বিদ্যুতে ভর্তুকির ৪৩ হাজার কোটি টাকা বকেয়া
দায় মেটাতে দুই কৌশল
২৭ ব্যাংকের মাধ্যমে ৬ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যু * মূল্যবৃদ্ধি কার্যকর আগামী সপ্তাহে * অর্থনীতিতে দীর্ঘ মেয়াদে চাপ থেকেই যাচ্ছে -মাহবুব আহমেদ

মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এ মুহূর্তে বিদ্যুতের মোট বকেয়া ভর্তুকির পরিমাণ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। বড় অঙ্কের দায় মেটাতে মার্চেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এতে প্রতি ইউনিটের মূল্য বাড়বে ৩৪-৭০ পয়সা। ভর্তুকির দায় মেটানোর বিকল্প কৌশল হিসাবে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে বন্ড ইস্যু করে ঋণ নেওয়া হচ্ছে। ঋণের অর্থ দিয়ে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর বকেয়া ভর্তুকি পরিশোধ করা হবে। ইতোমধ্যে ২৭টি ব্যাংকের মাধ্যমে বন্ড ইস্যু হয়েছে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার। এসব বন্ডের মেয়াদ শেষে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে আসল ও সুদ পরিশোধের জন্য ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ পরবর্তী ১০ অর্থবছরের বাজেটে (২০২৪-৩৪) বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
বিদ্যুতের ভর্তুকি অর্থনীতিকে বড় ধরনের চাপে ফেলছে। এ ভর্তুকির অঙ্ক বেড়েছে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে। এছাড়া রয়েছে মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। গত দুবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ে রেকর্ড হয়েছে। বকেয়ার অঙ্ক বেশি থাকলেও চলতি অর্থবছরে বাজেটে বিদ্যুতে ভর্তুকিতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩৩ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা এবং আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) বাজেটে বরাদ্দ ছিল ২৪ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। কিন্তু এই ভর্তুকির অর্থও দুবছর ধরে পুরোপুরি ছাড় করতে পারছে না অর্থ বিভাগ। যে কারণে বকেয়ার পরিমাণ বেড়েই চলছে।
মঙ্গলবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন, মার্চ থেকেই গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৩৪ থেকে ৭০ পয়সা বাড়তে পারে। তিনি আরও বলেন, বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ পড়ে ১২ টাকা। কিন্তু বিক্রি করতে হচ্ছে ৪ থেকে ৭ টাকা। এখন মার্চের প্রথম সপ্তাহে সমন্বয় করা হবে। জ্বালানির ওপর বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ওঠানামা করে। এর সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। আমরা বিদ্যুতের ভর্তুকি থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়েছি। এজন্য মূল্য সমন্বয় করা হবে। এর আগে বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তের মধ্যে ভর্তুকি থেকে বের হয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। এজন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ভর্তুকি কমিয়ে আনতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথাও জানানো হয়েছে আইএমএফ প্রতিনিধিদলকে।
সূত্রমতে, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র করার সময় মার্কিন ডলারের দাম ৭০ থেকে ৮০ টাকা ধরে হিসাব করা হয়েছিল। এখন ডলারের দাম ৪০ টাকা বেড়ে গেছে। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। জ্বালানি খরচের ওপর ভিত্তি করে সারা বিশ্বেই দাম সমন্বয় করা হয়। বিদ্যুৎ খাতে সরকার বছরে ভর্তুকি দেয় ৪৩ হাজার কোটি টাকা।
গত বছর তিন দফায় সরকার ১৫ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ায়। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১২ বার আর পাইকারি পর্যায়ে ১০ বার।
জানতে চাইলে সাবেক অর্থসচিব (সিনিয়র) মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে দক্ষতা বাড়াতে হবে, অবচয় বন্ধ ও চুরি রোধ করে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি এ খাতের ভর্তুকি কমাতে হবে। এ খাতের লোকসান কমাতে না পারলে ভর্তুকি বাড়তেই থাকবে। তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ খাতে বকেয়া ভর্তুকি বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির। তাদের এই অর্থ পরিশোধ করতে বন্ড ছেড়ে টাকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এতে সাময়িক সময়ে অর্থনীতিতে চাপ পড়বে না। কিন্তু ভবিষ্যতে এই বন্ডের অর্থ পরিশোধ করতে হবে। ওই সময় অর্থনীতিতে চাপ পড়বে। ফলে অর্থনীতির চাপ থেকেই যাচ্ছে।
সূত্রমতে, বিদ্যুতের বকেয়া ভর্তুকি পরিশোধের জন্য ৮ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি এই পাঁচদিনে সরকারি ও বেসরকারি ২৭টি ব্যাংকের মাধ্যমে ৫ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকার বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট শরিয়াভিত্তিক স্পেশাল বন্ড এবং স্পেশাল ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা হয়। এসব বন্ড হচ্ছে ৮, ৯ ও ১০ বছর মেয়াদে। এর মধ্যে ঢাকা ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় ৭৭৯ কোটি, জনতা ব্যাংক ৬৬৬ কোটি, প্রাইম ব্যাংক ৮২২ কোটি, সোনালী ব্যাংক প্রায় ৫০৫ কোটি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ৩৩০ কোটি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ৩৪০ কোটি এবং ব্র্যাক ব্যাংক ৬২৩ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করেছে। এছাড়া এবি ব্যাংক ১৭২ কোটি, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক প্রায় ১২১ কোটি, মেঘনা ব্যাংক ১৩৫ কোটি, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক প্রায় ১৮৭ কোটি, ট্রাস্ট ব্যাংক প্রায় ১৫৩ কোটি ও ওয়ান ব্যাংক ২৭৪ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করেছে। বন্ড ইস্যুর তালিকায় আরও আছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ৩ কোটি ৬৯ লাখ, রূপালী ব্যাংক ৫ কোটি ৬১ লাখ, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ৫০ কোটি, এনআরবি ব্যাংক ৪৮ কোটি, মধুমতি ব্যাংক প্রায় ৫২ কোটি, মিডল্যান্ড ব্যাংক ৫১ কোটি, যমুনা ব্যাংক প্রায় ২২ কোটি এবং কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ প্রায় ৫৮ কোটি টাকা।
পাশাপাশি আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ২৩ কোটি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৫৬ কোটি ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ৪৮৬ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সারা বছরই বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশ অলস থাকে। বিপরীতে বসিয়ে রেখে বিপুল অঙ্কের কেন্দ্র ভাড়া দিতে হয়, যা ক্যাপাসিটি চার্জ নামে পরিচিত। বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে। বিপুল অঙ্কের টাকা সাশ্রয় সম্ভব হলে উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব। এতে মানুষ কম খরচে বিদ্যুৎ পাবে।
সূত্রমতে, এরই মধ্যে সরকার উচ্চব্যয়ের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘কুইক রেন্টাল’ ও ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ থেকে বেরিয়ে এসেছে। আগামী দুই বছরে দুই হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে।