Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ডিএমপির ৫০ থানায় বরাদ্দের অর্থ অপ্রতুল

‘ম্যানেজ’ করে চলছে বিভিন্ন খাতের ব্যয়

লাশ ব্যবস্থাপনার খরচ মেটে না বরাদ্দের টাকায় * বিট পুলিশিং, ওপেন হাউজ ডে এবং অতিথি আপ্যায়নে নেই বরাদ্দ

Icon

ইমন রহমান

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘ম্যানেজ’ করে চলছে বিভিন্ন খাতের ব্যয়

রাজধানীর কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে ৩০ আগস্ট রাজেশ মজুমদার নামের এক ব্যক্তির ট্রাভেল ব্যাগ চুরি হয়। ব্যাগে ৬ ভরি স্বর্ণের গয়না, ১০ হাজার টাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ মালামাল ছিল-এমন তথ্য উল্লেখ করে মিরপুর মডেল থানায় মামলা করেন রাজেশ। থানা-পুলিশ দুই দফা অভিযান চালিয়ে মাগুরার সদর থানা এলাকা থেকে দুই চোরকে গ্রেফতার করে। এ অভিযানে গাড়ি ভাড়া বাবদই ২০ হাজার টাকা খরচ হয় বলে জানান তদন্তসংশ্লিষ্টরা। অথচ মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশের বরাদ্দ ছিল মাত্র ২ হাজার টাকা।

বাকি টাকা কোথায় পেয়েছেন জানতে চাইলে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নাজমুল হুদা যুগান্তরকে বলেন, ‘এগুলো নিয়ে কথা বলে শুধু শুধু আমাকে বিব্রত করবেন না।’

প্রতিটি থানার শুধু দৈনন্দিন কাজের জন্যই ১৫০ ধরনের ফর্ম লাগে। সাধারণ ডায়েরি (জিডি), কমান্ড সার্টিফিকেট (সিসি), মামলার এফআইআর, এজাহার প্রিন্ট দিতে প্রচুর কাগজ প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ থানার জন্য এসব খাতে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তাতে খরচ সংকুলান হয় না। একটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) যুগান্তরকে জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য তার থানার স্বাস্থ্য বিধান সামগ্রী, ব্যবহার্য ও অন্যান্য মনিহারি সামগ্রীর জন্য ৬ লাখ ৫৮ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু এ টাকা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম ছিল।

ঢাকা মাহানগর পুলিশের (ডিএমপির) ৫০টি থানায় উল্লিখিত সংকটসহ বিভিন্ন খাতের কার্যক্রম পরিচালনায় বরাদ্দের অর্থ পর্যাপ্ত নয়, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরাদ্দই নেই। এসব সংকটকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে পুলিশের অনেকেই ঘুস বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, দৈনন্দিন কাজের স্বাভাবিক গতি যাতে ব্যাহত না হয়, সেজন্য কোনো না কোনোভাবে ‘ম্যানেজ’ করে সবকিছু চালাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ নীতিবিরুদ্ধ কাজ করতে বাধ্য হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক যুগান্তরকে বলেন, এসব সমস্যা কখনোই পুরোপুরি সমাধান হবে না। এর মধ্যেই কাজ করতে হবে। আমরা যখন চাকরিতে ঢুকি, তখন থেকেই এসব সমস্যার কথা শুনে আসছি। অতীতে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলেও সমস্যা ছিল। সমস্যার সমাধান কেউ কোনোদিন করেনি।

তিনি আরও বলেন, কমিউনিটি পুলিশিং বা গণমুখী পুলিশিং ব্যবস্থা খাতে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য আমি যখন আইজিপি ছিলাম, তখন (২০১৬ সালে) প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সে চিঠিটা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়নি।

ডিএমপির আটটি বিভাগের একটি করে থানায় সরেজমিন পাওয়া সংকটের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-মামলার তদন্ত ব্যয়ে নামমাত্র বরাদ্দ; লাশ ব্যবস্থাপনার জন্য থাকা বরাদ্দের চেয়ে খরচ বেশি এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মনিহারি সামগ্রী ও টহল গাড়ির সংকট। এছাড়াও রয়েছে ঢাকার বাইরে অভিযানের জন্য কোনো গাড়ি না থাকা, বিট পুলিশিং ও ওপেন হাউজ ডে আয়োজনের বরাদ্দ না থাকা এবং অতিথি আপ্যায়নের জন্য বরাদ্দ না থাকা।

এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর স্মার্ট ডিএমপি গঠনের ঘোষণা দিয়েছি। ইতোমধ্যে ডিএমপির থানাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, ডিএমপির থানাগুলোর খরচের খাতকে চারভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো-মামলা তদন্ত ব্যয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও ব্যবহার্য সামগ্রী এবং অন্যান্য মনিহারি সামগ্রী। মামলা তদন্ত ব্যয় ছাড়া অন্য তিনটি খাতে দেওয়া বরাদ্দও থানাভেদে ভিন্ন। অনেক থানার ফটোকপি মেশিন ও প্রিন্টার মাঝেমধ্যেই নষ্ট থাকে। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমার থানায় দিনে প্রায় এক হাজার টাকা খরচ হয় শুধু বিভিন্ন কাগজ ফটোকপি করতে। অতিরিক্ত খরচ মেটানো হয় কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ম্যানেজ করতে হয়। কীভাবে ম্যানেজ করেন জানতে চাইলে তিনি চুপ থাকেন।

মামলার তদন্ত ব্যয় : মামলার তদন্ত ব্যয়ের বরাদ্দের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডাকাতি ও খুনের মামলায় ৬ হাজার; দস্যুতা ও অপমৃত্যুতে ৪ হাজার; অপহরণে ৫ হাজার; পর্নোগ্রাফি, ডিজিটাল নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবিরোধী ও অস্ত্র মামলার জন্য ৩ হাজার এবং মাদক ও অন্যান্য মামলার জন্য ২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু মামলা তদন্তকারী পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, বরাদ্দের এ টাকায় মামলা তদন্তের ব্যয় মেটে না।

মামলা তদন্তের অতিরিক্ত ব্যয় কোথায় পান জানতে চাইলে একাধিক থানার ওসি প্রায় অভিন্ন তথ্য দিয়ে বলেছেন, সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করতে হয়। অনেক সময় ওসিরাও টাকা দেন। ঢাকার বাইরে অভিযানে যাওয়া লাগলে টিএ-ডিএ বিল পান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ বিল পেতে অনেক সময় লেগে যায়। তবে মামলা তদন্তকারী একাধিক উপপরিদর্শক যুগান্তরকে জানান, ঢাকার বাইরে অভিযানে গিয়ে যদি ১০ হাজার টাকা খরচ হয়, তাহলে তারা বিল পান চার হাজার টাকা। অনেক সময় তাও পাওয়া যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাদীর কাছ থেকে অভিযানের গাড়ি ভাড়াসহ বিভিন্ন খরচ নেওয়া হয়।

লাশ ব্যবস্থাপনা : একটি অপমৃত্যুর মামলার তদন্ত বাবদ ৪ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকে। কিন্তু লাশ ঘটনাস্থল থেকে মর্গে নিয়ে ময়নাতদন্ত শেষ করতেই এ টাকা খরচ হয়ে যায় বলে জানান পুলিশের সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, অধিকাংশ সময় ময়নাতদন্তের জন্য লাশ উদ্ধার করে ভ্যান, পিকআপ ভ্যান অথবা অ্যাম্বুলেন্সে করে মর্গে নেওয়া হয়। লাশের ভিসেরা করার জন্য মর্গ থেকে আলামত মহাখালী ল্যাবে নিতে হয়। মামলা তদন্ত শেষ কারার জন্য ভিসেরা ও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট সংগ্রহ করতেও টাকা খরচ হয় পুলিশের।

ডিএমপির উত্তরা বিভাগের এক উপপরিদর্শক বলেন, একটি লাশ উদ্ধার করে মর্গে নিতেই তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ হয়। অনেক ক্ষেত্রে লাশ আবার বাড়িতে পৌঁছে দিতে হয়। এতে ন্যূনতম ৬ হাজার টাকা শুধু লাশ ব্যবস্থাপনায় লাগে।

অতিথি আপ্যায়নে বরাদ্দ নেই : সরেজমিনে জানা যায়, একটি থানায় প্রতিদিন কয়েক শ মানুষ সেবা নিতে আসেন। যাদের মধ্যে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, গণমাধ্যমকর্মী, আমলা, রাজনৈতিক ব্যক্তিও রয়েছেন। তাদের আপ্যায়নে থানাভেদে একজন ওসির মাসে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। অথচ এ খাতে এক টাকাও বরাদ্দ নেই। রমনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আপ্যায়নের টাকা কোথা থেকে দেন। জবাবে তিনি বলেন, ‘নিজের কাছ থেকে দিয়ে দিই।’

বিট পুলিশিং ও ওপেন হাউজ ডে আয়োজনে বরাদ্দ শূন্য : পুলিশের কার্যক্রমকে আরও বেশি জনবান্ধব করতে থানা পুলিশকে বিট পুলিশিং, ওপেন হাউজ ডে আয়োজনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রতি মাসে ন্যূনতম একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হয় থানাকে। যেখানে ২০০ থেকে ৫০০ লোক উপস্থিত থাকেন। ডিএমপির মিরপুর মডেল থানা সূত্র জানিয়েছে, অনুষ্ঠানের স্টেজ, সাউন্ড সিস্টেম, ব্যানার ও চা-নাশতার আয়োজনে প্রতিবছর থানাটির অন্তত তিন লাখ টাকা খরচ হয়। অথচ এ খাতে এক টাকাও বরাদ্দ নেই। কোথায় টাকা পান জানতে চাইলে মিরপুর মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, এমন অনেক কিছুই আমাদের ‘ম্যানেজ’ করতে হয়।

গাড়ি সংকট : নিয়মিত টহল কার্যক্রম পরিচালনা, আসামি গ্রেফতার এবং ভুক্তভোগীকে উদ্ধারে থানায় গাড়ি ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে অধিকাংশ থানায় গাড়ির তীব্র সংকট রয়েছে। ১১.০৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত ডিএমপির উত্তরা বিভাগের দক্ষিণখান থানা। আনুমানিক ১৫ লাখ মানুষের বাস এ থানা এলাকায়। সেখানে দিনে জিডি হয় অন্তত ১০০টি। এছাড়া প্রতিদিন গড়ে ৫০০ লোক এ থানায় সেবা নিতে আসেন। মাসে ৪০ থেকে ৪৫টি মামলা হয়। অথচ থানাটিতে মাত্র চারটি ডাবল কেবিন গাড়ি ও চারটি লেগুনা রয়েছে। থানাটির ওসি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আরও অন্তত পাঁচটি ডাবল কেবিন গাড়ি দরকার।

ডিএমপির ওয়ারী থানার ওসি মো. মোস্তাজিরুর রহমান জানান, মাসে ১৫ থেকে ২০ দিন ঢাকার বাইরে অভিযানে যেতে হয় তাদের। কাজের সুবিধায় প্রতিটি থানায় নিজস্ব একটি করে মাইক্রোবাস থাকা দরকার।

জায়গার সংকট : সরেজমিন দেখা যায়, অধিকাংশ থানায় নেই পর্যাপ্ত জায়গা। লালবাগ বিভাগের চকবাজার থানায় গিয়ে কথা হয় ওসি কাজী আসাদুজ্জামানের সঙ্গে। একটি ছোটো ঘরে তার কার্যালয়। সর্বোচ্চ চারজন লোক বসতে পারেন সেই ঘরটিতে।

ডিএমপির অনেক থানা মালখানা সংকটের কারণে সড়কের ওপরই ফেলে রাখে জব্দ করা গাড়ি। ২৭ সেপ্টেম্বর ভাটারা থানায় ঢোকার সময় মনে হচ্ছিল কোনো পুরোনো গাড়ির ভাঙারির গুদাম। থানার ভেতর ও আশপাশের সড়কে জরাজীর্ণ বিভিন্ন গাড়ির স্তূপ। একটির ওপর আরেকটি গাড়ি উঠিয়ে রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, থানাটিতে বিভিন্ন সময় জব্দ হওয়া ৬০ থেকে ৭০টি প্রাইভেট কার, ট্রাক ও বাস রয়েছে। আর মোটরসাইকেল রয়েছে ২৫ থেকে ৩০টি।

থানাটির ওসি এবিএম আসাদুজ্জামান বলেন, মালখানা সংকট থাকলেও মামলার আলামত হিসাবে জব্দ গাড়ি আমাদের সংরক্ষণ করতে হয়।

নেই রান্নার ব্যবস্থা : ডিএমপির বেশির ভাগ থানায় নেই রান্নার ব্যবস্থা। তবে কোনো কোনো থানায় নিজস্ব খরচে রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওয়ারী থানায় ১২০ জন পুলিশ ও ৪৭ জন আনসার সদস্যের জন্য নেই কোনো রান্নার স্থান ও গ্যাস সংযোগ। বাইরে থেকে খাবার এনে খেতে হচ্ছে তাদের। থানাটিতে ক্যানটিনও নেই। আর রামপুরা থানার মোট জনবল ১১৬। যাদের একটি বড় অংশের খাবারের ব্যবস্থা থানায় করা হয়। রান্নার সরঞ্জামের সংকটের পাশাপাশি রান্নাঘর দীর্ঘদিন ছিল ব্যবহারের অনুপযোগী। কিন্তু এ খাতে কোনো বরাদ্দ নেই। থানাটির রান্নাঘর মেরামত, কুকারেজ, ফ্রিজসহ বিভিন্ন মালামাল সম্প্রতি ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রামপুরা থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আল্লাহই চালিয়ে নিচ্ছে।’

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম