Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

মিয়ানমারের মর্টারশেলে নিহত ২

নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে তুমুল লড়াই * সতর্ক অবস্থানে বাংলাদেশ, ধৈর্য ধারণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ * ১০৬ বিজিপি বাংলাদেশে, ফেরতের অনুরোধ জানিয়ে মিয়ানমারের চিঠি

Icon

কূটনৈতিক প্রতিবেদক, কক্সবাজার, বান্দরবান ও নাইক্ষ্যংছড়ি প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মিয়ানমারের মর্টারশেলে নিহত ২

মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টারশেলে বিধ্বস্ত ঘুমধুম সীমান্তের একটি বাড়ি। ইনসেটে বিজিপির এক সদস্যকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হচ্ছে —যুগান্তর

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির তুমুল যুদ্ধ চলছে। এপার থেকে ভারী অস্ত্রের গোলাগুলির মুহুর্মুহু শব্দ শোনা যাচ্ছে। 

মিয়ানমার থেকে নিক্ষিপ্ত মর্টারশেল মাঝে-মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে পড়ছে। সোমবার সকালে মর্টারশেলের আঘাতে ঘুমধুমের জলপাইতলী সীমান্তে দুই নারী নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে এক বাংলাদেশি নারী ও এক রোহিঙ্গা শ্রমিক রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে আছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। গোটা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ। পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিরাপত্তা বাহিনীকে ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এদিকে, আরাকান আর্মির আক্রমণের মুখে ১০৬ জন মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) হেফাজতে তাদের রাখা হয়েছে। 
এদের ফেরত নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু করেছে মিয়ানমার সামরিক জান্তার সরকার। মিয়ানমারের ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী টেলিফোনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদকে আশ্রিত বিজিপি সদস্যদের ফেরত দেওয়ার অনুরোধ করেন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কাছে চিঠি দিয়েও অনুরোধ জানায় মিয়ানমার জান্তা। 

টেকনাফ-মংডু সীমান্ত দিয়ে বিজিপি সদস্যদের ফেরত নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে জান্তা সরকার। এতে স্পষ্টত, মংডু এলাকা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এই পথে সম্ভব না হলে মিয়ানমার জান্তা বিশেষ বিমান পাঠিয়ে বিজিপি সদস্যদের ফেরত নিতে পারে। অপরদিকে বাংলাদেশে মর্টারশেল পড়ছে বলে ঢাকার অভিযোগ সম্পর্কে মিয়ানমার বলছে, এসব মর্টারশেল মিয়ানমারের জান্তা সমর্থিত বাহিনীর নয়। 

মিয়ানমারের বিভিন্ন প্রদেশে স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে লড়াইয়ে দেশটির ৬২ জন সেনা নিহত হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। মিয়ানমারে সংঘাতের মুখে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে পাঁচ সদস্যের রোহিঙ্গা পরিবার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এছাড়া ৪০০ জন চাকমা ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। সীমান্তে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামবাসীরা চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। আতঙ্কে অনেকে গ্রাম ছাড়ছে। বিজিবি সীমান্তজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। 

শনিবার থেকে চলা সংঘর্ষে মিয়ানমারের তুমব্রু, ঘুমধুম ক্যাম্পের অনেকখানি আরাকান বিদ্রোহীরা দখল করে নিয়েছে। ঘুমধুম ইউনিয়নের ঘুমধুম, তুমব্রু, কোনাপাড়া, জলপাইতলী সীমান্তের ওপারে সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী আরকান আর্মির (এএ) তুমুল লড়াই চলছে। সোমবার সকাল ১০টা থেকে আরাকান আর্মির অবস্থান লক্ষ্য করে সরকারি বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে বোমা নিক্ষেপ শুরু করে। এ সময় মিয়ানমার থেকে আসা মর্টারশেলের আঘাতে ঘুমধুমের ৪নং ওয়ার্ডের বাদশা মিয়ার স্ত্রী আসমা খাতুন (৫৫) ও এক নারী রোহিঙ্গা নিহত হন। 

ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, বাড়ির পাশে ধানখেতে আসমা খাতুন ও এক রোহিঙ্গা শ্রমিক কাজ করছিলেন। খেত সংলগ্ন বাড়িতে দুপুরের খাবার খেতে বসলে তাদের শরীরে মর্টারশেল আঘাত করে। ঘটনাস্থলেই রোহিঙ্গা নারী শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আর গুরুতর আহত আসমাকে কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। তুমরু বাজারের ব্যবসায়ী সৈয়দ আলম বলেন, দুপুরের দিকে আমার চোখের সামনে বাড়ির আঙ্গিনায় কয়েকটি গুলি এসে পড়ে। নিরাপত্তাহীনতায় পরিবারকে কক্সবাজারে আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়েছি। নিজেও ইটের দেয়ালের একপ্রান্তে ভয়ে বসে আছি। 

নাইক্ষ্যংছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মান্নান জানান, মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টারশেলের আঘাতে এক বাংলাদেশি নারী ও এক রোহিঙ্গা নারী শ্রমিক নিহত হয়েছে। বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, সীমান্তে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয় যানবাহন ও লোকজনের চলাচল সীমিত করা হয়েছে। সীমান্তে নিরাপত্তা টহল বাড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তা চৌকিগুলোতে বিজিবি সদস্যরা সতর্কাবস্থায় রয়েছে। 

সীমান্তবর্তী পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় সোমবারও বন্ধ রাখা হয়। ঘুমধুম ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শফিকুল ইসলাম জানান, কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বিজিপির দুই সদস্য লি থাইন (২২) ও জা নি মংয়ের (৩০) অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদিকে, একটি সূত্র জানায়, কক্সবাজার শহরের বেসরকারি একটি হাসপাতালে আরাকান আর্মির ছয় সদস্যকে ভর্তি করা হয়েছে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। রাখাইন রাজ্যের বুচিডং, টাংগো ও ম্রাউ এলাকার বাসিন্দা তারা।

টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ : চলমান সংঘাতের মধ্যে পাঁচ সদস্যের রোহিঙ্গা পরিবার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। বেলা ১১টার দিকে কক্সবাজারের টেকনাফের উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে তাদের অনুপ্রবেশ করতে দেখেন স্থানীয়রা। ওই দলে তিন শিশুসহ নারী ও পুরুষ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রতিনিধি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। স্থানীয়রা জানায়, অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গা পরিবারটিকে আটক করে বিজিবি হেফাজতে নিতে দেখা গেছে। তবে এ বিষয়ে কথা বলতে বিজিবির কেউ রাজি হয়নি।

ঘুমধুম সীমান্তে ৪০০ চাকমা অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় : কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) জানায়, খাদ্যাভাব ও নিরাপত্তার ঝুঁকির কারণে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বসবাসকারী ৪০০ চাকমা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছেন। তবে তাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। বিজিবি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। 

নাইক্ষ্যংছড়ির পাঁচটি বিদ্যালয় বন্ধ : বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় চলমান অস্থিরতার কারণে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করা হয়েছে। পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকবে। সোমবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আক্তারুন্নাহার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। স্কুলগুলো হলো-বাইশারী, ভাজাবনিয়া, তুমরু, পশ্চিমকুল তুমব্রু ও দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

৬২ সেনা নিহত : মিয়ানমারজুড়ে চলমান সংঘাতের তিন দিনে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কাছে কয়েকটি সেনা ঘাঁটির দখল হারিয়েছে সামরিক জান্তা। এ সময় ৬২ জন সেনা নিহত হয়েছে। সোমবার থাইল্যান্ডভিত্তিক মিয়ানমারের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইরাবতি জানায়, দখল হওয়া ঘাঁটিগুলো সাগাইং, ম্যাগউই, মান্দালয় জেলা এবং কাচীন ও কারেন প্রদেশে অবস্থিত। 

তবে জান্তা বাহিনীর কতগুলো ঘাঁটি বিদ্রোহীরা দখলে নিয়েছে সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। দেশটির জান্তাবিরোধী সশস্ত্র দুই বিদ্রোহী গোষ্ঠী পিপলস ডেমোক্রেটিক ফোর্স (পিডিএফ) এবং এথনিক আর্মড অর্গানাইজেশন (ইআও) সংঘাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম