Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

এডিস মশার ভয়াল থাবা : আরও ৭ জনের মৃত্যু

ডেঙ্গুতে তছনছ বহু পরিবার

Icon

জাহিদ হাসান ও হুমায়ুন কবির 

প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ডেঙ্গুতে তছনছ বহু পরিবার

এডিস মশার ভয়াল থাবায় জনজীবন বিপন্ন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ডেঙ্গুর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। চোখের সামনে চিরতরে চলে যাচ্ছে তরতাজা প্রাণ। মা-বাবার সামনেই হারিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রিয় সন্তান। না-ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে শিশু-কিশোর ও স্কুল-কলেজের শত শত কোমলমতি শিক্ষার্থী। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের বাবা-মা ও পরিবারের সব স্বপ্ন। ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থীসহ সাতজন মারা গেছেন। 

সরকারি হিসাবে চলতি বছরের নয় মাসে এক দিন থেকে ২৫ বছর বয়সি ৮১ হাজার ৪১৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং ২২১ জন মারা গেছেন। শরীরের রক্ত পানি করে তিলে তিলে গড়ে তোলা সন্তানদের এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না অভিভাবকরা। এসব করুণ মৃত্যু একেকটি পরিবারকে তছনছ করে দিচ্ছে। তিন মাসে ডেঙ্গুতে যেসব শিশুর মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে ভাইবোনের মৃত্যু অনেকের নজর কেড়েছে। 

এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৯ বছরের শিশু আরাফাত হোসেন রাউফ ও ৬ বছরের ইসনাত জাহান রাইদার মৃত্যুর ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক। ওরা ছিল পিঠাপিঠি। ছিল দুজনের খুনসুটি। স্থানীয় আইকন একাডেমির কেজি ও নার্সারি শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল তারা। ১৮ আগস্ট রাউফ ও ২৫ আগস্ট রাইদার জীবন কেড়ে নেয় ডেঙ্গু। রাজধানীর মিরপুর পাইকপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতি প্রাণের দুই সন্তানকে হারিয়ে এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি। যে বাসায় রাউফ-রাইদার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, সেই বাসাটি এখন বিরানভূমি। তারা সন্তানের স্মৃতি ভুলতে ওই বাসাটিও ছেড়ে দেন। 

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শাখার (মতিঝিল) সামনে ঝুলছে তিন অবুঝ শিক্ষার্থীর শোকের ছবি। তাদের তিনজনের জীবন কেড়েছে ডেঙ্গু। কালো ব্যানারে মোড়ানো তিন শিশুর ছবি দেখে অনেকেই নীরবে চোখ মুছেন। অন্য শিক্ষার্থীরাও দাঁড়িয়ে কাঁদেন। তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই। স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, আমাদের এই সমাজ এসব অবুঝ শিশুর জীবন রক্ষা করতে পারছে না। মশক নিধনে ব্যর্থতার জন্য মন্ত্রী দোষ চাপান মেয়রের ওপর। মেয়ররা বক্তৃতা করেন। এভাবে তারা নিজেরা দায় এড়ান। কিন্তু মাঝখানে সন্তানদের জীবন চলে যাচ্ছে। আমরা অসহায় বোধ করছি। 

মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছর ডেঙ্গুতে একদিন থেকে ৫ বছর বয়সি শিশু আক্রান্ত হয়েছেন ৯ হাজার ৯৩৪ জন এবং মারা গেছেন ৩২ জন। ৬ থেকে ১০ বছর বয়সি শিশু আক্রান্ত হয়েছে ৯ হাজার ৯৩৭ জন এবং মারা গেছে ৪১ জন। ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সি শিশু আক্রান্ত হয়েছে ১২ হাজার ৮৩৪ জন এবং মারা গেছে ২৪ জন। ১৬ থেকে ২০ বছর বয়স পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ২২ হাজার ৩৬৪ জন এবং মারা গেছে ৫৬ জন। ২১ থেকে ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ২৬ হাজার ৩৪৪ জন এবং মারা গেছেন ৬৮ জন। 

মাস দুয়েক আগে হঠাৎ কিডনির সমস্যা ধরা পড়ে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ির ব্রাহ্মণভিটা উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী হীরামণির। চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে রাজধানীর জাতীয় কিডনি রোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান, কিডনির সিরাম ক্রিয়েটিনিন পয়েন্ট বেড়ে গেছে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্ট্রোক হয় তার। উন্নত চিকিৎসার জন্য আইসিইউতে নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। 

তড়িঘড়ি করে ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে আইসিইউ না পেয়ে উত্তরার আরআরএমসি নামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেও পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়ায় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। মুগদা হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসকরা কিডনির ডায়ালাইসিস প্রয়োজন বলে জানান। সঙ্গে ডেঙ্গুর এনএস-১ পরীক্ষা দেন। সেদিন রাত ৯টার দিকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে হীরামণি। ততক্ষণে হীরামণির ডেঙ্গু টেস্টের ফলাফল স্বজনদের হাতে আসে। রিপোর্টে ডেঙ্গু পজিটিভ বলে জানতে পারেন স্বজনরা। পাঁচটি হাসপাতাল ঘুরেও সন্তানকে বাঁচাতে পারেননি বাবা-মা। মেয়ে হীরামণিকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান মা দিলারা বেগম। মঙ্গলবার কাঁদতে কাঁদতে এই প্রতিবেদকের কাছে সন্তান হারানোর বর্ণনা দেন। 

স্মৃতিচারণা করে কান্নাজিড়ত কণ্ঠে দিলারা বেগম বলেন, ‘মেয়ের সঙ্গে কতশত স্মৃতি, কত কথাই বলার ছিল; কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না! এখন মেয়ের রুমে ঢুকলেই বুকটা হাহাকার করে ওঠে। মেয়ের থাকার ঘরে পড়ার টেবিলে সাজানো-গোছানো বই-খাতা, চেয়ার-টেবিল, জামাকাপড় সবই আছে। শুধু নেই আমার কলিজার টুকরা মেয়েটা! যে মেয়ে আমাকে ছেড়ে এক সেকেন্ডও থাকতে পারত না, আজ আমার বুক খালি করে অন্ধকার কবরে ঘুমায়! এত ব্যথা, এত কষ্ট আমি কাউকে বোঝাতে পারব না। আমাদের জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে।’

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী আফিয়া জাহান ১৪ আগস্ট ডেঙ্গুতে মারা যায়। সে ছিল বনশ্রী শাখার তৃতীয় শ্রেণির ইংরেজি ভার্সনের ‘ঝ’ শাখার ছাত্রী। আফিয়া জাহানের বাবা আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, মেয়েটাকে হারিয়ে আমি দিশেহারা। সন্তান হারানোর এই ব্যথা আর কতদিন বইতে হবে জানি না। তিনি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারের আরও জোরালো ভূমিকা দাবি করেন। আইডিয়াল স্কুলের বনশ্রী শাখার তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ইশাত আজহার ডেঙ্গুতে মারা যায় ১৬ জুলাই। ৩১ জুলাই একই স্কুলের বাংলা ভার্সনের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র বনি আমিন মারা যায়। এভাবে একের পর এক মৃত্যুতে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক-সবাই আতঙ্কে ভুগছেন। 

ডেঙ্গুর কাছে হার মানা আইডিয়াল স্কুলের তিন শিক্ষার্থীর বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী প্রধান শিক্ষক রোকনুজ্জামান শেখ যুগান্তরকে বলেন, তাদের হারিয়ে আমরা বেদনাহত। সন্তান হারিয়ে তাদের বাবা-মা পাগলপ্রায়। তিন শিক্ষার্থীর ছবি স্কুলের গেটের সামনে কালো ব্যানারে ঝুলছে দেখে অনেকেই কষ্ট অনুভব করেন। আমরা আর কোনো শিক্ষার্থীকে হারাতে চাই না। আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়, বলেন ওই শিক্ষক। 

এদিকে ডেঙ্গু কেড়ে নিয়েছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের তিন শিক্ষার্র্থী ও এক শিক্ষকের জীবন। ৪ আগস্ট ছাত্রী ঈয়াশা সুলতানা ফাইহা মারা যায়। মূল দিবা (বাংলা ভার্সন) শাখার তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ঈয়াশা সুলতানা ফাইহার মৃত্যুর করুণ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন বাবা। ঈয়াশা সুলতানার মা নেই। রাজধানীর বাসাবো এলাকায় একটি বাসায় বাবা সঙ্গে থাকত ছোট্ট ঈয়াশা। বাবা ও মেয়ে দুজনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। বাবা সুস্থ হয়ে উঠলেও সন্তানকে বাঁচাতে পারেননি। এই কষ্ট বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদেন হতভাগ্য বাবা। 

২৫ জুলাই ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মূল দিবা (বাংলা ভার্সন) শাখার তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সেতারা রহমান প্রিয়াঙ্কার মৃত্যু হয়। প্রিয়াঙ্কার বাবা গোলাম রহমান বলেন, আমরা একটি পারিবারিক কবরস্থান বানাই। আমাদের সবাইকে রেখে আদরের সন্তানকে সেই কবরে থাকতে হচ্ছে। এই যন্ত্রণা দেখানোর নয়। এ ব্যথা কাউকে বোঝানোর নয়। ৪ জুলাই মূল শাখার একাদশ বিজ্ঞান বিভাগের (এল শাখার) ছাত্রী ইলমা জাহান (১৭) ডেঙ্গুতে মারা যায়। এছাড়া ওই স্কুলের শিক্ষিকা মোর্শেদা বেগমও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১১ আগস্ট। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) কেকা রায় চৌধুরী বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনা অত্যন্ত কষ্টের। 

মেডিকেল শিক্ষার্থীসহ ডেঙ্গুতে একদিনে ৭ মৃত্যু, হাসপাতালে আরও ৩০২৭ : এদিকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থীসহ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৪৬ জনে। এছাড়া ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ হাজার ২৭ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, সোমবার সকাল থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ হাজার ২৭ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮৪৯ এবং ঢাকার বাইরের ২ হাজার ১৭৮ জন। একই সময়ে মারা যাওয়া সাতজনের মধ্যে চারজন ঢাকার এবং তিনজন ঢাকার বাইরের বাসিন্দা। ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ৭৩ হাজার ৭৯৫ জন। 

তাদের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ৭৪ হাজার ৯৭৬ জন এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোয় ৯৮ হাজার ৮১৯ জন ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৮৪৬ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৫৭৮ এবং ঢাকার বাইরের ২৬৮ জন। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১০ হাজার ১০২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৩ হাজার ৮১৪ এবং ঢাকার বাইরের ৬ হাজার ২৮৮ জন।

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী দীপান্বিতা বিশ্বাস (২০) সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তুষার দাস তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। দীপান্বিতা রাজবাড়ীর পাংশা থানার লক্ষ্মীপুর গ্রামের অমল বিশ্বাসের মেয়ে। এমবিবিএস ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। দীপান্বিতা ৫১তম ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন।

সহপাঠী শাদমান কবির বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর মেডিকেলের আবাসিক হলে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন দীপান্বিতা। পরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে প্রথমে তাকে সলিমুল্লাহ মেডিকেলের আইসিইউতে নেওয়া হয়। অবস্থার আরও অবনতি হলে শুক্রবার তাকে বিএসএমএমইউতে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম