Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

যুগান্তরকে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম

বন্দুকওয়ালার বিরুদ্ধে জয়ী হতে রাস্তা খুঁজতে হবে

রাস্তা খুঁজে না পেলে সরকারের পতন হবে না * আ.লীগের জোর যতদিন আছে, ততদিন জোর খাটিয়ে নির্বাচন করাবে * পুলিশ-র‌্যাব-আমলাতন্ত্র পুরোটাই আওয়ামী লীগের পক্ষে

Icon

শেখ মামুনুর রশীদ

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বন্দুকওয়ালার বিরুদ্ধে জয়ী হতে রাস্তা খুঁজতে হবে

ফাইল ছবি

বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেছেন, আওয়ামী লীগের জোর যতদিন আছে, তারা ততদিন জোর খাটিয়ে নির্বাচন করাবে। আর যদি সেই জোরের চাইতে বেশি জোর বিরোধী পক্ষ দেখাতে পারে, তাহলে বিরোধীপক্ষের জয় হবে। এখানে যুক্তিতর্কের কোনো স্থান নেই। তবে এ বন্দুকওয়ালার বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে। যদি বের করতে পারি তাহলে সরকারের পতন হবে। না পারলে সরকারের পতন হবে না। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন সংঘাত এবং সংকটময় পরিস্থিতির দিকে অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে। সুতরাং নির্বাচন নিয়ে, কিংবা নির্বাচনকে সামনে রেখে যে এটা আরও তীব্র হবে তা বলাই বাহুল্য।

সম্প্রতি যুগান্তরকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা এসব কথা বলেন। রাজধানীর মহাখালীর ডিওএইচএসের তার কার্যালয়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন, মার্কিন ভিসানীতি, বিদেশিদের নানামুখী তৎপরতাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে খোলামেলা কথা বলেন তিনি।

সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৪ অক্টোবর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরপ্রতীক খেতাব প্রদান করে। মেধাবী এই সেনা কর্মকর্তা বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি প্রতিষ্ঠাতা হলেও লেখালেখিসহ নানা কারণেই তিনি দীর্ঘদিন ধরেই একজন পরিচিত মুখ। সজ্জন, বন্ধুবৎসল, মিষ্টভাষী এই মানুষটি নিরাপত্তা বিশ্লেষক হিসাবেও খ্যাতি রয়েছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্যতম শরিক দল হচ্ছে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি।

যুগান্তর : একপক্ষ সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অনড়। আরেকপক্ষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে অনড়। এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও ঘনিয়ে এসেছে। এ অবস্থায় আপনারা কি করবেন।

ইবরাহিম : আমাদের পরিকল্পনা এই মুহূর্তে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে আমরা নির্বাচনে যাব না।

যুগান্তর : কোনো পক্ষই যদি ছাড় না দেয়, তাহলে দেশের পরিস্থিতি কি সংঘাতময় হয়ে উঠবে?

ইবরাহিম : একটা কথা আছে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমার নিজস্ব মূল্যায়নে ‘মাইট ইজ রাইট’ অর্থাৎ ‘জোর যার মুল্লুক তার।’ যার শক্তি আছে সেই ঠিক। আওয়ামী লীগের শক্তি ছিল, মাঠে-ময়দানে আন্দোলন করে ৯৬ সালে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করেছে। আবার আওয়ামী লীগের শক্তি ছিল, তাই তারা আদালতের রায়ের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে জাতীয় সংসদে আইন পাশ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। এখন তাদের গায়ে শক্তি আছে, পুলিশ-র‌্যাব-আমলাতন্ত্র পুরোটাই তাদের পক্ষে। সংবাদপত্রের ৪ ভাগের ৩ ভাগ তাদের পক্ষে। বিচার বিভাগ নিয়ে আর নাই বা বললাম। এই শক্তিগুলোকে কাজে লাগিয়ে তারা বলবে যে সংবিধানের আলোকে বা সংবিধানের অধীনে আমরা নির্বাচন করব। যদিও এই সংবিধান আসমান থেকে তো হঠাৎ করে পড়েনি। বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ১৬ বার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। এরমধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক সংশোধন করেছে আওয়ামী লীগ নিজেই। সুতরাং আওয়ামী লীগের জোর যতদিন আছে, তারা ততদিন জোর খাটিয়ে নির্বাচন করাবে। আর যদি সেই জোরের চাইতে বেশি জোর আপনি দেখাতে পারেন। কিংবা বিরোধীপক্ষ দেখাতে পারে। তাহলে বিরোধীপক্ষের জয় হবে।

যুগান্তর : বিএনপিসহ আপনারা দীর্ঘদিন রাজপথে সরব। কিন্তু রাজনীতির মাঠে এখন পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখতে পারেননি। কিংবা বলা যেতে পারে, সরকারকে সেভাবে চাপে ফেলতে পারছেন না। এক্ষেত্রে আপনার মূল্যায়নটা কি?

ইবরাহিম : কথাটা আংশিকভাবে সত্য। আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে ছিল তখনকার রাজনীতির সঙ্গে এখনকার রাজনীতির মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। একটি সহিংস সরকারের বিপরীতে অহিংস আন্দোলন করে সাফল্য আনার অতীতে আর কারও অভিজ্ঞতা নেই। সাংবাদিকদেরও নেই। সুতরাং একথা বলাটা খুবই সহজ যে আপনারা কিছু দেখাতে পারছেন না, বা করতে পারছেন না। দুই হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে খালি স্লোগান দিয়ে বন্দুকওয়ালার বিরুদ্ধে আপনি কিভাবে জয়ী হবেন, এই বুদ্ধিটাতো কোনো বিশ্বকোষে নেই। ডিকশনারিতে নেই। পলিটিক্যাল সায়েন্সেও নেই। এজন্য রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে। যদি বের করতে পারি তাহলে সরকারের পতন হবে। না পারলে সরকারের পতন হবে না। আরেকটি কথা, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ যে উদাহরণ তৈরি করেছিল, তারা টানা ১৭৩ দিন হরতাল করেছে। কই আপনারা তো কেউ বলেন না যে আওয়ামী লীগ তুমি ভুল করেছিলা। আওয়ামী লীগ ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে দিয়ে আমলাতন্ত্রকে বিদ্রোহ করা শিখিয়েছে। কই তখন তো আপনারা কেউ বলেন নাই যে আওয়ামী লীগ তুমি ভুল করেছিলা। বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় এই মারাত্মক অপরাধগুলো আওয়ামী লীগ করেছে বা করিয়েছে। যার জন্য আওয়ামী লীগ তার শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল। এই মারাত্মক অপরাধ না করা পর্যন্ত আমরা বিরোধী শিবির আমাদের শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবা কিনা-সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান।

যুগান্তর : আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে আপনারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশিদের দ্বারস্থ হচ্ছেন-এমন অভিযোগ সরকার বলয় থেকে করা হচ্ছে। বিদেশিরা কিছু করে দিয়ে যাবে-এমনটা মনে করেন কিনা?

ইবরাহিম : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি, তাদের এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু তৎপরতা ঘটনাক্রমে মিলে গেছে। কেন ভাই আপনারা নিশ্চয়ই এটা ভুলে যাননি-কে দাওয়াত দিয়েছিল ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে। এটা তো আপনারা আওয়ামীপন্থি সাংবাদিকরা লিখবেন না বা লিখতে ভুলে যান। প্রবাদ বাক্য আছে ‘কর্তা খাইলে হয় সিদ্ধি। আমরা খাইলে হয় ভাং। কর্তায় করলে হয় যুগল মিলন। আমরা করলে হয় লাং।’ আপনি যখন ভারতের পররাষ্ট্র সচিবকে আনবেন, এটা খুবই মহাপূণ্যবান কাজ। গঙ্গায় স্নান করে পূতপবিত্র হয়ে তাকে ঢাকা মহানগরে এনে এরশাদ সাহেবকে কান পরামর্শ দিলেন, তার কানের মধ্যে ফুঁ দিলেন-এটা মহাপুণ্যবান কাজ। আর বাকিদের বিষয়টা মহাঅপবিত্র কাজ। এটাতো বলার কোনো অপেক্ষা রাখে না যে বিদেশি শক্তির হাত আপনার শরীরের যেখানে যেখানে ছিদ্র আছে, সেখানে সেখানে ঢুকানো আছে। আপনি যে বিলিয়ন বিলয়ন লোন নিয়েছেন, এটা কি একটা হাত না। আপনি যে রোহিঙ্গা এনে বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, এটা কি একটা হাত না। রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে সেই স্থানে মহাশক্তিধর চীন কি করেছে-তারা সেখানে শিল্পায়ন করেছে। সামরিকীকরণ করেছে। পাইপলাইন বসিয়েছে। এই কথাটা বলতে শরম লাগে কেন বাঙালির। আরেকটি কথা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারেস্টতো শুধু বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতি নয়। আমেরিকা বলুন, চীন বলুন, রাশিয়া বলুন, ভারত বলুন-প্রত্যেকেরই এখানে একটি ভূরাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত। ৬ বছর আগে যখন রোহিঙ্গা ইস্যু হয়, তখন চীন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী বার্মার মাটিতে বসে কি বলেছিলেন-সেটা খেয়াল করেন। রোহিঙ্গা ইস্যুটাকে বৃহৎ শক্তিগুলো চাচ্ছে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে। আর বঙ্গোপসাগরের নীল পানিটা বৃহৎ শক্তির সবারই প্রয়োজন। ভারত যদিও অফিশিয়ালি বৃহৎ শক্তি না, আঞ্চলিক শক্তি-তারও এই পানি প্রয়োজন। সেজন্য তারা বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের দেশে ইনভলভ হচ্ছে। কারও জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হচ্ছেন আশীর্বাদ। আর যাদের জন্য তিনি আশীর্বাদ না-তারা তো চাইতেই পারে অন্য একজন প্রধানমন্ত্রী হলে, কিংবা অন্য একটি সেট ক্ষমতায় থাকলে তাদের লাভ হতে পারে। আবার এটাও সত্য যে, আমেরিকা গণতন্ত্রের প্রতি যতটুকু সমর্থন দেয়, ততটুকু সমর্থন অন্য ‘সুপার পাওয়ার’রা দেয় না। কারণ তাদের নিজেদের দেশেই তো গণতন্ত্র নেই। তাই তারা গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলেন না। এটা আমেরিকার প্লাস পয়েন্ট।

যুগান্তর : নির্বাচন কি যথাসময়ে হবে, কি মনে হয় আপনার।

ইবরাহিম : এটা বলা ‘টু আরলি’।

যুগান্তর : ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপিসহ তাদের শরিকরা বর্জন করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়। দাবি আদায় না হলে এবারও কি বিএনপি এবং তাদের শরিকরা নির্বাচন বর্জনের পথে হাঁটবে।

ইবরাহিম : আমি শিওর না। মানুষ বলে রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কে কখন কোন পদক্ষেপ নেয়-তা এখনই বলা মুশকিল। তবে আমরা আশা করি এবার বিএনপি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং গণতন্ত্রের প্রতি ভালোবাসা ধারণ করে সিদ্ধান্ত নেবে। এটা আমাদের বিশ্বাস। বিএনপি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং গণতন্ত্রের প্রতি ভালোবাসা এবার শক্তভাবে ধারণ করছে।

যুগান্তর : বিএনপির শরিকদের মধ্যে কেউ জাতীয় সরকার, কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান। আসলে আপনারা কি চান।

ইবরাহিম : আমি এটা চাই, ওটা চাই-এমনটা কখনও বলিনি। তবে এটা ঠিক, বাংলাদেশে এখন টানাটানিটা তিন দিক থেকে চলছে। এক কোনার টান হলো-শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন। আরেক কোনার টান হলো-৩ মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। আরেক কোনার টান হচ্ছে-২ বছর বা ৩ বছরের কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন। বিএনপির সঙ্গে যে ৩৬টা রাজনৈতিক দল আছে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল অন রেকর্ড জাতীয় সরকার চায়। নির্বাচনের আগে তারা জাতীয় সরকার চায়। আর বিএনপি নির্বাচনের পরে জাতীয় সরকারের ওয়াদা করেছে। আমি অর্থাৎ বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি কোনোটাতেই কমিটেড না। যেটাই আমরা আদায় করতে পারি, সেটাতেই সন্তুষ্ট। শুধু আওয়ামী লীগ ছাড়া।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম