সানেমের অর্থনীতিবিদ সম্মেলনে রেহমান সোবহান
ব্যবসায়িক মডেলের অংশ হয়ে উঠেছে খেলাপি ঋণ
ভালো ব্যবসায়ীর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কষ্টকর হচ্ছে * নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে সব প্রতিষ্ঠানেই রাজনৈতিক পরিচয় আগে দেখা হয়
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহান বলেছেন, খেলাপি ঋণ এখন ব্যবসায়িক মডেলের অংশ হয়ে উঠেছে। ফলে ভালো ব্যবসায়ীর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কষ্টকর হচ্ছে। তিনি বলেন, কেউ কেউ সুদ না দিয়ে টাকা ধার নিচ্ছেন আবার কেউ সুদে টাকা ধার নিচ্ছেন, যা খেলার মাঠের অমসৃণতার সৃষ্টি করছে। শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে সানেমের বার্ষিক অর্থনীতিবিদ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে প্যানেল আলোচনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এ অধিবেশনে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম হাসান মূল প্রবদ্ধ উপস্থাপন করেন। বিষয়-‘বাংলাদেশে প্রভাবশালী দলীয় রাষ্ট্রের উত্থান এবং বিকাশ : গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কী পরিণতি?’ এ অধিবেশেনে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান। বক্তব্য দেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এমএম আকাশ, গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. আশিকুর রাহমান।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিকীকরণের আবির্ভাব ঘটেছে, যা আইনের শাসনের যথেষ্ট হ্রাস ঘটায়। ব্যবসায়ীদের ভাগ্য এখন পুরোপুরি রাজনৈতিক পরিচয়ের ওপর নির্ভরশীল। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানের পুঁজিপতি শ্রেণি গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চালিত করার নীতির ফলে গত ৪০ বছর ধরে চলছে পুরো খেলাপি সংকট। দেশে ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালের দুটি জাতীয় নির্বাচনকে গণতন্ত্রের জন্য যুগান্তকারী সাফল্য বলে মনে করেন এ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, কোনো রকম সেনা সমর্থন ছাড়াই অবাধ এবং অংশগ্রহণমূলক ওই দুই নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথম দফায় খালেদা জিয়া এবং পরেরবার শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। এটি দুই দলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়ও বড় অবদান রাখে, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশও বাংলাদেশের এই নির্বাচনব্যবস্থা অনুসরণ করে। অবশ্য, বাংলাদেশেই গণতন্ত্রের সেই চর্চা পরবর্তীতে আর অনুসরণ হয়নি। ’৯৬ সালের নির্বাচন ও গণতন্ত্র চর্চা পরবর্তীতে আর অনুসরণ করেনি আওয়ামী লীগ; বরং ক্ষমতা কত দীর্ঘ করা যায় সে চেষ্টাই করছে তারা। এতে রাষ্ট্র চলে যায় একদলীয় নিয়ন্ত্রণে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভূ-রাজনীতির প্রভাব প্রসঙ্গে ড. রেহমান সোবহান বলেন, এ ধরনের প্রভাব সব সময়ই ছিল। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় রাখা এবং ক্ষমতার বাইরে রাখার বিষয়ে তাদের ভূমিকা থাকে। তবে কিছু ডলারের ব্যবসা দিলে তাদের খুশি রাখা যায়। এরকম ক্ষেত্রে তারা ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে শক্তিশালী বিরোধী দলই শেষ পর্যন্ত ভরসা।
রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আধিপত্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ এখন বাংলাদেশের ব্যবসায়িক মডেলের অংশ হয়ে গেছে। সব ব্যবসা এখন সিন্ডিকেটের কব্জায়। তবে সব ব্যবসায়ী এর সঙ্গে জড়িত নয়, কিংবা ব্যাংক ঋণ পরিশোধে খেলাপি নয়। রাজনৈতিকভাবে সুবিধাবাদী ব্যবসায়ীরা এর সঙ্গে জড়িত। তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় পরিশোধ করে না। রিশিডিউলিং বা পুনঃতফশিলীকরণের ব্যবস্থা নেয়। টেন্ডারেও তারাই অংশ নেয়। রাজনীতিকে তারা ভাগ্য বদলের জায়গা হিসাবে বেছে নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক এ চরিত্রের পেছনে অপ্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রভাব। নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে সব প্রতিষ্ঠানেই রাজনৈতিক পরিচয় আগে দেখা হয়। এটা এক ভয়ংকর পরিস্থিতি, যা উন্নত জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে বড় বাধা।
রেহমান সোবহান বলেন, ডমিনেন্ট পলিটিক্যাল সিস্টিম বলতে যা বোঝায়, সেটি বাংলাদেশে হয়নি। এমন উদাহরণ পাওয়া যায় সিঙ্গাপুরে। দেশটিতে একক দলের আধিপত্যবাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে প্রতিষ্ঠান অনেক শক্তিশালী এবং সেগুলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশে উলটো চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। এখানে প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হওয়ার পরিবর্তে উলটো প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও দুর্বল করে তোলা হচ্ছে।
ড. মির্জা এম হাসান বলেন, দেশে একটি ডমিনেন্ট পলিটিক্যাল সিস্টেম (ডিপিএস) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে অন্য দলগুলো রাজনীতি ও গণতন্ত্র চর্চায় জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না। আগামী পাঁচ বছর সরকারি দল নানাভাবে বিএনপির পেছনে লেগে থাকবে তাদের মধ্যে ভাঙন ধরানোর জন্য। এ কাজে যদি তারা সফল হয়, তাহলে দেশে কার্যকরভাবে একদলের আধিপত্যবাদী শাসন ব্যবস্থা চালু হয়ে যাবে।
অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় বসেছে তারা কি রাজনৈতিক দলের ওপর ভর করে ক্ষমতায় আসছে নাকি রাষ্ট্র কাঠামোকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় বসছে, সে আলোচনা তোলার সময় এসেছে।
অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, বাংলাদেশে একদলীয় আধিপত্যবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ একদলের শাসন ব্যবস্থা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। কিন্তু কোনো ব্যক্তিই অমর নয়। ফলে এখন যে ব্যক্তি দলীয় প্রধান হিসাবে আছেন, তার মৃত্যুর পর উপযুক্ত উত্তরাধিকার না থাকলে একদলীয় আধিপত্য আর টিকবে না। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ছাড়া বর্তমান আওয়ামী লীগ ‘জিরো’। শেখ হাসিনা না থাকলে আওয়ামী লীগের কোনো শক্তিই থাকবে না। ফলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একদলীয় আধিপত্য দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সুযোগ নেই।
শুক্রবার রাজধানীর তিন দিনের এ সম্মেলন উদ্বোধন করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সম্মেলনে এবারের প্রতিপাদ্য ‘নিউ ফ্রন্টিয়ার্স ইন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইমার্জিং ডাইনামিকস’। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপি ও ঢাকায় অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশন আয়োজনে সহযোগিতা দিচ্ছে। ১৬টি অধিবেশনে ১১ দেশের অর্থনীতিবিদ, গবেষক, উন্নয়ন কর্মী ও শিক্ষার্থীরা গবেষণাপত্র উপস্থাপন করছেন।