Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

আগামী অর্থবছরের বাজেট

সংকটেও উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা রিজার্ভে

Icon

মিজান চৌধুরী

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংকটেও উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা রিজার্ভে

ডলার সংকট ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও আগামী অর্থবছরে (২০২৪-২৫) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন (৩২০০ কোটি) ডলারে উঠাতে চায় সরকার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে বর্তমানে রিজার্ভের অঙ্ক ২৩ বিলিয়নের বেশি। পাশাপাশি মধ্য মেয়াদে অর্থাৎ পরবর্তী দুই অর্থবছরে (২০২৫-২৬ ও ২০২৬-২৭) যথাক্রমে ৩৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন (৩৫১০ কোটি) ডলার এবং ৩৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন (৩৮৩০ কোটি) ডলারে নেওয়ার রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে।

সম্প্রতি সরকারের ‘আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অডিনেশন কাউন্সিল’ বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয় রিজার্ভের এই লক্ষ্যমাত্রা। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। তবে নতুন লক্ষ্যমাত্রাকে উচ্চাভিলাষী বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

তাদের মতে, লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারলে সেটি হবে অর্থনীতির জন্য ভালো। তবে বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন চ্যালেঞ্জ হবে। এজন্য রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

পাশাপাশি দেশ থেকে পুঁজি পাচারও ঠেকাতে হবে। অন্যথায় নানা চেষ্টা করেও রিজার্ভ বাড়ানো যাবে না। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মোট রিজার্ভ ২৩ বিলিয়ন দাবি করলেও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বা আইএমএফ-এর হিসাবে ১৮ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন দুটি পদ্ধতিতে রিজার্ভ হিসাব করে থাকে। একটি হচ্ছে-গ্রস বা মোট, অর্থাৎ যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা হাতে আছে, যা এখন ২৩.৭৭ বিলিয়ন ডলার। আরেকটি হলো, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের পদ্ধতি বিপিএম-৬। সে অনুযায়ী এখন রিজার্ভ ১৮.৩২ বিলিয়ন। তবে ব্যবহারযোগ্য (নিট) রিজার্ভ ১ হাজার ৩০০ কোটি (১৩ বিলিয়ন) ডলারের নিচে নেমেছে।

এদিকে ডলার সংকটের কারণে চলতি অর্থবছরের রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ৩০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৯০ কোটি ডলার কাটছাঁট করে ২৯ দশমিক ১০ বিলিয়নে নামিয়ে আনা হয়েছে। আইএমএফ তাদের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা ৫৩৩ কোটি ডলার কমিয়েছে। এরপরও জুনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং আইএমএফ-এর মানদণ্ড অনুযায়ী রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

আগামী তিন অর্থবছরের রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রাকে উচ্চাভিলাষী বলে মন্তব্য করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরী।

তিনি যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করাই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে অর্জন করতে পারলে সেটি ভালো। বিগত এক বছরে রিজার্ভ খুব বেশি বাড়াতে সক্ষম হয়নি। ২০-২৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অবস্থান করেছে। এখন ইরান-ইসরাইলসহ বিশ্ব পরিস্থিতি মাথায় রাখতে হবে। কারণ, যুদ্ধ পরিস্থিতি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ কতটা খারাপের দিকে যাচ্ছে, সেটি দেখার বিষয়। এটি বিশ্ব অর্থনীতি পরিস্থিতিকে খারাপের দিকে নিতে পারে। এতে জ্বালানি তেল ও নিত্যপণ্য আমদানি ব্যয় বাড়তে পারে, যা রিজার্ভকে আবারও চাপের মুখে ফেলতে পারে।

অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমতে কমতে ১৮ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে এবং নিট রিজার্ভ নেমেছে ১৩ বিলিয়নে। এটি খুব বিপজ্জনক একটি অবস্থান। রিজার্ভ বাড়াতে হলে বিদেশে অর্থ পাচার প্রতিরোধে প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে। না হলে বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে পতন, সেটি থামানো যাবে না।

‘আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অডিনেশন কাউন্সিল’ বৈঠকে আগামী তিন অর্থবছরের (২০২৪-২৫ থেকে ২০২৬-২৭) রিজার্ভ বাড়ানোর কয়েকটি কৌশলের কথা তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল হয়ে আসছে।

এছাড়া আমদানি ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও রপ্তানি খাতের আয় বাড়ছে। এছাড়া আর্থিক খাতে সুদের হারও বেড়েছে। এসব কারণে আগামী দিনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও বাড়বে। সেখানে আরও বলা হয়, বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিয়ম হার চালু করা হয়েছে। এতে রিজার্ভের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

এছাড়া আইএমএফ-এর চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করায় দেশের বাজারে ১১৭ টাকা হয়েছে। এর ফলে রেমিট্যান্স আরও বাড়বে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে রপ্তানি আয় কীভাবে কতটা বাড়বে অথবা আদৌ বাড়বে কি না, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন কিংবা আলোচনা আছে।

এছাড়া আইএমএফ-এর সঙ্গে বাংলাদেশ যে ঋণচুক্তি করেছে, এর তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার ছাড়াও বেশকিছু সংস্থার ঋণ ও অন্য সহায়তা দুমাসের মধ্যে ছাড় হওয়ার কথা, যা রিজার্ভ পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসবে বলে সরকার আশা করছে।

ওই বৈঠকে অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, রিজার্ভ কমে যাওয়ার পেছনে উন্নত দেশের সুদের হার বৃদ্ধিও একটি কারণ। এছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রিজার্ভ হ্রাস পেয়েছে। তবে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হিসাব দিয়ে তিনি বলেন, গ্রস রিজার্ভ যা আছে, তা দিয়ে ৪.৬ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

দুই বছর আগে দেশে শুরু হয়েছে ডলারের সংকট। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়াতে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো রিজার্ভ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না; বরং প্রায় প্রতিনিয়তই কমছে রিজার্ভ। নিয়ন্ত্রণের পরও প্রতিমাসে আমদানি ব্যয়ের দায় মেটানোর জন্য গড়ে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার প্রয়োজন হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগদ তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে গ্রস রিজার্ভের অঙ্ক ২৫ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন (২৫৯৭ কোটি) মার্কিন ডলার ছিল। ১৭ এপ্রিল তা ২৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন (২৫৩০ কোটি) ডলারে নেমে আসে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ১৯ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৯৮৯ কোটি ডলারে নেমেছে।

সর্বশেষ মে মাসে সেটি আরও কমে প্রকৃত রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। অথচ ২০২১ সালে মোট রিজার্ভ ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছিল।

রিজার্ভ বৃদ্ধির দুটি প্রধান উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয় প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। তবে কাগজে-কলমে রপ্তানি যতটা ভালো করছে বলে দেখানো হয়, প্রকৃত চিত্র সেটা নয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্য অনুযাযী, এপ্রিলে বাংলাদেশ ৩৯১ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে।

এটি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় শূন্য দশমিক ৯৯ শতাংশ কম। শুধু প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়েছে তা নয়, এপ্রিলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও রপ্তানি পিছিয়ে আছে ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত মোট রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৭৪৭ কোটি ডলার।

রপ্তানিতে কিছুটা ভাটা থাকলেও রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৯১১ কোটি বা ১৯ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে প্রবাসীরা ১৭ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছিলেন। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রেমিট্যান্সে ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গড়ে ২০০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আসাটাকে ইতিবাচকই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম