একান্ত সাক্ষাৎকারে জিএম কাদের
দেশে চলছে আওয়ামীতন্ত্র আর আওয়ামীক্রেসি
শেখ মামুনুর রশীদ
প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপি বলেছেন, ছকে সাজানো আরও একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ফের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে চায়। তারা আবার ক্ষমতায় এলে দেশে পুরোপুরি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষের মৌলিক অধিকার, কথা বলার ন্যূনতম স্বাধীনতা বলে আর কিছু থাকবে না। রাজনৈতিক দল বলে যদি কিছু থাকে, সেগুলোও আওয়ামী লীগের আজ্ঞাবহ হিসাবে থাকবে। জনগণের জন্য কথা বলবে এমন কণ্ঠ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকারকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক বলা যায় না। কারণ এ সরকারের শাসনামলে দেশে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। তারা যা করছে তাকে আওয়ামীতন্ত্র বলা যায়। ইংরেজিতে আওয়ামীক্রেসিও বলা যায়। ডেমোক্রেসির জায়গায় আওয়ামীক্রেসি বলা যায়। এখন গণতন্ত্রের জায়গায় আওয়ামীতন্ত্র আর ডেমোক্রেসির জায়গায় আওয়ামীক্রেসি চলছে; যা গণতন্ত্রের শতভাগ পরিপন্থিই শুধু নয়, গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চ‚ড়ান্ত পথ। আওয়ামী লীগের হাত ধরে এটি যতই এগিয়ে যাবে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার চেতনা ততই বিপর্যস্ত হবে, ধ্বংস হবে। মানুষের চাওয়া-পাওয়ার অধিকার,মানবাধিকার ও আইনের শাসন ধ্বংস করা হবে। শোষণ, অপশাসন, বৈষম্য, বঞ্চনা, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, বেকারত্ব বাড়তেই থাকবে।
সম্প্রতি যুগান্তরকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এসব কথা বলেন। বনানীতে তার কার্যালয় রজনীগন্ধায় দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সংসদ নির্বাচনসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। এ সময় রাজপথে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মুখোমুখি অবস্থান, নির্বাচন সামনে রেখে ক‚টনীতিকদের নানামুখী তৎপরতা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু, এক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির অবস্থান, সদ্যঘোষিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতির প্রভাব, দেশের আর্থ-সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি খোলামেলা কথা বলেন।
প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আপন ছোট ভাই জিএম কাদের ইতোমধ্যেই একজন সজ্জন রাজনৈতিক নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সাধারণ মানুষের অধিকারের প্রশ্নে তিনি সরব ও সোচ্চার। শিক্ষা জীবন, পেশাগত জীবন এবং রাজনৈতিক জীবনে রয়েছে অসাধারণ সাফল্য। জিএম কাদের ছাত্রজীবনেই অত্যন্ত মেধাবী হিসাবে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তার স্ত্রী শেরিফা কাদের বর্তমান জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের সদস্য। এ ছাড়া দেশবরেণ্য সংগীতশিল্পী হিসাবে খ্যাতি রয়েছে তার। ছেলে সামস্ কাদের উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য কানাডা আছেন। আর কন্যা ইসরাত জাহান কাদের সপরিবারে থাকছেন অস্ট্রেলিয়ায়।
জিএম কাদেরকে ২০১৯ সালের ৪ মে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর থেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। জিএম কাদের ১৯৯৬ সালে লালমনিরহাট-৩ আসন থেকে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে রংপুর-৩ আসন থেকে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ এবং ২০১৮ সালে পুনরায় লালমনিরহাট-৩ থেকে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমান একাদশ জাতীয় সংসদের উপনেতার দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে বেসামরিক বিমান, পরিবহণ ও পর্যটনমন্ত্রী ছিলেন। বাণিজ্যমন্ত্রী হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। মন্ত্রী হিসাবেও তার দক্ষতা, সততা ছিল প্রশংসনীয়।
যুগান্তর : আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি কার্যত মুখোমুখি অবস্থানে। পালটাপালটি সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে তারা সরব। এতে করে পরিস্থিতি কি ক্রমেই সংঘাতময় হয়ে উঠছে, কী মনে হয় আপনার?
জিএম কাদের : দুই দলের এ মুখোমুখি অবস্থানকে আমি ব্যক্তিগতভাবে নেতিবাচক বলেই মনে করি। দলগুলো একইদিনে পালটাপালটি কর্মসূচি দিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিলে রাজনীতি সংঘাতময় হয়ে ওঠার শঙ্কা থাকে। আমি মনে করি, দুই পক্ষেরই সাংঘর্ষিক রাজনীতি এড়িয়ে চলা উচিত। তা না হলে ভবিষ্যতে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে, কারও জন্যই তা মঙ্গলজনক হবে না।
আওয়ামী লীগ কিংবা ১৪ দল যা করছে, তা সত্যিই দুঃখজনক। এটি এক ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড। এতে করে সংঘাতের দিকে দেশ ধাবিত হবে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাইকে আরও দায়িত্বশীল ভ‚মিকা পালন করতে হবে। শান্তিপূর্ণভাবে যে যার অবস্থান থেকে মতপ্রকাশ করবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করবে-এমনটাই আমার প্রত্যাশা।
যুগান্তর : বর্তমান অবস্থায় করণীয় কী বলে মনে করেন আপনি?
জিএম কাদের : রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য, নিজের মতপ্রকাশে নানা কর্মসূচি পালন করবে। এটি যাতে সবাই সমানভাবে করতে পারে, শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করতে পারে, সে সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু তা না করে খোদ সরকারি দল যদি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়, যেটা সংঘাত উসকে দেয় কিংবা সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি করে-সে বিষয়কে আমরা কোনোভাবেই ইতিবাচক বলতে পারি না। তাই আমি মনে করি, এ ক্ষেত্রে মূল দায়িত্ব সরকারি দলের। তাদেরই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে বেশি।
যুগান্তর : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের ক‚টনীতিকদের নানামুখী তৎপরতা চলছে। এটিকে একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তাদের অযাচিত হস্তক্ষেপ বলে মনে করছেন অনেকে। আপনি কী মনে করেন?
জিএম কাদের : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের ক‚টনীতিক এবং দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা সম্প্রতি বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন। তারা আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চান। সরকার যদি নির্বাচনি ব্যবস্থাটাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে না দিত, তবে তাদের এ চাওয়ার কোনো মূল্য ছিল না। আজ যে বিদেশিরা কথা বলছেন, এটা তো সরকারের ব্যর্থতার কারণেই বলছেন।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সরকারি দল কোনো অবস্থাতেই ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন করছে, তাদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দেওয়া হচ্ছে। বিরোধী নেতাকর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। তাদের আটক করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময় খুন-গুমসহ নানাভাবে ভীতিকর পরিবেশ সরকার সৃষ্টি করেছে। বিরোধীদের আন্দোলন-সংগ্রামসহ সভা-সমাবেশে বাধা দিয়েছে। সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশে স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে হরণ করা হয়েছে। এমনকি গণমাধ্যমগুলোকেও নানান আইনি বেড়াজালে তারা নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে। এ অবস্থায় যদি বিদেশিরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চান, এটাকে তো আমরা কোনোভাবেই স্বাধীনতা কিংবা সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি বলে মনে করি না।
এছাড়া দেশের জনগণের স্বার্থে তারা অর্থাৎ পশ্চিমারা অতীতেও কার্যকর ভ‚মিকা পালন করেছেন, আমরা তা দেখেছিও। বিশেষ করে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিষয়ে তারা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছেন। গার্মেন্ট খাতে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করাসহ তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে বেশ সোচ্চার হয়েছিলেন। সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। গার্মেন্ট শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, কাজের অনুক‚ল পরিবেশ সৃষ্টি এবং বেতন কাঠামো ভালো না হলে তারা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন।
