সংগঠন গোছাতে পারেনি আ.লীগের শরিকরা
কাগজে-কলমে জেলা-উপজেলা কমিটি থাকলেও নেই সাংগঠনিক তৎপরতা
রফিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দীর্ঘদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আশীর্বাদ থাকলেও নিজেদের মেলে ধরতে পারেনি ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো। দিবস ভিত্তিক কর্মসূচি ছাড়া রাজনীতিতে খুব বেশি সক্রিয় দেখা যায় না তাদের।
এসব কর্মসূচির বেশিরভাগই হয় জোটের ব্যানারে। দু-একটি দল কোনো কোনো দিবসে নিজেরা আলাদা কর্মসূচি পালন করলেও অধিকাংশই ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এসব দলগুলোর কাগজে-কলমে কমিটি থাকলেও নেই সাংগঠনিক তৎপরতা। নিজস্ব কার্যালয় না থাকায় অনেকের বাসাবাড়িতে চলে দলীয় কার্যক্রম।
এছাড়া ক্ষমতাসীন দল থেকে পাওয়া ‘বিশেষ সুবিধা’ বঞ্চিত হওয়ায় অনেকের ভেতরে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ ও হতাশা। ফলে ক্রমেই সাংগঠনিক কার্যক্রমে দুর্বল হচ্ছে তারা। শরিক দলের নেতাদের অনেকেই মনে করেন, দীর্ঘ সময় জোট চর্চা করে কেউ কেউ ব্যক্তিগত সুবিধা নিলেও সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জোটভুক্ত শরিকরা।
জানতে চাইলে ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, আমাদের অধিকাংশ কর্মী-সমর্থকরা দরিদ্র। তারা নিজেদের পরিবার চালানোর পাশাপাশি দলে সময় দেন। সে কারণে ইচ্ছে থাকলেও অনেক কিছু করা সম্ভব হয় না। তবে বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা আছে। দলের ভেতরের সব সমস্যা সমাধান করা হবে। সেজন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২০০৪ সালে গঠিত হয় ১৪ দলীয় জোট। রাজনৈতিক এ জোট গঠনের পর থেকে আন্দোলন-সংগ্রাম, মিছিল-মিটিং এবং জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আসছে শরিক দলগুলো। শরিক দলের নেতারা স্থান পেয়েছিলেন সরকারের মন্ত্রিপরিষদে।
দীর্ঘ এ সময় নিজেদের স্বনির্ভর করার চেয়ে ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য পাওয়ায় ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে তাদের। ফলে ক্ষমতার ছায়াতলে থাকলেও সাংগঠনিকভাবে নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি তারা। জাতীয় বা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে ক্ষমতাসীনদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
দলীয় প্রতীকে এককভাবে নির্বাচনের ক্ষমতা হারিয়েছে প্রায় সবাই। অনেকে নিবন্ধন না পাওয়ায় শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক রাজনীতি করেন। ফলে শরিক দলগুলো জেলা-উপজেলায় দুর্বল হয়েছে সাংগঠনিকভাবে। নিষ্ক্রিয় হয়েছে পড়েছেন অধিকাংশ নেতাকর্মী। কমিটি থাকলেও নেই রাজনৈতিক কার্যক্রম। অনেক জেলায় নেই দলীয় কার্যালয়।
দলগুলোর স্থানীয় নেতাদের বাসাবাড়ি ও ব্যক্তিগত অফিসে চলে রাজনৈতিক কার্যক্রম। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (জেপি), গণতন্ত্রী পার্টি, গণআজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র ও গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টিসহ জোটের সব দলের একই অবস্থা। যুগান্তরের জেলা প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর তৃণমূলের এমন চিত্র উঠে এসেছে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল। দলটির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ২০২০ সালে। ওই কাউন্সিলের মধ্যদিয়ে সভাপতি হিসাবে পুনর্নির্বাচিত হন হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার। তাদের দুজনের নেতৃত্বে চলছে জাসদের রাজনীতি।
