সোমালি জলদস্যুর ডেরায় ‘এমভি আবদুল্লাহ’
২৩ নাবিক সুস্থ আছেন তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে-খুরশেদ আলম, মারিটাইম অ্যাফেয়ার্স সচিব
মজুমদার নাজিম উদ্দিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এমভি আবদুল্লাহ
ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার প্রায় ৫০ ঘণ্টা পর বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ সোমালিয়ার গ্যারাকাড উপকূলের ২০ নটিক্যাল মাইল দূরে নোঙর করেছে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সাধারণ সম্পাদক ক্যাপ্টেন সাখাওয়াত হোসেন এ তথ্য জানিয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মারিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম বলেছেন, জাহাজে থাকা ২৩ বাংলাদেশি নাবিক সুস্থ আছেন। তারাসহ জাহাজটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
গ্যারাকাড উপকূল সোমালি জলদস্যুদের নিরাপদ ডেরা ও স্বর্গরাজ্য হিসাবে পরিচিত। ছিনতাই করা জাহাজ এ এলাকায় এনে রাখে জলদস্যুরা। এরপর আদায় করে মুক্তিপণ। গ্যারাকাড সোমালিয়ার একটি উপকূলীয় শহর ও সমুদ্রবন্দর।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের মালিকপক্ষ চট্টগ্রামভিত্তিক কেএসআরএম স্টিলের মালিকানাধীন এসআর শিপিং-সংশ্লিষ্ট সূত্রও জাহাজটি নোঙর করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তারা বলেছে, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে জাহাজটি সোমালিয়ার গ্যারাকাড বন্দরসংলগ্ন এলাকায় ভিড়িয়েছে জলদস্যুরা। এর ২৩ জন নাবিক নিরাপদে রয়েছেন। এখন পর্যন্ত জলদস্যুদের সঙ্গে মালিকপক্ষের কোনো যোগাযোগ হয়নি। তবে তাদের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে।
এদিকে জিম্মি জাহাজটির চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান বৃহস্পতিবার বিকালে তার ভাই আসিফের সঙ্গে যোগাযোগ করে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করেছেন। আতিক উল্লাহর বোনের স্বামী ব্যাংকার আজিজুল হক তার শ্যালক আসিফের বরাত দিয়ে যুগান্তরকে জানান, সোমালিয়ার উপকূলে নোঙর করার পর দস্যুদের আরও ৪০-৫০ জনের একটি গ্রুপ জিম্মি করা ওই জাহাজে উঠেছে। তারা একটি কেবিনে নাবিকদের বন্দি করে রেখেছে। খাবারদাবার দিচ্ছে, তবে পরিমাণমতো দিচ্ছে না। সোমালিয়ার দিকে যাওয়ার সময় একটি যুদ্ধজাহাজ ছিনতাই হওয়া এমভি আবদুল্লাহর পিছু নিয়েছিল। কিন্তু জলদস্যুরা ওই জাহাজকে ফাঁকি দিয়ে সোমালিয়া উপকূলের দিকে চলে যেতে সক্ষম হয় বলেও জানান জাহাজের চিফ অফিসার।
একাধিক সংবাদমাধ্যমে ৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণ দাবির তথ্য দেওয়া হলেও এসআর শিপিং কর্তৃপক্ষ বলছে, এমন কোনো বিষয় তাদের জানা নেই। যেখানে দস্যুদের সঙ্গে এখনো কোনো যোগাযোগই হয়নি, সেখানে মুক্তিপণ দাবির সুযোগ কোথায়। তবে প্রতিষ্ঠানটি মনে করছে, সোমালি জলদস্যুরা জাহাজ ও নাবিকদের জন্য মুক্তিপণ চাইতে পারে। তারা আগে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তাই মুক্তিপণ চাইতে আরও ২-৩ দিন সময় নিতে পারে।
বিএমএমওএ সাধারণ সম্পাদক ক্যাপ্টেন সাখাওয়াত হোসেন ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরো থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে জানান, বৃস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে জাহাজটি গ্যারাকাড উপকূল থেকে ৭২ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছিল। বেলা পৌনে ১টার দিকে এটি উপকূল থেকে ২০ নটিক্যাল মাইল দূরে নোঙর করেছে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত জলদস্যুদের পক্ষ থেকে জাহাজ মালিকের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি। কোনো মুক্তিপণও চাওয়া হয়নি।
তবে নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, সন্ধ্যায় জাহাজটিকে গ্যারাকাড উপকূলের ৭ নটিক্যাল (১৩ কিমি.) মাইল দূরে নিয়ে নোঙর করায় দস্যুরা। সমুদ্রের এ এলাকা পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে।
কেএসআরএম-এর একজন মুখপাত্র বৃহস্পতিবার দুপুরে যুগান্তরকে জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে সর্বশেষ জাহাজের নাবিকদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়েছে। নাবিকরা জানিয়েছেন, তারা ভালো আছেন। সেহরি ও ইফতারেরও সুযোগ দিচ্ছে। এই মুখপাত্র আরও জানান, তারা নাবিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। এজন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
এসআর শিপিংয়ের সিইও মেহেরুল করিম যুগান্তরকে বলেন, জলদস্যুরা জাহাজটি সোমালিয়ার গ্যারাকাড উপকূলে নিয়ে নোঙর করেছে। তাদের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আমরা অপেক্ষায় আছি কখন তারা যোগাযোগ করে। জাহাজের নাবিকরা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। সেই সূত্রে আমরা যতটুকু তথ্য পাচ্ছি তাতে বলা যায়, নাবিকরা নিরাপদে আছেন।
২৩ নাবিক সুস্থ আছেন : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ম্যারিটাইম অ্যাফেয়ার্স সচিব মো. খুরশেদ আলম বলেন, ২৩ বাংলাদেশি নাবিক সুস্থ আছেন। তাদেরসহ জাহাজ ফেরত আনাই আমাদের প্রথম লক্ষ্য এবং সেই লক্ষ্য থেকে আমরা বিচ্যুত হব না। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, গণমাধ্যমে মুক্তিপণের কথা প্রকাশিত হয়ে থাকলে তা কল্পিত। আমাদের কাছে এখনো কোনো মুক্তিপণ তারা চায়নি, মুক্তিপণের ব্যাপারে কোনো যোগাযোগও করেনি।
খুরশেদ আলম বলেন, জলদস্যুরা আমাদের সঙ্গে এখনো কোনো যোগাযোগ করেনি। বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা খবর রাখছি, জলদস্যুদের প্রায় ৬০ জন জাহাজে অবস্থান নিয়েছে এবং বাংলাদেশি ২৩ নাবিক সুস্থ আছেন।
সচিব বলেন, এ বিষয়ে আমাদের আগের অভিজ্ঞতা আছে। জাহান মনি নামের একটি জাহাজ ২০১০ সালে এমন ঘটনার মুখে পড়েছিল। ১০০ দিনের মাথায় সব নবিকসহ জাহাজটি আমরা ফেরত আনতে পেরেছিলাম।
সরকারের তৎপরতা নিয়ে তিনি বলেন, আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টায় আছি। নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী, নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জাহাজের মালিকসহ সব পক্ষের সঙ্গে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে। তিনি আরও বলেন, আমরা এখনো জানি না জলদস্যুদের কী দাবিদাওয়া। আমরা যদি জানতে পারি, তখন হয়তো কৌশলগতভাবেই গণমাধ্যমকে পুরোপুরি জানাতে পারব না।
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ১০টায় এমভি আবদুল্লাহ সোমালিয়ার মোগাদিসু থেকে প্রায় ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার মুজাম্বিকের মাফুতু বন্দর থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে জাহাজটি শারজার হামারিয়া বন্দরে যাচ্ছিল। ক্যাপ্টেনসহ ২৩ নাবিককে জিম্মি করে জলদস্যুরা। স্বজনদের সঙ্গে নাবিকরা হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলে বিষয়টি জানাজানি হয়। তবে ওইদিন সন্ধ্যা ৭টার পর সবার মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছে।