বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র অপহরণে বিশ্বস্ত গাড়িচালকের হাত
মূল পরিকল্পনাকারীসহ গ্রেফতার পাঁচ * মুক্তিপণ আদায়ে চলে অমানবিক নির্যাতন
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী কাজী হাসিবুর রহমান হিমেলকে অপহরণের রহস্য উদঘাটন হয়েছে। ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী আব্দুল মালেক নামের একজন গাড়িচালক। আর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে হিমেলদের পরিবারের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত গাড়িচালক সামিদুল ইসলাম। চার বছর ধরে সে হিমেলদের গাড়িচালক হিসেবে কাজ করছে।
সামিদুল কৌশলে হিমেলের পারিবারিক, আর্থিক ও সম্পত্তিসংক্রান্ত তথ্য জেনে নেয়। পেশাদার অপহরণকারী মালেকের নেতৃত্বে রাজধানীর উত্তরায় বৈঠক করে হিমেলকে অপহরণের পরিকল্পনা করা হয়। অপহরণের প্রায় এক মাস পর ২৪ জানুয়ারি হিমেলকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে উদ্ধার করে র্যাব। এ ঘটনায় পাঁচজন গ্রেফতার হয়েছে। প্রত্যেকেই বিভিন্ন ধরনের গাড়ির চালক।
বৃহস্পতিবার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, উত্তরা এলাকায় বসবাসকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী কাজী হাসিবুর রহমান ওরফে হিমেল গত ২৬ ডিসেম্বর ব্যক্তিগত প্রয়োজনে শেরপুর যাওয়ার পথে অপহরণ হন। পরে পরিবার একাধিকবার হিমেলের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে কল করে বন্ধ পায়। অনেক যোগাযোগ করেও মা তহুরা বিনতে হক ছেলের সন্ধান না পেয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। ২৮ ডিসেম্বর গাজীপুরের বাসন এলাকায় হিমেলের গাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
র্যাব জানায়, অজ্ঞাত এক ব্যক্তি অপহৃত হিমেলের মায়ের হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে অপহরণের বিষয়টি জানায় এবং ২ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে হিমেলকে পাশবিক কায়দায় নির্যাতনের ভিডিও পাঠায় তারা। পরে ৬ জানুয়ারি হিমেলের মামা বাদী হয়ে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় অপহরণের মামলা করেন। মা তহুরা ছেলেকে উদ্ধারে র্যাবের কাছেও অভিযোগ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২৩ জানুয়ারি র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-১, র্যাব-৯ ও র্যাব-১৪ এর দল সুনামগঞ্জের তাহিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে অপহরণকারী চক্রের মূলহোতা ও পরিকল্পনাকারী আব্দুল মালেক (৩৫), তার অন্যতম সহযোগী চালক সামিদুল ইসলামকে (৩০) গ্রেফতার করে।
তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার রাতে ভিকটিম হাসিবুর রহমান ওরফে হিমেলকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থেকে উদ্ধার করা হয়। এ সময় গ্রেফতার হয় রনি নামে একজন। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার রাতে রাজধানীর উত্তরা থেকে রাসেল মিয়া (৩৪) ও বিল্লাল হোসেন (২৪) নামে চক্রের আরও দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে উদ্ধার করা হয় ১টি বিদেশি পিস্তল, ২ রাউন্ড গুলি ও ২টি ওয়াকি-টকি সেট।
র্যাব জানায়, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির (আইইউবিএটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী হিমেল। বাবা ৪ মাস আগে মারা যাওয়ায় পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসায় নামেন হিমেল।
পরিকল্পনার বিষয়ে র্যাব জানায়, হিমেলের মাকে একটি বিদেশি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে ফোন করে প্রথমে ২ কোটি টাকা মুক্তিপণ হিসাবে দাবি করে মালেক। হিমেলকে পাশবিক কায়দায় নির্যাতনের ভিডিও পাঠায়। পর্যায়ক্রমে এক কোটি তারপর ৫০ লাখ, তারপর ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ হিসাবে দাবি করে। টাকা না দিলে হাত-পা কেটে ফেলা, এমনকি হত্যার হুমকি দেয়। মালেক বিভিন্ন সময় হিমেলের মাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং তার পরিবারের সদস্যদের প্রাণনাশের হুমকি দেয়। পরে হিমেলের মা মুক্তিপণের টাকা দিতে সম্মত হয়।
র্যাব আরও জানায়, অপহরণকারীরা হিমেলের মাকে ২৩ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে যেতে বলে। বিষয়টি তিনি র্যাবকেও অবহিত করেন। ওই তারিখে হিমেলের মা নেত্রকোনায় পৌঁছলে মালেক ও সামিদুল তাকে তাহিরপুরে যেতে বলে। তখন র্যাবের একটি দল তাহিরপুর থেকে তাদের গ্রেফতার করে। পরে মালেক ও সামিদুলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হিমেলকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে পাহাড়ি টিলা এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ও মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় পাওয়া যায় হিমেলকে।
বৃহস্পতিবার র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে হিমেলের মা তহুরা বিনতে হক বলেন, ‘আল্লাহ যেন আর কারও ভাগ্যে সন্তান অপহরণের এ রকম ঘটনা না দেয়। যারা আমার ছেলেকে অপহরণ, নির্যাতন করেছে তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়। আমার ছেলের লাইফটা শেষ করে দিয়েছে ওরা। আমি এখনো নিশ্চিন্ত না আমার ছেলেটা কী করবে? ছেলেটা এখনো অসুস্থ। ওরা (অপহরণকারীরা) ২৪ ঘণ্টা আমাকে গালাগাল, হুমকি দিয়েছে। এখনো ভয় লাগে।’
তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের কাছে যেন না যাই সেজন্য হুমকি দিত। বলত ছেলেকে মেরে ফেলবে। একটা চাকমা ছেলে ছিল সঙ্গে। বারবার ওকে জবাই করার হুমকি দিচ্ছিল। ড্রাইভার সামিদুল ফোনে বলত ম্যাডাম টাকাটা নিয়ে আসেন।’
তহুরা বিনতে হক আরও বলেন, আগে কখনো আমি সামিদুলকে সন্দেহ করতাম না। যেদিন বাসা থেকে বের হয়েছিল সেদিন ব্যবসার কথা বলে সামিদুলই ওর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায়। তবে অপহরণের আগে সর্বশেষ ১০-১২ দিন সামিদুলের মতিগতি ভালো ছিল না। শুধু ছেলেকে নিয়ে বাইরে যেতে চাইত। আমি বাইরে যেতাম, টাকা দিতাম, টাকা খরচা করতাম তা দেখত । কিন্তু কখনো আমার ছেলে ওকে সন্দেহ করেনি।