সবজির ট্রাক : ‘যশোর টু কাওরান বাজার’
পুলিশের সামনেই চাঁদা তোলে মাস্তান বাহিনী
ইয়াসিন রহমান
প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পুলিশের সামনেই চাঁদা তোলে মাস্তান বাহিনী
ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির কাছ থেকে রীতিমতো ঘুসের টোকেন কার্ড কিনে পণ্য পরিবহণের গাড়ি রাস্তায় চালাতে হচ্ছে। এক মাস মেয়াদি এই টোকেন ১৫০০ টাকায় কিনলে এই সময়ে পুলিশি ঝামেলা মাফ। ভুল করে ধরলেও ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির হটলাইন সেবার মাধ্যমে তাৎক্ষণিক ট্রাক ছাড়ানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়। এছাড়া পরিবহণ সংগঠন ও সিটি করপোরেশনের রসিদ দিয়েও ২০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হচ্ছে। কিন্তু এসব টাকা না দিলে রক্ষা নেই। পরিবহণের ড্রাইভার ও হেলপারের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। এমনকি ভেঙে দেওয়া হয় গাড়ির মূল্যবান গ্লাস। অনেক ক্ষেত্রে সবই ঘটে পুলিশের সামনে। পরিবহণ সেক্টরের এসব ভাড়া করা ‘মাস্তান বাহিনী’ বড়ই অধরা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এবং রোববার সরেজমিন যশোর থেকে ট্রাকে করে কাওরান বাজার আসার সময় পরিবহণ চাঁদাবাজির নানা চিত্র দেখা গেছে।
সরেজমিন যশোর টু কাওরান বাজার : রোববার সকাল ৭টা। যশোরের সাতমাইল বারিনগর বাজারে উপস্থিত সবজি ব্যাপারী মো. জুলহাস (ছদ্দনাম)। বিকাল সাড়ে ৩টা নাগাদ লাউ, পটোলসহ একাধিক সবজি মিলে মোট ৩ টন সবজি ট্রাকে তোলা হয়। বাজার কমিটি মনপ্রতি ৬ টাকা চাঁদা নেয়। ফলে শুরুতেই ৩ টন বা প্রায় ৮১ মন সবজিতে চাঁদা গুনতে হয় ৪৮০ টাকা।
বিকাল ৪টা। যশোরের সাতমাইল বাড়িনগর বাজার থেকে ঢাকা মেট্রো-ড-১৪... (প্রকাশ করার না শর্তে পুরো নম্বর দেওয়া হলো না) সিরিয়ালের একটি ট্রাকে চেপে যুগান্তর প্রতিবেদক হেলপারের ছদ্মবেশে ঢাকার কাওরান বাজারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। পদ্মা সেতু পার হয়ে ধলেশ্বরী ব্রিজ দিয়ে সরাসরি কেরানীগঞ্জ আসতে রাত তখন পৌনে ৯টা। এর মধ্যে দুই সেতু টোল বাবদ ১ হাজার ৮৫০ টাকা ছাড়া সড়কে কোথাও চাঁদা দিতে হয়নি। তবে ট্রাক যখন কেরানীগঞ্জ কদমতলীর মোড়ে এসে পৌঁছায় তখন ঘটে বিপত্তি। মোড় পার হতেই নেমব্যাজ ছাড়া পুলিশের ইউনিফরম পরা জনৈক কনস্টেবল ট্রাকটি আটকিয়ে দেয়। ড্রাইভারের জানালা দিয়ে হাত বাড়ায়। চান টাকা। ৫০ টাকা ধরিয়ে দিলে রেহাই মেলে।
এরপর জ্যাম ঠেলে সবজিবাহী ট্রাক ধীরগতিতে বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতু পার হয়ে নয়াবাজার এলাকা পৌঁছাতেই প্রকাশ্যে হাজির হয় কয়েকটি যুবক। গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভারের কাছ থেকে চাঁদা নেয় ২০০ টাকা। চাঁদার রসিদ না দেওয়ায় ড্রাইভার তার কাছে রসিদ চায়। পরে ঢাকা জেলা ট্রাক ট্যাংকলরি কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানারে রশিদ নং ১৩৯৫৯, রেজিস্ট্রেশন নং- ১৫২১ রসিদে কোনো স্বাক্ষর ছাড়াই ইউনিয়নের পরিচালিত ব্যয় ও সার্ভিস চার্জসহ ৫০ টাকার একটি রসিদ দেওয়া হয়। রাত তখন সাড়ে ১০টা।
এরপর ট্রাকটি জ্যাম ঠেলে চলতে চলতে গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রাত ১১টায় এসে পৌঁছায়। সেখানে দিতে হয় ২০০ টাকা। রসিদ চাইলে দেওয়া হয় স্বাক্ষর ছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ব্যানারে ইজারাদার-৭ ইলেভেন এন্টারপ্রাইজের রসিদ। যার নং ৪৩০৮২। চাঁদার পরিমাণ লেখা ছিল ৫০ টাকা। অর্থাৎ চাঁদার কাগজ সঠিক ধরলেও প্রতি গাড়িতে অবশিষ্ট ১৫০ টাকা অতিরিক্ত হাতিয়ে নিচ্ছে চাঁদাবাজ মাস্তান বাহিনী।
এবার ট্রাকটি জিপিও হয়ে শাহবাগ, বাংলামোটর পার হয়ে কাওরান বাজার পেট্রোবাংলা ভবনের সামনে রাস্তায় আসতেই সরব হয়ে ওঠে একাধিক যুবক। ট্রাকসংশ্লিষ্টরা ওদের নাম দিয়েছে মাস্তান বাহিনী। বাহিনীর সদস্যরা ট্রাকের সামনে এসে প্রথমেই মালামাল দ্রুত আনলোড করতে বলে। পরে বের হয়ে যাওয়ার সময় টাকা রেডি রাখতে বলে।
এদিকে যেমন কথা তেমন কাজ। পেট্রোবাংলা ভবনের সামনে দিয়ে রাত ১১টা ২০ মিনিপে ট্রাকটি বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন ভবনের সামনে দাঁড়ায়। শুরু হয় সবজি নামানোর কাজ। দেড় ঘণ্টা ধরে সবজি নামানোর পর ঝাড়ুদার ও লেবারদের ২০০ টাকা করে ৪শ টাকা চাঁদা দিয়ে আবার পেট্রোবাংলা ভবনের সামনে আসতেই একজন যুবক ট্রাক থামিয়ে ৮০০ টাকা চাঁদা চায়। পরে ৭০০ টাকায় দফারফা হয়। এরপর ট্রাকটি যাওয়ার অনুমতি মেলে। কিন্তু চাঁদা নেওয়ার সময় ১০ হাত দূরেই দাঁড়িয়েছিল পুলিশের একটি কাভার্ডভ্যান। কিন্তু রক্ষকরা সবাই নির্বিকার। জেনেশুনে চুপ। এভাবে ‘যশোর টু কাওরান বাজার’ সবজি ট্রাকে চাঁদাবাজির সরেজমিন অনুসন্ধানের পোস্টমর্টেম করা হয়। বেরিয়ে আসে চাঁদাবাজির সাতকাহন।
এদিকে যশোর থেকে কাওরান বাজার আসার পথে প্রায় ১৮৮ কিলোমিটার রাস্তায় মোট চাঁদা দিতে হয় ২ হাজার ৩০ টাকা। এছাড়া এক মাস মেয়াদি সূচনা ট্রান্সপোর্টের একটি কার্ড ১৫০০ টাকায় কিনে নিতে হয়। সেক্ষেত্রে একদিনে চাঁদার পরিমাণ হয় ৫০ টাকা। ফলে সব মিলে চাঁদা গুনতে হয় ২ হাজার ৮০ টাকা।
ট্রাক ড্রাইভার শরিফ (ছদ্মনাম) যুগান্তরকে আরও কিছু ভয়াবহ তথ্য দেন। তিনি বলেন, যশোর থেকে প্রতিদিন কাঁচামালবাহী প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ ট্রাক যাওয়া-আসা করে। সেক্ষেত্রে এই রুটেই দিনে প্রায় ৬ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এছাড়া লাইসেন্স নং ০১৫৫৬৮ সূচনা ট্রান্সপোর্টের একটি কার্ড এক মাসের জন্য ১৫০০ টাকা করে কিনে নিতে হয়। এই এক মাস মেয়াদের কার্ড সঙ্গে থাকলে সমগ্র বাংলাদেশের যে কোনো রাস্তায় পুলিশ ট্রাক থামালেও মামলা দেয় না। যদি পুলিশ ধরে তাহলে এই ট্রান্সপোর্টের অফিসের জরুরি সেবা চারটি হটলাইন নম্বর দেওয়া আছে। নম্বরগুলো হচ্ছে-০১৩৩১০৮১২২৩, ০১৩৩১০৮১২২৪, ০১৩৩১০৮১২২৫ ও ০১৩৩১০৮১২২৬। এই নম্বরে কল করে বলতে হয় কোন সার্জেন্ট ধরেছে। পরে তারা যোগাযোগ করলে ট্রাক ছেড়ে দেয়। তাছাড়া ট্রান্সপোর্টের এই কার্ড না থাকলে সঙ্গে সঙ্গে মামলা দিয়ে দেয়। তিনি জানান, এই ট্রান্সপোর্টের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘুসের মাসিক চুক্তি করা আছে। নিজেরা কমিশন রেখে দিয়ে বাকি টাকা একসঙ্গে পুলিশকে দেওয়া হয়।
তিনি জানান, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা পায় তাই রাখে। এছাড়া যারা রাস্তায় বিভিন্ন সংগঠনের নাম করে টাকা তোলে তাদের একদিন চাঁদা না দিলে গাড়ির গ্লাস ও লুকিং গ্লাস ভেঙে দেয়। গায়ে হাত তোলে। ধরেন চাঁদা চাইল ৩০০ টাকা, পকেটে আছে ২০০ টাকা। সেক্ষেত্রে ১০০ টাকা দেয়নি বলে ট্রাকের সামনের ১৫-২০ হাজার টাকার গ্লাস ভেঙে দেবে। কিছুই করার নেই।’
তিনি আরও বলেন, এই রুট ছাড়াও পোস্তাগলা ব্রিজ থেকে নামার পর ৫০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। এটার কোনো রসিদ নেই। তবে যারা চাঁদা তোলে তাদের মাথায় হলুদ কাপড় বাঁধা থাকে। হাতে থাকে লাঠি। এখান থেকে যেতে না যেতেই দয়াগঞ্জের মোড়ে ১০০-৩০০ টাকা দিতে হয়। পোস্তাগলা ব্রিজ পার হয়ে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারে ওঠার আগের সিগন্যালে সিটি করপোরেশনের ব্যানারে আরও ২০০-৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এরপর ডেমরা ফ্লাইওভারের সামনে গেলে মাথায় হলুদ কাপড় বাঁধা চাঁদাবাজদের দিতে হয় ২০০-৬০০ টাকা। কাজলা-চিটাগাং রোডেও একই অবস্থা। সবই হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে দিয়ে। এমনো হয়, পুলিশের গাড়ি সামনেই দাঁড়ানো থাকে, কিন্তু তারা কিছুই বলে না।’