নাম। তার বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ প্রায় এক ডজন মামলা রয়েছে। শিপলুর বড় ভাই শিমুল ভূঁইয়ার নামও রয়েছে ওই তালিকার ৪ নম্বরে। ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আবুল কাশেম হত্যা মামলায় ৩২ বছরের সাজাও হয়েছে। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। শিমুল বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির (বরুণ গ্রুপ) আঞ্চলিক নেতা। তার বিরুদ্ধেও হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ ডজনখানেক মামলা রয়েছে। সরদার আবুল কাশেম হত্যা মামলায় শিপুল ভূঁইয়াকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। শিমুল ভূঁইয়ার পুরো নাম শিহাব মোহাম্মদ ভূঁইয়া শিমুল। মূলত শিপলু ও শিমুল ভূঁইয়া চরমপন্থি সংগঠনে নাম লেখান তার বাবার হাত ধরেই। বাবা নাসির উদ্দিন ভূঁইয়াও ছিলেন নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। একাধিক মামলায় জেলও খেটেছেন শিমুল ভূঁইয়া। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, শিমুল ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে খুনসহ অন্তত দুই ডজন মামলা আছে। গণেশ নামের এক ব্যক্তিকে খুন করে যশোরের অভয়নগর থানার এক মামলায় আমানুল্লাহ ৭ বছর (১৯৯১-৯৭) জেল খাটেন। ইমান আলী নামের এক ব্যক্তিকে খুনের ঘটনায় ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত জেল খাটেন। জেল থেকে বের হয়ে রাজনৈতিক শেল্টার খুঁজতে থাকে ভূঁইয়া পরিবার। এ সময় আওয়ামী লীগে যোগ দিতে থাকেন পরিবারের সদস্যরা। ২০১৫ সালে খুলনা-৪ আসনের সংসদ-সদস্য এসএম মোস্তফা রশিদী সুজার হাত ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন শিমুলের বড় ভাই শিপলু। ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের পরিচয়ে তিনি ফুলতলা উপজেলার দামোদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
শিমুল নিজের স্ত্রীকেও জেলা পরিষদের সদস্য হিসাবে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে পাশ করান। শিমুলের স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন মুক্তাও ফুলতলা উপজেলা চেয়ারম্যান মিঠু হত্যা মামলার আসামি। এর আগে ২০১৭ সালের ২৫ মে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে খুন হন ফুলতলা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সরদার আলাউদ্দিন মিঠু। তার ছোট ভাই রাজ সরদার হত্যা মামলা করেন। সেই মামলায় পুলিশ ও পরে পিবিআই শিমুলকে প্রধান ও মুক্তাকে চার নম্বর আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। দীর্ঘদিন তারা পলাতক ছিলেন।
জেলা গোয়েন্দা বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, ১৯৯১ সালে যশোরের অভয়নগর এলাকায় গণেশ নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত কারাবন্দি ছিলেন শিমুল ভূঁইয়া। পরবর্তীতে তিনি ২০০০ সালে আবারও ইমান নামে আরেক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার হন। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি কারাবন্দি ছিলেন। জামিনে কারাগার থেকে বের হয়ে তিনি ভাড়াটে কিলার হিসাবে কাজ করতেন।
এমন একজন সন্ত্রাসী বারবার অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে কিভাবে জানতে চাইলে খুলনার পুলিশ সুপার মো. সাইদুর রহমান বলেন, শিমুল ভূঁইয়ার প্রত্যেকটি ঘটনায় মামলা হয়েছে। একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছে। পরে জামিনে বের হয়েছে। আমরা সবগুলো ঘটনাতেই তাকে গ্রেফতার করে আদালতে দিয়েছি।