Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির সুপারিশ

পিপলস লিজিংসহ ৩ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লুটপাট

Icon

হামিদ বিশ্বাস

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির সুপারিশ

পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসসহ তিন নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। অন্য দুটি হচ্ছে-ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। এমন পরিস্থিতি দেখেও বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। উলটো ক্ষেত্রবিশেষ লুটপাটকারীদের সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা। হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত পাঁচ সদস্যের কারণ উদঘাটন (ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং) কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়ী কর্মকর্তাসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণসহ ১৮টি সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর একেএম সাজেদুর রহমান খান এই কমিটির প্রধান। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।

১৮ দফা সুপারিশের মধ্যে আরও আছে আর্থিক লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের ভবিষ্যতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সব ধরনের নিয়োগে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা এবং সাধারণ মানুষের টাকার ঝুঁকি বন্ধে আন্তঃব্যাংক লেনদেনের মতো কার্যক্রম পরিচালনা পুরোপুরি পরিহার করা জরুরি। আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বন্ড এবং ওই জাতীয় ইস্যুর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি তহবিল সংগ্রহ করতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোথা থেকে কীভাবে তহবিল সংগ্রহ করছে এবং কোথায় কীভাবে কার স্বার্থে ব্যবহার করছে, তার বিস্তারিত তথ্য যাচাই ও বিশ্লেষণ করা এবং সেই সঙ্গে বড় অঙ্কের ঋণের ব্যবহারের প্রকৃত অবস্থা এবং সুবিধাভোগী শনাক্ত করা ও বাস্তব অস্তিত্ব যাচাই করার নির্দেশনা সংবলিত পরিদর্শন গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে। ব্যাংক ও আইসিবির মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কলমানি, মেয়াদি আমানত, মেয়াদি ঋণ ইত্যাদি খাতে অর্থ সরবরাহ ও আদায়ের কার্যক্রম খতিয়ে দেখার জন্য ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগকে নির্দেশনা প্রদান করতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন ১৯৯৩-এর ১৮ ধারায় উল্লিখিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার কাছ থেকে কত ঋণ গ্রহণ করতে পারবে তার সর্বোচ্চ পরিমাণ, ঋণ পরিশোধের সর্বোচ্চ সময়সীমা, বিভিন্ন শ্রেণির ঋণের হিসাবায়ন পদ্ধতি, ঋণের সর্বোচ্চ সীমা, বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখা রিজার্ভ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায় পরিশোধের সক্ষমতার মতো যৌক্তিক পর্যায়ে ইকুইটি উন্নীত করাসহ জনস্বার্থে মুদ্রানীতির উন্নতির জন্য অন্যান্য বিষয় নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উল্লিখিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ পরিদর্শনের পর আগের পরিচালনা পর্ষদকে বাদ দেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এরপর ২০১৫ সালের নভেম্বরে উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও তার অনুসারীরা পিপলস লিজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি ক্রমাগত সম্পদ হারাতে থাকে। বাড়তে থাকে দায়দেনা। চলতে থাকে লুটপাট।’ উজ্জ্বল কুমার নন্দী জালিয়াতচক্রের হোতা ও বর্তমানে ভারতের কারাগারে আটক পিকে হালদারের সহযোগী।’

কমিটির প্রতিবেদনে পিপলস লিজিংয়ে ২০১৪ সালের বিশেষ পরিদর্শনের আগ পর্যন্ত সংঘটিত আর্থিক অনিয়ম এবং অবৈধ কর্মকাণ্ড রোধ ও নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা এবং পিকে হালদারের সহযোগী উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও তার অনুসারীদের হাতে প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ, পরিদর্শন বিভাগসহ তৎকালীন জিএম ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের যার যার ক্ষমতা ও পদমর্যাদার ক্রমানুপাতে কর্মকালের ব্যাপ্তিভেদে দায়ী করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৫ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর পিপলস লিজিংয়ের মোট সম্পদ ছিল ২ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। আর দায়দেনা ছিল ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ওই সময় দায়দেনার চেয়ে সম্পদের পরিমাণ ৪৫৬ কোটি টাকা বেশি ছিল। এর তিন বছর পর ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ৫০৬ কোটি টাকায় নেমে আসে। বিপরীতে দায়দেনা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকায়। মাত্র তিন বছরে পিপলস লিজিংয়ের ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি লাপাত্তা হয়ে গেছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদের মূল্য ছিল ১ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে দায়দেনা ছিল ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি থেকে লুট হয়ে গেছে প্রায় ২৬শ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘২০০৩ থেকে ২০১৪ সালের বিশেষ পরিদর্শনের আগে প্রতিবছর বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে পিপলস লিজিংয়ে বিশদ পরিদর্শন পরিচালিত হয়েছে। ডিএফআইএমের ভিজিলেন্স সেলে পিপলস লিজিংয়ের বিভিন্ন ধরনের সাময়িক আর্থিক প্রতিবেদন নিয়মিতভাবে আসত। কিন্তু ২০১৪ সালের বিশেষ পরিদর্শনের আগে কখনোই এসব অনিয়মের কোনোটিই উদঘাটিত হয়নি। এগুলো সংশ্লিষ্ট বিভাগ, সেল বা শাখার ব্যর্থতা।’

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিশেষ পরিদর্শন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ থেকে প্রতীয়মান হয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম উদঘাটন ও সুষ্ঠু পরিচালনার চেয়ে পরিচালনা পর্ষদ পিকে হালদারের লোকদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার লক্ষ্যেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব বিশেষ পরিদর্শন পরিচালনা করা হয়।’

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পিপলস লিজিংয়ের বিভিন্ন উৎস থেকে সৃষ্ট দায়দেনার পরিমাণ ২ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। এই টাকা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কখনো কলমানি হিসাবে, কখনো বা আমানত হিসাবে সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া আমানত হিসাবে সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে ৮০৩ কোটি টাকা ও বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৪১৯ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়।

পরে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ চড়া সুদে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে ঋণের নামে ওই টাকা লুট করে নেয়। এর ফলে একদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ঋণখেলাপি হিসাবে পিপলস লিজিংয়ের তালিকা যেমন যায়নি, তেমনি খুব সহজেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা লুটপাট চালিয়ে গেছেন। এক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংক এবং যেসব ব্যাংক থেকে আমানত সংগ্রহ করা হয়েছে, সেসব ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

তদন্ত কমিটি মনে করে, ‘ব্যাংকগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে পিপলস লিজিংয়ের দায়িত্বশীলরা লুটপাট করেছেন। ব্যাংকের সহযোগিতা ছাড়া এভাবে লুটপাট কোনোভাবেই সম্ভব হতো না।’

পিপলস লিজিংয়ে লুটপাট চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতার জন্য রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি (আরজেএসসি) এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকেও (বিএসইসি) দায়ী করা হয়।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম