Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ভুল সিগন্যালে দুর্ঘটনার জের

শিডিউল বিপর্যয় অব্যাহত যাত্রী দুর্ভোগ চরমে

Icon

শিপন হাবীব

প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিডিউল বিপর্যয় অব্যাহত যাত্রী দুর্ভোগ চরমে

রেলে শিডিউল বিপর্যয় কাটেনি ৩ দিনেও। ফলে রোববারও বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। শনিবার ভোরে স্টেশনে এসে রাত ৪টার দিকে রংপুর এক্সপ্রেসের যাত্রীরা ট্রেনে উঠেছেন। অন্যান্য গন্তব্যের যাত্রীদের একই অবস্থা হয়েছে। রোববার রংপুর এক্সপ্রেস কখন ছাড়বে তা কেউ বলতে পারছেন না। অথচ এই ট্রেনের ৫ মের টিকিটের যাত্রীদের অধিকাংশই সকালে কমলাপুর স্টেশনে এসে পৌঁছান। তারা রাত পর্যন্ত স্টেশনেই বসে আছেন। এছাড়া উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল রুটে যাতায়াত করে এমন প্রতিটি ট্রেন ৩ থেকে ১১ ঘণ্টা দেরিতে চলছে। ট্রেন দেরিতে চলার প্রভাব পড়েছে দেশের প্রায় সব স্টেশনে। এসব স্থানে যাত্রীরা অপেক্ষায় থেকে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

শুক্রবার জয়দেবপুরে দুটি ট্রেনের সংঘর্ষের পরপরই বিশেষ করে ঢাকার সঙ্গে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে চলা প্রায় সব ট্রেনের শিডিউল লন্ডভন্ড হয়ে পড়ে। শুক্রবার বিকাল থেকেই শিডিউল বিপর্যয়ের খেসারত দিচ্ছেন যাত্রীরা। আজই এর নিরসন হবে তা স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারছেন না। ফলে আগাম টিকিট কেটে রাখা যাত্রীদের দুর্ভোগ দ্রুতই কাটবে তা নিশ্চিত করতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।

রেলওয়ে মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী যুগান্তরকে বলেন, মূলত জয়দেবপুরে দুই ট্রেনের সংঘর্ষে দুর্ঘটনায় শিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে। উদ্ধার কাজ সমাপ্ত হলেও লাইন মেরামতের কাজ এখনো চলছে। যাত্রীদের দুর্ভোগের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, র‌্যাক স্বল্পতার কারণে আমরা দ্রুততার সঙ্গে শিডিউল বিপর্যয় রোধও করতে পারছি না।

পর্যাপ্ত ইঞ্জিন, কোচ ও জনবল থাকলে বিলম্বিত ট্রেনের জন্য অপেক্ষা না করে-অতিরিক্ত ট্রেন দিয়ে নির্ধারিত রুট পরিচালনা সম্ভব ছিল। এতে যাত্রীদের দুর্ভোগ থাকত না। যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টেশনেও অপেক্ষ করতে হতো না। তিনি বলেন, আমরা সম্প্রতি ট্রেনের ভাড়া রেয়াত বাতিল করেছি। বর্তমানে যাত্রীরা অতিরিক্ত টাকায় টিকিট ক্রয় করছেন। বেশি টাকায় টিকিট কাটা যাত্রীরা সেবা ও নিরাপত্তা চাচ্ছেন। কিন্তু আমরা তা যথাযথভাবে দিতে পারছি না। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।

রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেন প্রায় ১৬ ঘণ্টা পর রোববার মধ্যরাতে কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছবে এমন সংবাদে ওইদিন সকাল ৮টায় কমলাপুর স্টেশনে আসা ট্রেনটির যাত্রী রুহুল আমিন (৬৫) জানালেন, যাত্রীদের মানুষ মনে করছে না রেল। পুরো স্টেশনে যাত্রীরা দুর্ভোগে ভুগছেন। এমনটা শুধু কমলাপুরে নয়, সবকটি স্টেশনেই যাত্রীরা অপেক্ষা করছেন। নিজেকে পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত সদস্য পরিচয় দিয়ে বললেন, পরিবারের ৬ জন সদস্য নিয়ে সকাল ৭টায় পোস্তগোলা থেকে রওয়ানা দিয়ে ৮টায় কমলাপুর স্টেশনে আসেন। কিন্তু ট্রেনের জন্য নাকি মধ্যরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। রেলের ভুল-তাদের সক্ষমতার অভাব যাত্রীদের দুর্ভোগে ফেলেছে।

ধূমকেতু এক্সপ্রেস রোববার সকাল ৬টায় ছাড়ার কথা। ট্রেনটি ১১ ঘণ্টা পর বিকাল ৫টায় কমলাপুর আসতে পারে বলে জানিয়েছে স্টেশন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত এটি ঢাকায় পৌঁছেনি। কমলাপুর এসে পৌঁছার পর যাত্রী নিয়ে উত্তরাঞ্চলের দিকে যাত্রা করবে। তখন রাত কটা বাজবে তা কেউ বলতে পারছেন না। এই ট্রেনটির যাত্রী রাজধানীর চাঁনখারপুরের বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম। তিনি জানালেন, বৃদ্ধ মা ও স্ত্রী সন্তান নিয়ে ভোরে স্টেশনে আসেন। এসেই শুনতে পান ট্রেনটি প্রায় ১৪-১৫ ঘণ্টা বিলম্বে স্টেশনে আসবে। বাধ্য হয়েই বসে আছেন, অপেক্ষা করছেন ট্রেনের। দুপুরের খাবার খেয়েছেন রুটি কলা। রাতে কি খাবেন জানেন না। কোন রেল কর্মকর্তা কিংবা ষ্টাফ কাউকেই প্লাটফর্মে পাওয়া যাচ্ছে না। স্টেশন ম্যানেজার-মাস্টারের রুমেও উত্তেজিত যাত্রীদের ভিড়। তাঁর তালিকায় রয়েছে আরও অনেক সমস্যা।

পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেন শনিবার ভোর ৬টায় কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে গেছে। অর্থাৎ রাত সাড়ে ১১টার ট্রেনটি প্রায় ৭ ঘণ্টা বিলম্বে গেছে। রোববার এ ট্রেনটি কখন কমলাপুর স্টেশনে আসবে সঠিক তথ্য নেই রেলওয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে। একই অবস্থা কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেনের। বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেন সকাল সাড়ে ৮টায় ছাড়ার কথা থাকলেও ট্রেনটি কমলাপুর স্টেশনে আসে বিকাল ৪টার দিকে। প্রায় ৭ ঘণ্টা বিলম্বে ট্রেনটি ছেড়ে গেছে।

শুধু সিডিউল বিপর্যয় নয়, বিলম্বে চলাচল করছে এমন ট্রেনের বগিতে ট্রেনের ভ্রমণ করাই কষ্টকর। বিলম্বিত ট্রেন পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার সুযোগ না পাওয়ায় অস্বস্থিকর পরিবেশেই যাত্রীরা ট্রেনে উঠছেন। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্টেশন কর্মকর্তা জানান, বিলম্বিত ট্রেন কমলাপুর স্টেশন প্রবেশ না করে সরাসরি ওয়াশফিডে প্রবেশের সুযোগ নেই। এদিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা থাকা যাত্রীরা স্টেশনে ট্রেন আসতেই দ্রুত উঠে যাচ্ছে। ওই অবস্থায় যাত্রীদের নামিয়ে ট্রেন ওয়াশফিডে নেওয়ারও পরিবেশ থাকছে না। ফলে নোংরা অবস্থায় অনেক ট্রেন চলাচল করছে। মূলক কারণ হচ্ছে সিডিউল বিপর্যয়। জরাজীর্ণ লাইনে ঊনিশ থেকে বিশ হলেই দুর্ঘটনা ঘটছে।

রেলওয়ে পরিবহণ দপ্তর সূত্রে জানা যায়, একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হলে সেটি উদ্ধারে কখনও ৩ থেকে ১৫ ঘণ্টা পযর্ন্ত সময় লাগে। উদ্ধারকারী ট্রেন পৌঁছতেই সময় লাগে ৪/৫ ঘণ্টা। তাছাড়া রেলের বাইরে থেকে শ্রমিক ধার করে উদ্ধার কাজ পরিচালনায় সমন্বয় থাকে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, লাইনচ্যুত বা দুর্ঘটনায় উদ্ধার কাজ নিয়ে চলে অর্থ লুটপাটের খেলা। একেকটি উদ্ধার কাজে ২ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ দেখানো হয়। এতে করে উদ্ধার কাজে যত বেশি সময় লাগে-অর্থ খরচও বেশি দেখানোরও একটি সুযোগ পায় সংশ্লিষ্টরা। উদ্ধার কাজের সঙ্গে শিডিউল বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষ সংযোগ আছে।

এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেস ট্রেন সাড়ে ৬ ঘণ্টা বিলম্বে কমলাপুর থেকে ছেড়ে গেছে। ওই ট্রেনের যাত্রী রিনা আক্তার বিউটি জানান, শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে অনেক যাত্রী টিকিট ফেরত দিয়ে যাত্রা বাতিল করছেন। এতে করে রেলেরও লোকসান হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে এক সহকারী বুকিং মাস্টার বললেন, দুর্ঘটনায় প্রায় ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়। বাতিলকৃত ট্রেনের প্রত্যেক যাত্রীর টিকিটের মূল্য ফেরত দেওয়া হয়। দীর্ঘ বিলম্বিত ট্রেনের বেশিরভাগ টিকিটই ফেরত দেওয়া হয়। এতে রেলের লোকসানের পাল্লা আরও ভারী হচ্ছে।

যাত্রীদের ভোগান্তির কথা স্বীকার করে কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সরওয়ার যুগান্তরকে জানান, গত কয়েক দিনে যা হয়েছে, সবই দুর্ঘটনার কারণে। দুর্ঘটনাগুলো মানবসৃষ্ট, দুর্ঘটনায় কবলিত ট্রেন উদ্ধার করলেও ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় বেশ কয়েকদিন লেগে থাকে। তবে আমরা চেষ্টা করি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ট্রেন চালু করে যাত্রীদের স্বস্তি দিতে। অধিকাংশ ট্রেন একটি র‌্যাকে চলাচল করায় সময় মেনে ট্রেন চালানো সম্ভব হয় না।

রেলের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার জানান, গত কয়েকদিন ধরে ঢাকামুখী এবং ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া অধিকাংশ ট্রেনই সময়মতো চালানো যায়নি। যাত্রীদের মধ্যে যারা টিকিট ফেরত দিতে চেয়েছেন তাদের টিকিটের সমমূল্য পরিশোধ করা হচ্ছে। এছাড়া রোদের কারণে বিভিন্ন সেকশনে ট্রেন স্বাভাবিক গতির চেয়ে কম গতিতে চালানোর নির্দেশনা এখনো কার্যকর রয়েছে। এসব কারণেও ট্রেনের স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম