Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

উপেক্ষিত বেশির ভাগ সুপারিশ

শেষ সময়ে গতিহীন সংসদীয় কমিটি

Icon

শেখ মামুনুর রশীদ

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শেষ সময়ে গতিহীন সংসদীয় কমিটি

সরকারের শেষ সময়ে এসে অনেকটাই গতিহীন হয়ে পড়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কার্যক্রম। একই সঙ্গে লাল ফিতায় বন্দি হয়ে আছে বিভিন্ন কমিটির কয়েকশ সুপারিশ। মন্ত্রণালয় এবং সংসদীয় কমিটির ‘স্নায়ু-লড়াইয়ে’ উপেক্ষিত এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের সুযোগ আর নেই বললেই চলে। এখানেই শেষ নয়, সরকারের আগ্রহ না থাকায় সংসদীয় কমিটির ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাবটিও বছরের পর বছর ফাইলবন্দি হয়ে আছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) পক্ষ থেকে উত্থাপিত পার্লামেন্ট ওয়াচের প্রতিবেদন এবং যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে একাদশ জাতীয় সংসদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কার্যক্রমের বিষয়ে এমন হতাশাজনক চিত্র পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি চলতি সংসদের প্রায় পৌনে পাঁচ বছরের কার্যক্রম তুলে ধরতে গিয়ে টিআইবি বলেছে, অনেকটাই স্থবির ছিল জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটির কার্যক্রম। কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী মাসে একবার বৈঠকে বসার নিয়ম থাকলেও একাধিক কমিটি তা মনেনি। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ কমিটি দায়সারা গোছের বৈঠক করে। এসব বৈঠক থেকে জনগুরুত্বহীন সব সুপারিশের অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেক কমিটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করলেও তা মন্ত্রণালয় আমলে নেয়নি, কিংবা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। ফলে সংসদীয় কমিটির অসংখ্য সুপারিশ উপেক্ষিতই থেকে গেছে। সংসদ অধিবেশনের মতো কোরাম সংকটের কারণে একাধিকবার সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক বাতিলের মতো দুঃখজনক ঘটনাও ঘটছে।

সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংস্কৃতি সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য অবশ্যই নেতিবাচক দিক। সংসদের মোট ৫০টি স্থায়ী কমিটি রয়েছে। এর মধ্যে ৩৮টি হচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী খসড়া বিল ও অন্যান্য আইনগত প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মন্ত্রণালয়ের কার‌্যাবলি পর্যালোচনা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম বা গুরুতর কোনো অভিযোগ তদন্ত করা, কমিটি যথোপযুক্ত মনে করলে এর আওতাধীন যে কোনো বিষয় সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা এবং সংসদের পক্ষ থেকে দেওয়া যে কোনো দায়িত্ব পালন করাই সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাজ। সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, কমিটির মূল কাজ মন্ত্রণালয়ের কাজের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হলেও চলতি সংসদের কমিটিগুলো সেই দায়িত্ব বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এড়িয়ে গেছে। এর বিপরীতে অনেক কমিটি বিদেশ ভ্রমণকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বুধবার যুগান্তরকে বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাণ হচ্ছে সংসদীয় কমিটি। কিন্তু চলতি সংসদের কমিটিগুলো তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি।

সংবিধানের ৭৬(৩) ধারা অনুযায়ী ‘সংসদ আইনের দ্বারা সাক্ষীদের হাজিরা বলবৎ এবং শপথ বা অন্য কোন উপায়ের অধীন করিয়া তাহাদের সাক্ষ্য গ্রহণের দলিলপত্র দাখিল করিবার ক্ষমতা প্রদান করিতে পারিবেন।’ সংবিধানের এই ধারা অনুযায়ী কমিটির ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একটি আইন প্রণয়নের আলোচনা বহুবার হলেও কার্যত এখন পর্যন্ত সেই আইন হয়নি। অথচ ২০০৮ সালে গঠিত নবম জাতীয় সংসদেই এ সংক্রান্ত একটি বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি ফাইলবন্দি হয়ে আছে। প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকেও সংসদীয় কমিটির কাছে মন্ত্রণালয়ের জবাবদিহি যাতে নিশ্চিত হয়, সে ব্যবস্থা করার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।

১০ এপ্রিল জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে বিশেষ অধিবেশনে আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধীদলীয় উপনেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীদের পরিবর্তে সংসদ-সদস্যদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি করেছেন। বিরোধী দল থেকেও স্থায়ী কমিটির সভাপতি করেছেন এগুলো ভালো উদ্যোগ। তবে আমি মনে করি, মন্ত্রণালয়গুলোর স্থায়ী কমিটির কাছে জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকা দরকার। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। দেখা যায় স্থায়ী কমিটি সুপারিশ করতে পারে। স্থায়ী কমিটি যে সুপারিশ করে, মন্ত্রণালয় তা দেখে না। অনেক সময় যে প্রস্তাবগুলো পাঠানো হয়, মন্ত্রণালয় সেটা একেবারেই দেখে না। কমিটি থেকে প্রস্তাব পাঠালে মন্ত্রণালয় দেখতে বাধ্য হবে-এ ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এটা বিশ্বের অন্যান্য দেশেও আছে, আমাদের দেশেও করা যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, সংসদীয় কমিটিগুলো সার্বভৌম সংসদেরই অংশ। কোনো বিষয়ে কমিটি সুপারিশ করার অর্থই হচ্ছে একধরনের নির্দেশ। মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের উচিত এ নির্দেশ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া। কেউ তা না করলে তিনি সংসদ অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হবেন। সংসদীয় কমিটিগুলোকে শক্তিশালী করা উচিত দাবি করে তিনি বলেন, সংসদীয় কমিটিগুলো শক্তিশালী হলে দুর্নীতি কমবে। মন্ত্রণালয়গুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত হবে। এজন্য প্রয়োজনে সংবিধান এবং সংসদের কার্যপ্রণালিবিধি সংশোধন করে সংসদীয় কমিটিগুলোকে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিতে হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সংসদীয় কমিটিগুলোর বৈঠক খাতে প্রতি বছর ব্যয় হয় ৫ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে বৈঠকে যোগ দিতে কমিটির সদস্যদের উপস্থিতি ভাতা, যাতায়াত, আপ্যায়ন, সংসদীয় কমিটিগুলোর বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনসহ বিভিন্ন খাত রয়েছে। এর বাইরে আরও রয়েছে অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে কমিটির সদস্যদের বিদেশ সফরের ব্যয়। বাস্তবে এ অভিজ্ঞতা কাজে না এলেও ব্যয়ের বছর প্রতিনিয়ত বাড়ছেই।

সূত্র জানায়, ‘ছায়া মন্ত্রণালয়’ হিসাবে পরিচিত সংসদীয় কমিটির কার্যক্রম করোনা মহামারির কারণে প্রায় দুই বছরেরও বেশি সময় বন্ধ ছিল। এই সময়ে সংসদ অধিবেশনও চলে সীমিত সময়ের জন্য। তবে এর আগে ও পরে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সুপারিশ করে। যার বেশির ভাগই উপেক্ষিত থেকে গেছে। প্রাথমিক হিসাবে প্রায় পৌনে পাঁচ বছরে বিভিন্ন সংসদীয় কমিটি দুই হাজারেরও বেশি সুপারিশ করে। এর বাইরেও নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত দিয়েছে। অনেক মন্ত্রণালয় কিছু সুপারিশ আমলে নিলেও বেশির ভাগই ছিল ফাইলবন্দি। অধিকাংশ সুপারিশ মন্ত্রণালয় আমলে না নেওয়ায় অধিবেশন চলাকালে সংসদীয় কমিটির একাধিক সভাপতি ক্ষোভ প্রকাশ করলেও পরিস্থিতি বদলায়নি।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে লুই আই কানের জাতীয় সংসদের মূল নকশা আনা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। কথা ছিল লুই আই কানের মূল নকশা এনে সেই অনুযায়ী সংসদ ভবনের চারপাশসহ আগারগাঁও এলাকার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বহুলা আলোচিত রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করার সুপারিশ করলেও মন্ত্রণালয় তা আমলে নেয়নি। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের নামে কারা অর্থ পাচার করেছে, এর তালিকা চেয়েও পায়নি কমিটি। তবে বেসিক ব্যাংক লুটপাটের মূল হোতা আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বারবার বলেছে সংসদীয় কমিটি। দীর্ঘদিন পর তাকে আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। মঙ্গলবার তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছে দুদক। এছাড়াও ঋণখেলাপিদের তালিকা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রকাশ করার সুপারিশ করে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, যা আমলে নেয়নি মন্ত্রণালয়। সংসদ-সদস্যদের যাতায়াতের সুবিধার্থে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে একটি আন্ডারপাস করার সুপারিশ করেছে কমিটি। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে বারবার তাগাদা দিয়েও কাজ হয়নি।

একইভাবে আড়িয়াল বিলে গড়ে ওঠা অবৈধ আবাসন প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ভূমি মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে চিঠি দেওয়ার সুপারিশ করে তারা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিদেশে সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীরা গুজব-অপপ্রচার ছড়াচ্ছে, এর জবাব দিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কার্যকর উদ্যোগ নিতে বলেছে এ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সরকারের মেয়াদ শেষেও কমিটি যথাযথভাবে এ কাজটি করতে পারেনি। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের বিষয়ে আরও সচেতন হওয়ার সুপারিশ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। একই প্রতিষ্ঠান ঘুরে-ফিরে যাতে টেন্ডারে কাজ না পায়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির যোগ্যতা এইচএসসি নির্ধারণের সুপারিশ করেছে এ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করার সুপারিশ করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। অভিযোগ রয়েছে, এসব সুপারিশ অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি।

জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি যুগান্তরকে বলেন, আমরা সুপারিশ করি, পরামর্শ দিই। রাখা না রাখার মালিক মন্ত্রণালয়। সুপারিশ করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম