এবার টার্গেটে টিপুর স্ত্রী কাউন্সিলর ডলি
ফের উত্তপ্ত মতিঝিলের আন্ডারওয়ার্ল্ড
মুখোমুখি জিসান-মানিকের অনুসারীরা * খালিদ, জিসান ও টিপুর স্ত্রীকে জড়িয়ে পোস্টার, জেল থেকে হুমকি, থানায় জিডি
মাহমুদুল হাসান নয়ন
প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফের উত্তপ্ত মতিঝিলের আন্ডারওয়ার্ল্ড। এলাকায় চাঁদাবাজি ও সরকারি দপ্তর-অধিদপ্তরের টেন্ডারবাজির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মরিয়া বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক। এরই মধ্যে বিদেশে বসেই তিনি পুরো এলাকায় গড়েছেন শক্ত নেটওয়ার্ক। বিষয়টি ভালোভাবে দেখছেন না দুবাই পলাতক আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ মন্টি। তাদের স্থানীয় অনুসারীরা এখন অনেকটা মুখোমুখি অবস্থানে। এই সন্ত্রাসী তৎপরতায় অনেকটাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন নিহত আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুর স্ত্রী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি। ফলে উভয় পক্ষের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন তিনি। গোয়েন্দা সংস্থা, থানা পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রগুলো বলছে, বর্তমানে টিপুর স্ত্রী ডলিকে সাহস জোগাচ্ছেন যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া-এমন ধারণা প্রতিপক্ষের। এ কারণে খালেদকে জড়িয়ে ডলি ও শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ মন্টির ছবি দিয়ে ছেয়ে ফেলা হয়েছে ঢাকার আদালত চত্বর এবং মতিঝিল এলাকা। মানিকের স্থানীয় সহযোগীরাই খালেদ ও ডলিকে জড়িয়ে তৈরি করেছে একটি পোস্টার।
অপরদিকে টিপু হত্যার পর জিসানের অধিকাংশ অনুসারী এখন জেলে। জিসান এ মামলার এক নম্বর আসামি। ফলে তারাও চান না টিপু হত্যার বিচারে গতি পাক। এজন্য ডলির নামে অপপ্রচার চালিয়ে ছড়ানো হয়েছে লিফলেটও। এতেও ক্ষান্ত হয়নি সন্ত্রাসীচক্র। কাউন্সিলর ডলিকে দফায় দফায় হুমকি দেওয়া হচ্ছে। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে এসব ঘটনায় তিনি রাজধানীর শাহজাহানপুর থানায় অন্তত নয়টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। সম্প্রতি আদালত চত্বর এবং মতিঝিল এলাকায় যে পোস্টারটি ছড়িয়েছে, এটি গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথম দেখা যায়। পোস্টারটিতে মোট চারটি ছবি রয়েছে। একটি নিহত টিপুর এবং আরেকটি ওমান থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা টিপু হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী সুমন শিকদার ওরফে মুসা। বাকি দুটি ছবির একটিতে খালেদের সঙ্গে জিসান এবং অপরটিতে টিপু হত্যার মামলার বাদী কাউন্সিলর ডলির সঙ্গে খালেদের ছবি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিদেশে এবং জেলখানায় বসে টিপু হত্যার নীলনকশা হয়েছে। সেখানে তিনটি মোবাইল নম্বরও উল্লেখ করা হয়েছে।
গত বছর এই পোস্টারটি চোখে পড়লে ৬ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহজাহানপুর থানায় একটি জিডি করেন টিপুর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘মালিবাগ এলাকায় যাতায়াতের পথে বিভিন্ন দেওয়ালে আমার এডিট করা ছবি দিয়ে মিথ্যা তথ্যসংবলিত এবং আমার জন্য মানহানিকর পোস্টার লাগানো দেখতে পাই। আমার স্বামী জাহিদুল ইসলাম টিপুর হত্যাকারী বা তাদের পৃষ্ঠপোষক বা তাদের অজ্ঞাতনামা অনুসারীরাই এ ধরনের কুরুচিপূর্ণ ও মানহানিকর পোস্টার ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে লাগিয়ে আমার সম্মান নষ্ট করছে। এ চক্রটি মামলায় বিশেষ সুবিধা নেওয়ার জন্য এবং আমাকে রাজনৈতিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য এ ধরনের কাজ করছে।’
