সবুজ ও জলাশয় ৩১ শতাংশই দখল
ভুলে ভুলে ঢাকার সর্বনাশ
মতিন আব্দুল্লাহ
প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাকা শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ১৯৯৫ সালে জলাশয় ছিল ২০.৫৭ শতাংশ। ২০২৩ সালে এসে ১৭.৬৭ শতাংশ জলাশয় কমে দাঁড়িয়েছে ২.৯ শতাংশে। তেমনি সবুজ ছিল ২২ শতাংশ, সেটি ১২.৭ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৯.৩ শতাংশে। বিগত ২৮ বছরে ঢাকার কেন্দ্রীয় নগর অঞ্চলে সবুজ ও জলাশয় কমেছে প্রায় ৩১ শতাংশ। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২৩ সালের সবুজ ও জলাশয়বিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এমন চিত্র মিলেছে।
নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণ ভুল নগর দর্শন। ভুল চিন্তার কারণে শহরের মধ্য দিয়ে বহমান খালগুলো দখল ও ভরাট হয়ে গেছে। শহরকে ঘিরে রাখা নদীগুলোও সংকুচিত হয়ে পড়ছে। অপরিকল্পিত, মানব বিচ্ছিন্ন এবং পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মধারার মধ্য দিয়ে দ্রুতগতির নগরায়ণের খেরাসত আমাদের দিতে হচ্ছে। ঢাকায় যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে তার লাগাম টেনে ধরতে হবে। নইলে এই শহরে বসবাস করা খুবই দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
তাদের অভিমত-যে কোনো বাসযোগ্য নগরে সবুজ ও জলাশয় থাকার কথা ৪০ শতাংশ। তবে ঢাকার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে রয়েছে মাত্র ১২.২ শতাংশ অর্থাৎ ২৭.৮ শতাংশ কম। ফলে কেন্দ্রীয় ঢাকার বাস-উপযোগিতা হ্রাস পেয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। এর পাশাপাশি অন্যান্য কিছু কারণে পরিবেশের মানও ভয়ানক খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশ্বের সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর বায়ুমানের শহরের তালিকায় প্রায় শীর্ষে অবস্থান করে প্রাণের শহর ঢাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়-তিন দশক আগেও ঢাকা শহরজুড়ে ৫০টির বেশি খাল ও লেক ছিল। এছাড়া অনেক পুকুর ছিল। মানবদেহের শিরা-উপশিরার মতো চারপাশের নদী ও খালের সঙ্গে আন্তঃসংযোগ ছিল। ধানমন্ডি-পরিবাগ-গুলশান-বনানী-মহাখালী-বেগুনবাড়ী খাল এই শহরে শিরার মতো জড়িয়ে থেকে বালু নদীতে সংযুক্ত হতো। আর বেগুনবাড়ি-ইব্রাহিমপুর-কল্যাণপুর খাল, যেটি তুরাগ নদে সংযুক্ত করে শহরের নিষ্কাশন এবং জল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহায়তা করত। সেগুনবাগিচা-ধোলাইখাল বালু ও বুড়িগঙ্গী নদীতে প্রবাহিত হতো। এসব খাল ঢাকা শহরকে পানিপ্রবাহের মাধ্যমে প্রাণপ্রাচুর্য দান করেছিল। শহরের বহমান খাল, ঝিল, লেক এবং পুকুরগুলো পানির উৎস হিসেবে যেমন কাজ করত, তেমনি এসব প্রাকৃতিক প্রবাহ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। বলা হচ্ছে, বর্তমানে ২৬টি খাল রয়েছে। খালের সঠিক সংখ্যা ও অবস্থান চিহ্নিত করতে কাজ করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কবে এসব উদ্যোগের সুফল পাবে নগরবাসী তা অজানা।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়-বাসাবাড়ি, মার্কেট ও শিল্পের বর্জ্য ফেলে জায়গা ভরাট করা হয়েছে। মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক বেশি বিনিয়োগ হওয়ায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের প্রসার ঘটেছে এখানে। এসব প্রয়োজনে মানুষ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকায় ছুটে এসেছে। এই ভুল দর্শনে ঢাকার জনঘনত্ব বাসযোগ্যতার সীমা অতিক্রম করেছে। বিদ্যমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে গিয়ে এই নগরী কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।
জানা গেছে, শহরের বুক চিরে বয়ে চলা খালগুলো হারিয়ে যাওয়ার পেছনের অন্যতম কারণ-মানুষের জন্য আবাসন, রাস্তাঘাট, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নির্মাণ এবং এই নির্মাণযজ্ঞ থেকে যে আবর্জনার সৃষ্টি তার শেষ গন্তব্য জলাশয়। এই শহরের বেশ কিছু খাল এখন কালভার্টে বাক্সবন্দি। এসব কালভার্টবন্দি খালে প্রায়ই আবর্জনা, জঞ্জাল জমে প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, আবার এর পানির গুণগত অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণও অনেক সময় অসাধ্য। যে কটি খাল এখনো টিকে আছে, সেগুলোরও করুণ অবস্থা। কল্যাণপুর, আব্দুল্লাহপুর খাল, দেগুন খাল, কালুনগর, বাউনিয়া খাল, মাণ্ডা খাল, শাহজাদপুর খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, নিত্যদখলদারিত্বের মাঝে টিকে আছে কোনোমতে। খাল উদ্ধারের চলমান দুর্বল অবস্থা চলতে থাকলে এগুলো হারিয়ে যেতে দেরি হবে না। সব জলাশয় যদি নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলে তপ্ত নগরীতে আগুন ছড়িয়ে পড়লে নেভানোর পানি মিলবে না। এছাড়া এই নগরী সূর্যের তাপে শুষ্ক মৌসুমে তাপী দ্বীপে পরিণত হচ্ছে। এ অবস্থায় এই শহরে বসবাস করা দুষ্কর হয়ে পড়ছে। পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটলে ভালোবাসার এই শহর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবে মানুষ।
