রেস্তোরাঁয় সাঁড়াশি অভিযান
তিন সংস্থা ও রেস্তোরাঁ মালিক মুখোমুখি
নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ অভিযান -রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি * মালিকরা নিয়ম না মানায় অগ্নিঝুঁকি বাড়ছে, এজন্যই অভিযান -সংস্থাগুলোর অভিমত
মতিন আব্দুল্লাহ
প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানীর বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় সাঁড়াশি অভিযান নিয়ে সরকারের তিন সংস্থা ও মালিকরা মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। রাজউক, সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস বলছে, রেস্তোরাঁ মালিকরা নিয়ম না মানায় অগ্নিঝুঁকি বাড়ছে। ঘটছে বড় দুর্ঘটনা। এজন্যই অভিযান। অন্যদিকে রেস্তোরাঁ মালিকদের অভিযোগ-নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই অন্যায়ভাবে অভিযান শুরু করেছে। ভাঙচুর ও গ্রেফতার করছে। এই শিল্প রীতিমতো ধ্বংসের উপক্রম হয়েছে। ঝুঁকিতে পড়েছে পাঁচ লাখ লোকের কর্মসংস্থান।
২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর রোববার থেকে পুলিশ ও সোমবার থেকে রাজউক, সিটি করপোরেশন এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর অভিযান শুরু করেছে। ইতোমধ্যে অর্ধশতাধিক ভবন ও রেস্তোরাঁ সিলগালা, জরিমানা ও ভাঙচুর হয়েছে। আর পুলিশি অভিযানে প্রসিকিউশনে প্রায় ১ হাজার গ্রেফতার করে আদালত থেকে জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ অভিযানের প্রতিবাদে মঙ্গলবার রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলন করেছে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি। সেখানে সংগঠনের নেতারা অভিযোগ করেছেন-রাজউকের আইনে রেস্তোরাঁ বলে কোনো ভবন ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট ক্যাটাগরি নেই। এজন্য রাজধানীর বাণিজ্যিক ভবনে রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর জনরোষ থেকে বাঁচতে ভিন্ন ক্যাটাগরির ব্যবহারের দায়ে অনুমোদিত রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে সিলগালা করা হচ্ছে। রেস্তোরাঁ মালিক ও কর্মচারীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। জরিমানা করছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। স্থাপনা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে জনরোষ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে তারা। এ সময় রাজউক, সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শকদের মাসোহারায় তারা অতিষ্ঠ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি রেস্তোরাঁ করতে হলে সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। এর আগে ওই ভবনটি রেস্তোরাঁ করার জন্য উপযোগী কি না, তা দেখতে হয়। রেস্তোরাঁ ক্যাটাগরি না থাকায় বাণিজ্যিক ব্যবহার অনুমোদন থাকতে হয়। এ তিনটি পর্ব সঠিকভাবে সম্পাদন করা হলে রেস্তারাঁগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হতো না। বাণিজ্যিক ভবনে রেস্তোরাঁ গড়ে তোলা তেমন দোষের বিষয় নয়, সেখানে ফায়ার সার্ভিস বিভাগ অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়গুলো যথাযথভাবে দেখলে পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ হতো না। এখানে রাজউকের চেয়ে বড় ব্যর্থতা সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের। এ দুই সংস্থার পরিদর্শকরা অগ্নিনিরাপত্তা ও পরিবেশ উপযোগিতার বিবেচনা না করে অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ হয়ে চুপ থাকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজউক এলাকায় একতলা থেকে বহুতলা ভবন রয়েছে ৫ লাখ ১৭ হাজার। এসব ভবন ও স্থাপনায় প্রায় ৩০ হাজার রেস্তোরাঁ রয়েছে। রেস্তোরাঁগুলোয় প্রায় ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ঘটেছে। ব্যবসায়ীদের ব্যাংকঋণ রয়েছে। আর এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা খুব ধনী নন। ছোট ও মধ্যম পর্যায়ের ব্যবসায়ী। হঠাৎ সাঁড়াশি অভিযানে রেস্তোরাঁ মালিকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের অভিযানে মানুষের মনে রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের বিষয়ে খুবই নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। এখন মানুষ রেস্তোরাঁয় খেতে আসছে না। আইনে রেস্তোরাঁ ক্যাটাগরি না থাকলেও রাজউক, সিটি করপোরেশন অন্যায়ভাবে বিভিন্ন স্থাপনা ভেঙে দেওয়া, সিলগালা করাকে তাদের ওপর জুলম করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইমরান হাসান যুগান্তরকে বলেন, রাজউকের বিদ্যমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় রেস্তোরাঁ বলে কোনো ক্যাটাগরি নেই। এজন্য বাণিজ্যিক স্থাপনায় রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। কেননা রেস্তোরাঁ তো একটি ব্যবসা। এতে দোষের কিছু নেই।
তিনি বলেন, রেস্তোরাঁগুলোয় পরিবেশ ও অগ্নিনিরাপত্তা দেখার দায়িত্ব সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস বিভাগের। কিন্তু তারা তা করছে না। উপরন্তু মাসে মাসে পরিদর্শকদের মাসোহারা দিতে হয়। এসবের বিনিময়েও যদি তারা আমাদের অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়গুলো দেখে পরামর্শ দিত, তাতেও আমরা উপকৃত হতাম। কিন্তু তারা এসব কিছু করছে না।
তিনি জানান, দেশে প্রায় ৫ লাখ রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। সেখানে ১১ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান ঘটেছে। ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় প্রায় ৩০ হাজার রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। সেখানে প্রায় ৫ লাখ কর্মসংস্থান ঘটেছে। স্বল্প ও মধ্যম পুঁজির মানুষেরা রেস্তোরাঁ ব্যবসায় সম্পৃক্ত। বেশির ভাগের ব্যাংকঋণ রয়েছে। তিন নগর সংস্থা কোনো কিছু বিবেচনা না করে নিজেদের ব্যর্থতা ও দুর্নীতি ঢাকতে রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের ওপর অন্যায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ৩০৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকা। এ অংশে সরকারি হিসাবে ১ কোটির বেশি মানুষের বসবাস। বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবে দেড় থেকে দুই কোটি মানুষের বসবাস। প্রতি একরে জনঘনত্ব ১০০ থেকে ১২০ জন থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে ৫০০ থেকে ৬০০ জন বসবাস করছে। কোথাও ১ থেকে ২ হাজার মানুষও বসবাস করছে। পুরান ঢাকার লালবাগ জনঘনত্ব বিবেচনায় বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে। আর চকবাজার ও কোতোয়ালি এলাকাও শীর্ষ ৫-এ অবস্থান করছে।
তারা আরও বলছে, স্বল্প এলাকায় বেশি মানুষ হওয়ায় ভবন বেড়েছে এই শহরে। উন্মুক্ত জায়গা, খেলার মাঠ এবং গণপরিসর নেই। মানুষ একটু স্বস্তির জন্য রেস্তোরাঁকে বেছে নেয়। অবশ্য সেই রেস্তোরাঁ নিরাপদ হতে হবে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে তো আইন না মানার প্রবণতা থাকবে। এজন্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে সক্রিয় হতে হবে। কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে তা না করায় নগরীর ঝুঁকি বেড়েছে।
তারা জানান, রাজউক এলাকার ৬১ শতাংশ ভবন অনুমোদনহীন, অনুমোদিত ৭৭ শতাংশ ভবন ব্যবহার ক্যাটাগরি মানছে না, ৯০ শতাংশ ভবনের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। অকুপেন্সি সার্টিফিকেট বা ব্যবহার অনুমোদনপত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক থাকলেও তারা তা মানছে না। বছরের পর বছর এসব চলে এলেও রাজউক তা দেখেও না দেখার ভান করে চলেছে। দায় এড়াতে পারে না সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অন্যান্য সেবা সংস্থা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, রেস্তোরাঁর অগ্নিনিরাপত্তা ত্রুটি বা ভবনের ব্যবহারবিধি না মানার দায় রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন এড়াতে পারে না। পাশাপাশি পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অন্যান্য সেবা সংস্থারও দায় রয়েছে। তবে ব্যবহারকারী ও সেবাগ্রহীতাদেরও এসব বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। রাজউককে ভবনের নিরাপত্তা ও ফিটনেস যাচাইয়ের ত্রুটিগুলো সংশোধনে তৎপর হতে হবে। আইনের কোনো ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো যুক্ত করতে হবে।
অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী মো. হাসমতুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও রাজউকের আইনের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। এটা সংশোধন করতে হবে। পাশাপাশি অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আইনের ফাঁকগুলো দূর না করলে সমস্যার সমাধান হবে না।
তিন সংস্থা যা বলল : রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা যুগান্তরকে বলেন, ঢাকায় ৫ লাখের বেশি ভবন রয়েছে। রাজউকের বিদ্যমান জনবল দিয়ে এত বিশাল ভবনের কোথায় কী ব্যবহার হচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতার দুর্বলতার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ দুর্বলতা আমরা স্বীকার করছি। পাশাপাশি তা থেকে উত্তরণে থার্ড পার্টিকে নকশা যাচাই-বাছাই ও ভবন পরিদর্শনের দায়িত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এই ধাপে যেতে পারলে পরিস্থিতির অনেকাংশে উন্নতি ঘটবে।
তিনি বলেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় সরাসরি রেস্তোরাঁ ক্যাটাগরি না থাকলেও জনসমাগমস্থল বলে একটি ক্যাটাগরি রয়েছে। ওই ক্যাটাগরিতে রেস্তোরাঁর ব্যবহার অনুমোদন দেওয়া হয়ে থাকে। এটা সবাই জানেন। তবুও তারা না মানার অজুহাত দেখাতে এসব কথা বলছেন।
তিনি জানান, বিল্ডিং কোড ২০০৬-এর আলোকে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। সেখানে রেস্তোরাঁ বলে আলাদা কিছু ছিল না। অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়গুলোও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যার প্রভাব পড়েছে ইমারত নির্মাণবিধিমালায়। তবে ২০২০ সালের বিল্ডিং কোডে রেস্তোরাঁর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে। এর আলোকে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধনের কাজ চলমান রয়েছে। এ বিধিমালা পাশ হলে বিদ্যমান অস্পষ্টগুলো দূর হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ভবনের নির্মাণ অনুমোদন দেয় রাজউক। সেখানে অনেক ধরনের গাফিলতি রয়েছে। তারা অকুপেন্সি বা ভবন ব্যবহারের সনদ নিশ্চিত করতে পারেনি। আর কোনো ভবনে ওই ভবনের ব্যবহার কী, তা টানানোও থাকে না। এজন্য সিটি করপোরেশন সবক্ষেত্রে সব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করতে পারে না। এখন থেকে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা অবলম্বন করা হবে।
তিনি জানান, সেবা সহজীকরণ এখন সরকারের বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে সব কাগজ দেখে দিতে গেলে ভোগান্তি বাড়বে। এক্ষেত্রে সহজ পথটা রাজউককে তৈরি করতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া মুখপাত্র শাহজাহান সিকদার বলেন, রেস্তোরাঁর অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়গুলো বিশেষভাবে দেখভাল করা হয়। শুরুর দিকে রেস্তোরাঁ মালিকরা তা যথাযথভাবে মেনে চলেন। কিছুদিন যাওয়ার পর তারা অবহেলা শুরু করেন। এমন সময়ে ফায়ার সার্ভিস নোটিশ দিয়ে থাকে। কিন্তু ভবন মালিকরা এসব মানতে চান না। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ফায়ার সার্ভিস বিভিন্ন সময়ে অভিযানও পরিচালনা করে থাকে।