পোস্টারের বিতর্ক শেষ না হতেই গত মাসে ছড়িয়ে দেওয়া হয় আরেকটি লিফলেট। সেখানে ডলির রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত নানা বিষয়ে নেতিবাচক কথা লেখা ছিল। বিষয়টি নজরে এলে ২০ জানুয়ারি শাহজাহানপুর থানায় আরেকটি জিডি করেন ডলি। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, মানসম্মান ক্ষুণ্ন করতেই এগুলো ছড়ানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে সোমবার বিকালে ফারহানা ইসলাম ডলি যুগান্তরকে বলেন, টিপুকে হত্যার পর প্রভাবশালী আসামিরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল যাতে অভিযোগপত্রে তাদের নাম না আসে। সেই চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তারা বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। এজন্য আমাকে টার্গেট করেছে। আমি যেন মামলা পরিচালনা থেকে সরে আসি, সেজন্য জেল ও বাইরে থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে হুমকি দিচ্ছে। এতেই ক্ষান্ত হয়নি। এখন তারা আমার চরিত্রহননে নেমেছে। ছবি এডিট করে পোস্টার ছাপাচ্ছে। আমরা পুলিশকেও বিষয়গুলো জানিয়েছি। আমরা এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছি। আমি আমার ও সন্তানদের জীবনের নিরাপত্তা চাই।
মতিঝিলের স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রায় ১১ বছর আগে ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কিকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর বড় সময় ধরেই মতিঝিলের নিয়ন্ত্রণ ছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান, যুবলীগ নেতা খালেদ ও নিহত টিপুদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। ২০২২ সালের ২৪ মার্চ রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টায় শাহজাহানপুরের আমতলা এলাকায় সড়কে প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা টিপুকে। এ ঘটনায় জিসানের অধিকাংশ অনুসারী গ্রেফতার হন। এতে মতিঝিল এলাকায় তাদের তৎপরতা অনেকটা কমে যায়। মূলত এ সুযোগটিই কাজে লাগাতে চায় দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে না আসা বিদেশে পলাতক আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিকের অনুসারীরা। এ নিয়েই উত্তপ্ত আন্ডারওয়ার্ল্ড। যার প্রভাব পড়েছে মতিঝিলের আশপাশের এলাকাগুলোয়ও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হায়াতুল ইসলাম খান যুগান্তরকে বলেন, মতিঝিল অঞ্চলে আমরা এখনো আন্ডারওয়ার্ল্ডের প্রকাশ্য তৎপরতা লক্ষ করিনি। তবে আমরা সতর্ক আছি। প্রতিটি স্থানে আমাদের নজরদারি রয়েছে। এমন কিছু নজরে এলে তা কঠোরভাবে দমন করা হবে। পোস্টার-লিফলেটের সঙ্গে এমন কিছুর সম্পৃক্ততা আছে কি না, তাও খতিয়ে দেখব।
শনিবার রাতে মধ্য বাড্ডা রাতুল মোর্শেদ এন্টারপ্রাইজ এলাকায় অভিযান চালিয়ে জিসান গ্রুপের তিন সদস্যকে গুলিসহ গ্রেফতার করে বাড্ডা থানা পুলিশ। তারা হলেন আমজাদ হোসেন সোহেল ওরফে চাকু সোহেল, মহিউদ্দিন মহি ও জাহিদুল ইসলাম। পুলিশ জানিয়েছে, তারা নিজেদের জিসান গ্রুপের সদস্য বলে জানিয়েছে। গ্রেফতার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে এই গ্রুপের আরও যেসব সদস্যের নাম বেরিয়ে এসেছে তারা হলেন মালিবাগের শামীম, উত্তর বাড্ডার শফিকুল ইসলাম ওরফে রেহলার, বাড্ডা থানা যুবলীগের কাওসার, যুবলীগের মহারাজ ও জাকির, বরিশাইল্যা শান্ত, নাহিদ, তেজগাঁওয়ের মামুন, আদর্শনগরের আরিফ, মধ্যবাড্ডার কানা কাউসার এবং সায়মন।
এ বিষয়ে ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার রিফাত রহমান শামীম যুগান্তরকে বলেন, মতিঝিলের জিসানের তৎপরতা বাড্ডা অঞ্চলেও রয়েছে। তবে তারা বড় কোনো অপরাধে জড়ানোর আগেই আমরা গ্রেফতার করেছি। প্রতিটি এলাকায় আমাদের কঠোর নজরদারি রয়েছে। কোনো অপতৎপরতা বরদাশত করা হবে না।