শুকনো মৌসুমে উত্তপ্ত, বর্ষায় জলাবদ্ধ : বাসযোগ্য নগরীর স্বপ্ন নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা বলছেন-নগরীর অভ্যন্তরে এবং আশপাশের খাল, পুকুর ও জলাশয় নষ্ট করার ফলে ঢাকা শুকনো মৌসুমে উত্তপ্ত, তেমনি বর্ষাকালে হয়ে পড়ছে জলাবদ্ধ। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত সময়ে জলাবদ্ধতাজনিত কারণে ঢাকার ক্ষতি হতে পারে ১১ হাজার কোটি টাকা। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অতিবৃষ্টি হলে এই ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
এদিকে ঢাকার হারিয়ে যাওয়া খাল পুনরুদ্ধারের বিষয়ে নানা আন্দোলন ও কর্মসূচি পালন করলেও তাতে তেমন কোনো লাভ হয়নি। বরং ক্রমেই ঢাকার পূর্বদিকের নিুাঞ্চল ভরাট হয়েছে। জলাভূমি ভরাট করে পরিবেশগত পরিকল্পনা ছাড়াই আবাসন নির্মিত হয়েছে। ফলে নগরীর প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশন যেমন ধ্বংস হয়েছে, তেমনি হারিয়ে গেছে জীববৈচিত্র্য। ঢাকা নগরীর বিভিন্ন স্থানে নামের সঙ্গে এখনো জড়িয়ে আছে জলাশয় ও বনভূমির সংযোগ। হাতিরঝিল, মতিঝিল যেমন জলাশয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তেমনি শাহবাগ, আরামবাগ, বনানী, সেগুনবাগিচা মনে করিয়ে দেয় ঢাকার পাখি ডাকা সবুজ শ্যামলিমার কথা।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত : বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি নগরপরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন-২০২৩ সালে বিআইপি ঢাকার সবুজ ও জলাশয়ের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করে। সেখানে উঠে এসেছে-ঢাকার কেন্দ্রীয় অঞ্চল, ঢাকার পুরাতন নগরায়ণকৃত এলাকা। এই এলাকায় জলাশয় ও সবুজ নষ্ট করে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। এক সময় বাসযোগ্য নগরের উপযোগী সবুজ ও জলাশয় এখানে ছিল। ভুল নগর দর্শনের ফলে বাস-উপযোগিতার কথা বিবেচনায় না রেখে উন্নয়ন করায় শহরের ভয়ানক বিপর্যয় ঘটেছে।
তিনি বলেন-এখন ঢাকার বাস-উপযোগিতা ফিরিয়ে আনতে হলে বিদ্যমান জলাশয় ও সবুজ রক্ষা করতে হবে। আর যেসব ভরাট হয়ে গেছে, সেগুলো উদ্ধার করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কয়েকটি উদাহরণ তৈরি করা গেলে নতুন করে কেউ জলাশয় ও সবুজ ধ্বংস করে কোনো উন্নয়নের চিন্তা করবে না। পাশাপাশি নদী, খাল, স্কুল ও বাসাবাড়ির আঙিনায় গাছ রোপণের উদ্যোগ নিতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হলে পরিস্থিতি অনেকাংশে উন্নতি লাভ করবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন-অতি তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণ ভুল নগর দর্শন। অর্থাৎ অপরিকল্পিত, মানব বিচ্ছিন্ন এবং পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মধারার মধ্য দিয়ে দ্রুতগতির নগরায়ণের খেরাসত দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, মাত্র কয়েক হাজার মানুষের জন্য ঢাকার কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে না। সরকারকে নগর দর্শনের ধারণা বদলাতে হবে। প্রয়োজনে নদী ও খালের জমি অধিগ্রহণ করে সংরক্ষণ করতে হবে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : রাজউকের প্রধান নগরপরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সংশোধিত ড্যাপে ঢাকার সবুজ ও জলাশয়ের পরিমাণ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলো ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা গেলে শহরের তাপমাত্রার ঊর্ধ্বগতি অনেকাংশ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম যুগান্তরকে বলেন-ঢাকা ওয়াসা থেকে খালের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর খালগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি পানি নিষ্কাশন যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে কার্যক্রম চলামন। এছাড়া সিএস রেকর্ড ধরে খালগুলোর সীমানা নির্ধারণ করতে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন-বহমান নদীর মতো খালের সীমানা নির্ধারণ, সংস্কার ও উন্নয়নের কার্যক্রম চলমান। বহু বছর ধরে ধাপে ধাপে খালগুলো ধ্বংস হয়েছে। এসব পুনরুদ্ধারেও অনেক সময়ের প্রয়োজন।