নতুন আইনের খসড়ায় বিতর্কিত ৪৩ ধারা
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার বিচার সাইবার নিরাপত্তা আইনে করা যায় কিনা তা ভাবছে সরকার -আইনমন্ত্রী
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হলেও এর কিছু ধারার প্রয়োগ নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে বিতর্কিত ৪৩ ধারা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারাটি সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় প্রতিস্থাপিত হয়েছে। ফলে এটি ডিজিটাল আইনে যেভাবে প্রয়োগ হয়েছে, নতুন আইনেও একইভাবে প্রয়োগ হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সোমবার মন্ত্রিসভায় সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয়।
এদিকে মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস। বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে শুনেছি, তা সত্য হলে আমি খুশি। জাতিসংঘের কর্মকর্তা বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। আইনটিকে ভালোভাবে যাচাই করার মতো কারিগরি জ্ঞানসম্পর্কিত ব্যক্তি নই আমি। আইনের খসড়াটি দেখিওনি। কিন্তু এই পরিবর্তনেই আমি খুব খুশি। আইনে কী পরিবর্তন করা হয়েছে, তা আমাদের ভালো করে দেখতে হবে।
আইনমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত মামলাগুলোর বিচার নতুন আইনে করা যায় কিনা তা নিয়ে ভাবছে সরকার। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হয়রানির ধারা বহাল রেখে আইন সংশোধন করলেও তাতে কোনো লাভ নেই। ৪৩ ধারা নিয়ে নতুন করে ভাবা উচিত বলে মনে করেন তারা। পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারের এই পুরনো ধারাটি বিতর্কমুক্ত হলো না। তাদের মতে, আইনের খসড়াটি মন্ত্রিসভায় পাশ হওয়ার আগে অংশীজনদের মতামত নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সরকার সেটি করেনি। যদি সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া হতো, তাহলে এত সমালোচনার সুযোগ থাকত না।
আইন ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলেন, কিছু কিছু ধারায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তুলনায় সাজা কমানো এবং জরিমানার বিধান আরোপ ছাড়া তেমন পরিবর্তন করা হয়নি। নতুন আইনে ভুক্তভোগীদের জন্য যে খুব বেশি সুবিধা রাখা হয়েছে তাও নয়। তাদের মতে, পরিবর্তিত আইনে এমন কিছু ধারা অন্যভাবে থেকেই যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো পুলিশ অফিসার যদি মনে করে এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে বা হওয়ার সম্ভাবনা আছে বা সাক্ষ্যপ্রমাণাদি হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছে ফেলা, পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে দুষ্প্রাপ্য হতে পারে, তবে তিনি, তার বিশ্বাসের কারণ লিখে রেখে, নিচে উল্লিখিত কাজগুলো করতে পারবেন :
(ক) সংশ্লিষ্ট স্থানে প্রবেশ করে তল্লাশি এবং প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; (খ) ওই স্থানে তল্লাশির সময় প্রাপ্ত অপরাধ সংঘটনে ব্যবহার্য কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, তথ্য-উপাত্ত বা অন্যান্য সরঞ্জামাদি এবং অপরাধ প্রমাণে সহায়ক কোনো দলিল জব্দকরণ; (গ) ওই স্থানে উপস্থিত যে কোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশি; (ঘ) ওই স্থানে উপস্থিত কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ করেছেন বা করছেন বলে সন্দেহ হলে তাকে গ্রেফতার; (২) উপ-ধারা (১) এর অধীন তল্লাশি সম্পন্নের পর পুলিশ অফিসার তল্লাশি পরিচালনার রিপোর্ট ট্রাইব্যুনালে দাখিল করবেন।
এদিকে সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে অংশীজনের সমালোচনার জবাবে মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, যারা সমালোচনা করছেন উনারা জিনিসটা না পড়েই মন্তব্য করছেন। উনারা বোঝেননি বলেই মন্তব্য করছেন। উনারা আমাদের কোনো পদক্ষেপকেই ভালো মনে করেন না। তার কাছে প্রশ্ন ছিল এ আইনটাও জনগণের ভোগান্তির কারণ হবে বলে অভিযোগ করছেন অনেকে।
এদিকে নতুন আইনের খসড়ায় পুরোনো ধারা রাখার বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ৪৩ ধারাটি সংশোধন করা উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। তবে আইন সংশোধনের বিষয়টি নির্ভর করছে পারিপাশ্বিক অবস্থার ওপর।
আইন যাতে সর্বসাধারণের জন্য সর্বাধিক কল্যাণকর হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারা নিয়ে নতুন করে ভাবা উচিত। নতুন আইনেও জনগণ যাতে হয়রানির আশঙ্কায় না থাকে সে বিষয়ে সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, যে আইন মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে অথচ জনগণের জন্যই আইনটি করা হচ্ছে-এমন বিষয় পুনর্বিবেচনা করতে হবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. কাজী রিয়াজুল হক বলেন, যদি ৪৩ ধারা থেকেই যায়, তবে আইন সংশোধন করে লাভ কী হলো! নতুন আইনে কিছু কিছু ধারায় শাস্তি কমিয়েছে। কিন্তু শঙ্কা থেকেই গেল। আইনটি করার আগে কারও মতামত নেওয়া হয়নি। মানুষকে আইনের খসড়া দিলে ভালো হতো। আইনটি পড়েই দেখলাম না। অথচ এটা পড়া খুবই প্রয়োজন ছিল।
ড. রিয়াজুল হক মনে করেন, মানহানির মামলায় জরিমানার অর্থ কে পাবে তাও স্পষ্ট নয়। আইনে সুনির্দিষ্ট করে বলতে হবে জরিমানার অর্থ রাষ্ট্র নাকি ব্যক্তি পাবেন।
সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, নতুন আইনের ২-৩ জায়গায় লোক দেখানো শাস্তি কমানো হয়েছে। এতে এ আইনের অপব্যবহারে শিকার ব্যক্তিদের জন্য কোনো সুখবর নেই। আগে যাদের সাত বছর জেল হতো এখন তাদের ৩ বছর হবে। এতে পুলকিত হওয়ার মতো কিছু দেখছি না।
তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মূল আপত্তির জায়গাগুলোতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তিনি আরও বলেন, অংশীজনদের আইনের খসড়া দিতে হবে। সারা দুনিয়ায় এ ধরনের আইনের খসড়া জনগণের সামনে প্রকাশ করা হয়। নেওয়া হয় মতামত। কিন্তু আমাদের দেশে সংসদে উত্থাপনের পরই আইন পাশ হয়ে যায়। তার আগে মানুষ কিছুই জানতে পারেন না।
আইনমন্ত্রী বলছেন, যারা সমালোচনা করছেন তারা আইন না পড়েই সমালোচনা করছেন। মন্ত্রীর এমন মন্তব্যের পর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রীর এভাবে বলাটা শোভন নয়। কারণ আইন সংশোধনের বিষয়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি।
আইনের প্রায়োগিক দিকটাও বিবেচ্য বিষয়। সরকার কারও মতামত নিয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। তিনি আরও বলেন, আইনে বিভিন্ন দিক নিয়ে সবার মন্তব্য প্রায় কাছাকাছি। জনগণ কিংবা অংশীজনের সঙ্গে এ বিষয়ে যদি আলোচনা কিংবা মতামত নেওয়ার মানসিকতা থাকত তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।
তিনি বলেন, আইন প্রণয়ন কিংবা সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে তা সাধারণ মানুষের জন্য আতঙ্কের কারণ হবে কেন। ৪৩ ধারায় পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার, দেহ তল্লাশি ও সরঞ্জাম জব্দের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ছিল। নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে এ ধারাটি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। নূর খান মনে করেন, পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারের এ ধারাটি বিতর্কমুক্ত হলো না। এ ধারার অপপ্রয়োগের আশঙ্কাও ব্যক্ত করেন তিনি।
বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সংশোধনও নয়, আবার বাতিলও নয়। এটি পরিবর্তন করা হয়েছে মাত্র। যদিও সোমবার তিনি বলেছিলেন আইনটি রহিত করা হয়েছে। এটা নিয়ে আর ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই। তার ঠিক একদিন পরই তিনি বলেছেন, আইনটি পরিবর্তন করা হয়েছে।
অনেকেই বলছেন, আইন নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যারা ভুক্তভোগী এবং যাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের মতামত নেওয়া হয়নি। এ প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, পুরোনো মামলাগুলোর বিচারকাজ আগের আইনেই চলমান থাকবে। আগের আইনেই বিচার হবে। তবে বর্তমান আইনে যেহেতু সাজা কমানো হয়েছে, তাই মামলাগুলো নতুন আইনে নেওয়া যায় কিনা- তা নিয়ে ভাবছে সরকার।
তিনি আরও বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা বসব। আগে যে মামলাগুলো হয়েছে সেগুলো নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করব। আইনটি বাতিলের দাবিতে দেশে বিভিন্ন সময়ে সোচ্চার হয়েছেন অধিকারকর্মীরা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পাশাপাশি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারও এ আইনের ব্যবহার অবিলম্বে স্থগিত করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের শর্তের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
আইনমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট সংশোধন হয়নি, আবার কেউ যদি বলে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট রহিত করা হয়েছে সেটাও সম্পূর্ণভাবে ঠিক হবে না। পরিবর্তন হয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা আইন জনগণের ভোগান্তির কারণ হবে বলে বিএনপিসহ বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। ড. শাহদীন মালিকসহ কয়েকজন আইনজীবী বলেছেন, নতুন আইনে মানুষের হয়রানি কমবে না এবং এ আইনে পুলিশকে অবারিত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আনিসুল হক বলেন, উনারা আমাদের কোনো পদক্ষেপই ভালো মনে করেন না। তবে আমাদের পদক্ষেপগুলো দেশের জন্য ভালো হয়। তিনি জানান, আগামী সেপ্টেম্বর মাসে নতুন আইন পাশের জন্য জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে।