Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

প্রতারিত নারীদের ৩৮ ভাগ ডক্সিংয়ের শিকার

সাইবার প্রতারণায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স

Icon

সিরাজুল ইসলাম

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতারিত নারীদের ৩৮ ভাগ ডক্সিংয়ের শিকার

অপরাধের নতুন উপকরণ হিসাবে যুক্ত হয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সাইবার স্পেসে প্রয়োগ করা হচ্ছে এটি। এর মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ভিকটিম করা হচ্ছে নারীদের। দেশে প্রতিবছর লক্ষাধিক নারী সাইবার প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। বছর তিনেক আগে গঠিত ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’-এ বছরে এ ধরনের অভিযোগ আসছে ১০ হাজারের বেশি। অভিযোগগুলোর মধ্যে ডক্সিংয়ের (এক ধরনের সাইবার আক্রমণ, যার মাধ্যমে একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর প্রকৃত পরিচয় ও ব্যক্তিগত তথ্য, যেমন: বাড়ির ঠিকানা, ফোন নম্বর, ক্রেডিট কার্ড নম্বর, ব্যক্তিগত ছবি প্রভৃতি সংগ্রহ করা সম্ভব) শিকার ৩৮ শতাংশ। আইডি হ্যাক ১৯ ভাগ, ব্ল্যাকমেইলিং ১৭ ভাগ এবং ইমপার্সোনাল (ছদ্মবেশে হয়রানি) ১০ ভাগ। এছাড়া সাইবার বুলিং আট ভাগ এবং আপত্তিকর কনটেন্ট ছড়ানো ও মোবাইল হ্যারাসমেন্টের (ফোন করে বা এসএসএস দিয়ে হয়রানি) অভিযোগ আছে চার ভাগ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে এআই-এর শিকার অনেক নারীকে সেবা দিয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলো। পাশাপাশি আইনের আওতায় এনেছে সাইবার অপরাধীদের। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ১৭ বছর বয়সি ইভা রহমান (ছদ্মনাম) দীর্ঘদিন তার ফেসবুক প্রোফাইলে যেসব ছবি অপলোড করছিলেন, সেগুলো এআই-এর শিকার হচ্ছিল। দুটি ভুয়া ফেসবুক আইডি থেকে সেগুলো আপত্তিকরভাবে এডিট করে কলেজপড়ুয়া ইভাকে পাঠানো হচ্ছিল। তাকে হুমকি দিয়ে বলা হয়, ৩০ হাজার টাকা না দিলে এসব ছবি কলেজের গ্রুপে ভাইরাল করে দেওয়া হবে। একই আইডি থেকে হয়রানির শিকার হন ১৮ বছর বয়সী শায়লা পারভীন (ছদ্মানাম)। ভিকটিম দুজনই থানায় জিডি করার পর পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইম্যান-এ যোগাযোগ করলে সম্প্রতি অপরাধীকে শনাক্ত করে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি মুন্তাসিরুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ২০১৭ সালে পটুয়াখালীর মেয়ে জান্নাতের (ছদ্মনাম) সঙ্গে পরিচয় হয় কুড়িগ্রামের সোহানের (ছদ্মনাম)। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু পরিবারের চাপে সোহান ২০২১ সালে জান্নাতকে না জানিয়ে সীমা (ছদ্মনাম) নামের একজনকে বিয়ে করে। পাশাপাশি জান্নাতের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখে। বিষয়টি সীমা জানতে পারে। এ নিয়ে জান্নাতের সঙ্গে সীমার ঝগড়া হয়। পরে ভুয়া ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম আইডি খুলে জান্নাতের অপত্তিকর ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল। বিষয়টি পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনকে জানানো হলে তদন্ত শুরু হয়। বেরিয়ে আসে সীমা তার ভাইয়ের সহায়তায় জান্নাতকে হয়রানি করছিল। পরে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

পুলিশ জানায়, সুজন রায় ও দীপন বিশ্বাস নারী সেজে ফেসবুকে বন্ধু হওয়ার জন্য হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও আদিবাসী তরুণীদের রিকোয়েস্ট পাঠাত। পরে তাদের প্রোফাইল থেকে ছবি নিয়ে এডিট করে আপত্তিকর কনটেন্ট তৈরি করে অর্থ দাবি করত। এ দুজনের চক্রের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার অনেক নারী। তাদের মধ্যে ১২ তরুণী অভিযোগ করেছিলেন। ভিকটিমরা মনে করেছিলেন, তারা নারী প্রতারকের শিকার। তদন্তের পর জানা যায়, এ চক্রের সদস্যরা পুরুষ। পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি শাখার সহযোগিতায় মৌলভীবাজার জেলা পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে।

সাইবার অপরাধীদের কৌশল বর্ণনা করে পুলিশ জানায়, মামুন মিয়ার টার্গেট প্রাবাসী নারীরা। ‘ফিশিং লিংক’ তৈরি করে সে টার্গেট করা নারীদের ফেসবুক মেসেঞ্জারে পাঠায়। ওই লিংকে ক্লিক করলে ফেসবুক ইন্টারফেস আসে। ভিকটিমরা লিংকে প্রবেশ করার জন্য তাদের ফেসবুক আইডি এবং পাসওয়ার্ড দেয়। তখন মামুনের কাছে ভিকটিমদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের আইডি ও পাসওয়ার্ড চলে যায়। পরে ওই আইডিতে প্রবেশ করে ভিকটিমের আইডির পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে। এরপর সে ওই ফেসবুক আইডি থেকে ভিকটিমের নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে টাকা নেয়। এছাড়া ভিকটিমের কাছে টাকা দাবি করে। টাকা দিলে মামুন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ফেরত দিত। অন্যথায় তার দখলে রাখত। সে ভিকটিমদের বলত, আমাকে গ্রেফতার করতে পারলে এক হাজার ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে। সম্প্রতি তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ।

পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের কর্মকর্তারা জানান, তাদের কাছে নানা বয়সি নারীরা অভিযোগ করছেন। গত এক বছরে যারা অভিযোগ করেছেন, তাদের মধ্যে ১৪ ভাগই ১৮ বছরের নিচে। ৫৮ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ভুক্তভোগীর সংখ্যা ১৮ ভাগ। আর ১০ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ৩০ বছরের বেশি। ভুক্তভোগী নারীদের ৩৩ ভাগই ঢাকার বাসিন্দা। চট্টগ্রামে বাস করেন ১৫ ভাগ এবং খুলনায় থাকেন ১২ ভাগ ভিকটিম। এছাড়া বরিশাল ও রংপুর বিভাগ থেকে আট ভাগ এবং ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে ছয় ভাগ নারী অভিযোগ করেছেন।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ধর্ষণের ধারণকৃত ভিডিও দিয়ে সহকর্মীকে টানা ব্ল্যাকমেইলিং করছিলেন সজিব ওরফে টিকটক সজিব। সম্প্রতি তাকে গ্রেফতার করে পল্লবী থানা পুলিশ। মাসের পর মাস ধর্ষণের পাশাপাশি জোর করে নগদ অর্থ আদায় করেন সজিব। এছাড়া ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলেও হেনস্তা করা হয় ওই নারীকে। সূত্র আরও জানায়, টিকটক মডেল বানানোর লোভ দেখিয়ে সারা দেশে মানব পাচারের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে চক্রের সদস্যরা। নদী নামের এক নারীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ চক্রের সদস্যরা ভারতেই দেড় হাজারের বেশি তরুণী পাচার করেছে।

ডিবি লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মশিউর রহমান বলেন, নিরাপত্তারক্ষী আমির আর দিনমজুর শহীদ ইসলাম মিলে তৈরি করেছেন একটি ওয়েবসাইট। ওই ওয়েবসাইটে দেশ-বিদেশের সুন্দরী তরুণীর (বাঙালি চেহারার) ছবি জুড়ে তৈরি করেছেন কলগার্ল সার্ভিসের চটকদার বিজ্ঞাপন। বুকিং মানি নেওয়ার পর নারী কণ্ঠে কথা বলতেন নিজেরাই। আমিরের তৈরি সাইটে দেওয়া নারীদের ছবি দেখে যারা বুকিং দিতেন, তাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে নারী কণ্ঠে কথা বলতেন শহীদ। কাস্টমারের সঙ্গে বনিবনার পর নেওয়া হতো নির্ধারিত টাকার একটি অংশ। এরপর নম্বর বন্ধ অথবা ব্লক করে দেওয়া হতো। ইতোমধ্যে এ চক্রের সদস্যরা ধরা পড়েছে।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম