পুনঃখনন ও আবর্জনা অপসারণে ফিরে পেল প্রাণ
বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলে জোয়ার-ভাটার খেলা

মতিন আব্দুল্লাহ
প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

‘এই জায়গায় আগে ময়লার ভাগাড় ছিল। দুর্গন্ধে আমরা অতিষ্ঠ থাকতাম। বর্ষার সময় বৃষ্টিতে বদ্ধ জলাশয়ের সৃষ্টি হতো। আর এখন জোয়ার-ভাটার খেলা দেখা যায়। জোয়ারের সময় পানি অনেক বেড়ে যায়, ভাটার সময় শুকিয়ে যায়।’-বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল সংস্কারের পর পানির প্রবাহ ফিরে আসার দৃশ্যের এভাবে বর্ণনা করছিলেন কামরাঙ্গীরচর হাজীরঘাটের বাসিন্দা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার তাশজিদুল ইসলাম রাহাত।
এই প্রকৌশলী বলেন, আদি চ্যানেলের অংশজুড়ে আমার বন্ধুর বাবা এই বহুতল ভবন তৈরি করেছেন। সিটি করপোরেশন ইতোমধ্যে খালের অংশে ৩টি কলামের নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত কেটে ফেলেছে। এই ঘটনায় এলাকাবাসী অবাক হয়েছেন। এখন আমরা সবাই বিশ্বাস করি-বাড়ির পাশের পরিত্যক্ত নর্দমাটি সুন্দর কিছু হতে চলেছে। ওয়াকওয়ে, সবুজায়নসহ দৃষ্টিনন্দন আয়োজনের প্রতীক্ষায় আমরা।
শুধু ইঞ্জিনিয়ার রাহাত নন, বুড়িঙ্গার আদি চ্যানেল নিয়ে দু’পাড়ে লাখো মানুষের মূল্যায়ন এখন এমনই। প্রশংসায় ভাসছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এই নগর সংস্থা নিজস্ব উদ্যোগে আদি চ্যানেল পুনঃখনন ও পরিচ্ছন্নতার কাজ করছে। ইতোমধ্যে ৪ লাখ ৫০ হাজার টন আবর্জনা অপসারণ করেছে। এ কাজে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা। এতেই দখল ভরাটে হারিয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল ফিরে পেয়েছে প্রাণ। ২০০৭ সালে অস্থায়ী সরকারের সময় ওই চ্যানেলের জায়গাকে খাস জমি দেখিয়ে একটি সরকারি সংস্থার আঞ্চলিক কার্যালয়ের জন্য বরাদ্দও দেওয়া হয়েছিল। নগরবাসী ও সুশীল সমাজের বাধার মুখে তখন সরকার ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। পরে সরকারি ওই সংস্থাকে তাদের অফিস করতে অন্যত্র জায়গা বরাদ্দ দেয়। এভাবে রক্ষা পায় বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল।
ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ওই আদি চ্যানেল সংস্কারে দৃষ্টিপাত করেন। নানা বাধা ও আইনি লড়াই চালিয়ে পানির প্রবাহ সচল করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে এখন ওই চ্যানেলে জোয়ার ভাটার খেলা দেখা যায়। কামরাঙ্গীরচর লোহার ব্রিজ থেকে হাজীরঘাট পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটার আদি চ্যানেলের বাধাহীন পানির প্রবাহ দু’পাড়ের বাসিন্দাদের মনে আনন্দের দোলা দিচ্ছে।
বুধবার বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলের হাজীরঘাট থেকে লোহার ব্রিজ পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, চ্যানেলের ভেতরের ভরাট অংশ কেটে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। শহীদনগর অংশে একটি স্থাপনা রয়েছে, সেটিও সরানোর প্রক্রিয়া চলছে। দু’পাড়ে পায়ে হাঁটার পথ তৈরির কাজ চলছে।
এলাকাবাসী জানান, বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলের জায়গা ভরাট করে একাধিক ট্রাক স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছিল। সরকারদলীয় স্থানীয় নেতাদের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা এসব জায়গা থেকে দৈনিক লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য হতো। এসব দেখে দু’পাশের আদি চ্যানেল সংলগ্ন জমির মালিকরা একটু একটু করে দখল বাড়াচ্ছিল। কেউ কেউ ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে চ্যানেল দখল করেছিল। এলাকাবাসী পরিত্যক্ত জায়গা পেয়ে আবর্জনা ফেলে ভাগাড়ে পরিণত করেছিল। ডিএসসিসির অভিযানে সব উচ্ছেদ হয়েছে।
আদি চ্যানেলসংলগ্ন হাজারীবাগ কোম্পানিঘাট মসজিদ মার্কেটের মাংস বিক্রেতা মো. সাফায়েত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, তাপস সাহেব মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর এলাকায় কয়েকবার এসেছিলেন। তখন আদি চ্যানেল খনন করে হাতিরঝিলের মতো বিনোদনকেন্দ্র তৈরি করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে সময় মানুষ হাসাহাসিও করেছে। কিন্তু তিনি তার কথা রেখেছেন।
তিনি বলেন, ২৫ বছর ধরে আমি এই এলাকায় বাস করি। কিভাবে এবং কারা আদি চ্যানেল দখল করেছে, তা নিজের চোখে দেখেছি। তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে জানা থাকায় আমারও ধারণা হয়েছিল মেয়র হয়তো পারবেন না। আমাদের ধারণা পালটে দিয়ে তিনি সফল হয়েছেন। আরও কাজ এখনো বাকি আছে। আমরা এখন বিশ্বাস করি তিনি তাও করতে পারবেন।
তিনি বলেন, আদি চ্যানেলের এক পাড়ে আমার বাসা। আর আরেক পাড়ে আমার মাংসের দোকান। দিনে কয়েকবার আসা-যাওয়া করতে হয়। ব্রিজ পার হওয়ার সময় আদি চ্যানেলে জোয়ার ভাটা দেখে খুবই ভালো লাগে। এই এলাকায় হাঁটার পথ ও ঘোরাফেরার জায়গা করলে এলাকার মানুষের অনেক সুবিধা হতো। এলাকায় একটু হাঁটাচলারও জায়গা নেই। ভবনের পাশে গড়ে উঠছে ভবন, খেলার মাঠও নেই।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের জুন মাসে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলের সংস্কার কাজের উদ্বোধন করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। ওইদিন সেখানে মেয়র তাপস, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী, কাউন্সিলর ও জনপ্রতিনিধরা উপস্থিত ছিলেন। ওই দিন ঘটনাস্থলে ছিলেন সংস্থার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. খায়রুল বারেক। তিনি বলেন, মেয়র আমাকে আদি চ্যানেলের পুনঃখনন ও আবর্জনা পরিস্কারের দায়িত্ব দেন। উদ্বোধনের দিন মনে হয়েছিল; হয়তো সরু একটি চ্যানেল হলেও হতে পারে। অথবা কিছু আবর্জনা পরিষ্কারের পর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু, তা হয়নি। মেয়রের দৃঢ় অবস্থানের কারণে আদি চ্যানেল এখন দৃশ্যমান।
তিনি আরও জানান, আদি চ্যানেলের দখলদাররা অনেক প্রভাবশালী ছিলেন। উচ্ছেদ অভিযানে নানা রকম বাধা এসেছে। সবকিছু ডিঙিয়ে আদি চ্যানেল পুনঃখনন ও পরিষ্কারকাজ শেষ পর্যায়ে। এখন আদি চ্যানেলের দু’পাড়ে হাঁটার পথ, সবুজায়ন ও গণপরিসর তৈরির পরিকল্পনায় কাজ চলছে। এছাড়া আদি চ্যানেলর শেষ মাথায় দখলদাররা পুরোপুরি প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে; সেটাও উদ্ধার করা হবে। এই আদি চ্যানেলকে সিকদার মেডিকেলের সামনে দিয়ে রায়ের বাজার খাল দিয়ে আবার তা বুড়িঙ্গার সঙ্গে মেলানোর উদ্যোগ চলমান রয়েছে। আশা করি, কাজটি বড় চ্যালেঞ্জের হলেও করা সম্ভব হবে। আদি চ্যানেলের দু’পাশের সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে চলাচলের জন্য দৃষ্টিনন্দন একাধিক ব্রিজ তৈরিরও পরিকল্পনায় কাজ চলমান রয়েছে।
জানতে চাইলে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস যুগান্তরকে বলেন, খাল ও নালাগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর নগরীর পানি নিষ্কাশন সহজ করতে কাজ শুরু করি। তারই অংশ হিসাবে আদি চ্যানেল পুনঃখনন ও আবর্জনা পরিষ্কার শুরু করি। সেখানে এখন জোয়ার-ভাটা হয়; যেটা শুরুতে কেউ চিন্তা করতে পারেনি।
তিনি বলেন, ডিএসসিসির প্রকৌশলী ও পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করছি। বাইরের বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পরামর্শ নিচ্ছি। আদি চ্যানেলটির পানির প্রবাহ অটুট রেখে দু’পাড়ে হাঁটারপথ, সবুজায়ন ও গণপরিসর গড়ে তোলা হবে। এখন কিছু অংশে অবৈধ দখলদার রয়েছে। সবাইকে সরে যেতে হবে। আদি চ্যানেলের জায়গায় কাউকে থাকতে দেওয়া হবে না।