দলটির দপ্তর সূত্রে বলছে, জাসদের মোট সাংগঠনিক জেলার সংখ্যা ৭৮টি। দেশের প্রায় সব উপজেলায় কমিটি রয়েছে তাদের। এর মধ্যে দলের জাতীয় কাউন্সিলের পর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও ভোলাসহ বেশ কয়েকটি জেলার কাউন্সিল শেষ করা হয়। এর বাহিরের অধিকাংশ জেলা মেয়াদোত্তীর্ণ। তবে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোর দ্রুত কাউন্সিলের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এই কাউন্সিলগুলোর মধ্যদিয়ে রাজনৈতিকভাবে নির্মোহ, তাদের মূল্যায়ন করা হবে। মূলত দলকে সাংগঠনিক ভাবে শক্তিশালী করতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, বর্তমান সময়ে জাসদের মাঠপর্যায়ের অনেক নেতা নিষ্ক্রিয়। দিবসভিত্তিক কর্মসূচির বাহিরে দেখা যায় না তাদের। কাগজে-কলমে থাকা এসব কমিটির নেই তেমন কোনো সাংগঠনিক তৎপরতা। তবে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু।
তিনি যুগান্তরকে বলেন, কোথায় নিষ্ক্রিয়? আমি কোথাও কর্মসূচি দিলে কি নেতাকর্মী হয় না? এসব তথ্য সঠিক নয়। তবে সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার যুগান্তরকে বলছেন, এটা সত্য যে, আমাদের দলীয় যে কার্যক্রম, সে কার্যক্রমে আমরা শরিক দলগুলো সবাই পিছিয়ে আছি। দলের কাজগুলো আমরা সেভাবে করিনি। এটা ঠিক। এর মাঝে আমরা যে কাজগুলো করেছি। সেগুলো সামনে আসেনি।
তিনি বলেন, দলের সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে এ বছরকে আমরা সাংগঠনিক বছর হিসাবে ঘোষণা করেছি। এই কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে দলকে আমার নতুনভাবে এগিয়ে নিয়ে যাব। এতে করে আমাদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
১৪ দলীয় জোটের আরেক শরিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। দলটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। দীর্ঘদিন দলের নেতৃত্বে থাকলেও কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করতে পারেননি তারা। ফলে দলের নেতারা রাজনীতির মাঠে অনেকটাই নিষ্ক্রিয়।
দলটির দপ্তর সূত্রের দাবি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি মোট সাংগঠনিক জেলার সংখ্যা ৬৬টি। প্রায় চার শতাধিক উপজেলায় রয়েছে কমিটি। তারা সবাই রাজনীতির মাঠে সক্রিয়। চলমান উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের মাঠেও ভূমিকা রাখছেন তারা। তৃণমূল সূত্রে জানা যায়, বিশেষ কয়েকটি জেলা ছাড়া অধিকাংশ স্থানেই বেহাল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। জেলা-উপজেলায় কমিটি থাকলেও নেই কার্যক্রম। মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ ও আন্দোলন-সংগ্রামে দেখা যায় না তাদের। অনেক জেলায় নেই দলীয় কার্যালয়। তারাও নিজেদের বাসা-বাড়ি ও ব্যক্তিগত অফিসে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা যুগান্তরকে বলেন, সব স্থানেই আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম আছে। কোথাও বেশি, কোথাও কম। আমরা দুটো কাজ করতে চাই। তার মধ্যে সব জেলাগুলোকে সক্রিয় করতে চাই। এটাই আমাদের এখন মূল কাজ।
শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক রাজনীতি করে টিকে আছে জোটের আরেক শরিক বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল। তারা দীর্ঘদিন জোটের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তৃণমূল পর্যায়ে নিজেদের মেলে ধরতে পারেনি। গঠন করতে পারেনি জেলা-উপজেলা কমিটি। যদিও নামমাত্র কয়েকটি জেলায় কমিটি রয়েছে তাদের। তবে সেসব কমিটির নেতারাও রাজনীতিতে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখতে পারছেন না। অনেকে স্থানীয় এমপিদের লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তারা। বলা চলে রাজনীতিতে পুরোপুরি আওয়ামী লীগনির্ভর রাজনীতি করেন সাম্যবাদী দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী।
সাম্যবাদী দলের সর্বশেষ জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালে। চার বছর পরপর জাতীয় কংগ্রেস হওয়ার কথা থাকলেও তা আর সম্ভব হয়নি। যে সব জেলায় কমিটি আছে, সেগুলোও মেয়াদোত্তীর্ণ। তাদেরও নেই নিজস্ব পার্টি অফিস। দলীয় জোট শরিকের বাকি দলগুলোর একই অবস্থা বলে জানা গেছে।