এ অবস্থায় তখন আমরা কী দেখলাম, আমরা দেখলাম, তাদের চাপ কিংবা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গার্মেন্ট শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তাদের কাজের সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়েছে। শ্রমিকদের অধিকার এবং শ্রমের যথাযথ মজুরি নিশ্চিত হয়েছে। আমাদের গার্মেন্ট খাত আগের তুলনায় এখন অনেক ভালো। শ্রমিকরাও আগের তুলনায় ভালো আছেন। তাদের কর্মক্ষেত্রে কাজের পরিবেশও সুন্দর হয়েছে। এটি কিন্তু বিদেশিরা বা পশ্চিমারা তাদের স্বার্থে করেনি। আমাদের স্বার্থেই করেছে। আমাদের জনগণের স্বার্থে করেছে। অথচ এ কাজটি রাজনৈতিক দলগুলো বা সরকারের করার কথা। তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলেই বিদেশিদের চাপ প্রয়োগ করে এ কাজটি করাতে হয়েছে।
বর্তমানে আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ হুমকির মুখে। আমরা মনে করি, এ মুহূর্তে গণতন্ত্রের চর্চা করা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছে না। বিরোধী দলগুলো সভা-সমাবেশ, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করতে পারছে না। আইন-কানুন ব্যবহার করে এবং নতুন নতুন আইন-কানুন তৈরি করে সরকার প্রশাসনকে ব্যবহার করে বিরোধী দলগুলোকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। শুধু তাই নয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার পাশাপাশি গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক দলকেও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে সরকার।
আজকে সরকারের বিপক্ষে কথা বলতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। অথচ সরকারের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা, সরকারের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করা এটা তো রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া হচ্ছে। দেশে এখন মতপ্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। বিদেশিরা তো এ নিয়েই কথা বলছেন। তারা এখন পর্যন্ত যা বলেছেন, তা অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত কথাই বলেছেন। বিদেশিরা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বাতিল চান। মুক্ত গণমাধ্যম চান। মুক্ত গণতান্ত্রিক চর্চা দেখতে চান। বাংলাদেশে আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চান। এটি শুধু তাদের কথার কথা নয়, তারা মনেপ্রাণেই এটি চান। বিদেশিরা মনে করেন, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থেই এটি হওয়া দরকার। এ দেশের মানুষও তাদের এ ভ‚মিকাকে ইতিবাচক হিসাবে নিয়েছে, স্বাগত জানিয়েছে।
বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমাদের যে সম্পর্ক, বিনিয়োগ-ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানামুখী সম্পর্কের কারণেও তারা মনে করেন বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সবার জন্য শুভ ফল বয়ে আনতে পারে। সে কারণেই তারা এ নিয়ে কথা বলছেন। এটি হলে তারা খুশি হবেন। না করলে এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের তাদের দেশের আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন। এটি তাদের অধিকার। এর বিপক্ষে কারও অবস্থান নেওয়ার কথা নয়। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকেও এর বিপক্ষে কিছু বলার নেই। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি ন্যায়সঙ্গত নয়-এটি বলার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না; যা জনগণের ভালোর জন্য হচ্ছে, তা সবাইকে মেনে নিতে হবে। ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। এখানে বাধা দেওয়ার কিছু নেই। তাই বিদেশিদের এ উদ্যোগকে স্বাধীনতা কিংবা সার্বভৌমত্বের প্রতি কোনো হুমকি বলে আমি মনে করি না। যারা এটাকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি বলছেন-তারা কোন যুক্তিতে বলছেন, তা আমি জানি না। আমি মনে করি, যারা এসব কথা বলছেন, এটি তাদের এক ধরনের অপকৌশল মাত্র।
যুগান্তর : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশিরা এ দেশের নির্বাচন নিয়ে কি আসলে খুব উদগ্রীব, নাকি এর পেছনে তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। কী মনে হয় আপনার?
জিএম কাদের : আমেরিকাসহ তাদের মিত্রদের নিয়ে যেটি বলা হচ্ছে, অর্থাৎ তারা এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চায়-আসলে এটি সরকারের পক্ষ থেকে একটি ভুল প্রচার কিংবা অপপ্রচার। এখন পর্যন্ত আমরা এ রকম কোনো আলোচনার খবর পাইনি বা এ রকম কিছু আমাদের জানাও নেই। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আলাপ-আলোচনায় এ রকম কোনো প্রসঙ্গ আসেনি কখনো। এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাইনি। সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নিয়ে কেউ হাজিরও হননি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তাদের মিত্ররা যেটি বলেছেন, তা অত্যন্ত সাদামাটা কথা। তারা এ দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চান। এর সঙ্গে তাদের অন্য কোনো স্বার্থ জড়িত আছে কী নেই বা সেটি যদি থাকেও, সে সম্পর্কে এখনো কেউ পরিষ্কার কোনো সাক্ষী-প্রমাণ দিতে পারেনি।
যারা এসব কথা বলছেন-তারা শুধু তাদের এ উদ্যোগকে দমন করার জন্য এবং তাদের মানুষের চোখে হেয় করার জন্য এসব কথা বলছেন। এভাবে আগবাড়িয়ে কথা বলাটা একেবারেই কল্পনাপ্রসূত। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি সত্যিকার অর্থে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য-প্রমাণ নিয়ে আসতে পারেন-তখন এ বিষয়ে কথা বলা যেতে পারে। তবে যেটাই নিয়ে আসুক, প্রথম কথা হলো-বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের যে দাবি, সেটাই তারা বলছেন। আমরা মনে করি, আমাদের ভোটে সরকার পরিবর্তন হোক অথবা সরকার থাকুক। আমাদের ভোটে সরকার নির্বাচিত হোক। আমাদের ভোট দেওয়ার অধিকারটা যেন থাকে। এটি অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত দাবি এবং এজন্যই দেশ স্বাধীন হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল। বর্তমান সরকার মানুষকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে বিভিন্নভাবে। যে কারণে মানুষ বিদেশিদের বক্তব্য মেনে নিয়েছে।
যুগান্তর : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে বলেছেন, আমেরিকা সেন্টমার্টিন চায়। তারা তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। এর অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথার আড়ালে ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। কী মনে হয় আপনার?
জিএম কাদের : এ বিষয়ে উনার (প্রধানমন্ত্রী) কাছে যদি কোনো তথ্য থাকে, তা আমাদের জানাননি। এখন পর্যন্ত আমেরিকা সরকার পরিবর্তনের বিষয়ে কোনো কথা বলেছে বা এ রকম কোনো আলাপ-আলোচনা হয়েছে বলেও আমার জানা নেই। সেন্টমার্টিনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, সে বিষয়ে তিনিই ভালো বলতে পারবেন। উনি (প্রধানমন্ত্রী) যেহেতু বলেছেন, আমরাও ধরে নেব আমেরিকা সেন্টমার্টিন চেয়েছে। তবে আমরা এ বিষয়ে জানি না। আমেরিকাও বিষয়টি কোথাও স্বীকার করেনি।
যুগান্তর : মার্কিন ভিসানীতি, তাদের স্বার্থ আদায়ে বর্তমান সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ প্রয়োগের কৌশল কিনা। কী মনে হয় আপনার?
জিএম কাদের : একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্যই মার্কিন ভিসানীতি, এমনটাই আমি মনে করি। এর বাইরে আর কিছু আছে বলে মনে করি না। তারা মনে করছে, এতে করে বাংলাদেশে একটি সত্যিকারের স্থিতিশীলতা আসবে। গণতন্ত্র সুসংহত হবে।
যুগান্তর : তাহলে কি এখন দেশে স্থিতিশীলতা নেই বলে মনে হয়?
জিএম কাদের : এখন স্থিতিশীলতার নামে যেটি বলা হয়, সরকার যেটি প্রচার করে, অনেক সময়-এক সরকার বেশিদিন ক্ষমতায় থাকলে রাজনীতি ও সমাজ স্থিতিশীল হয়, উন্নয়ন ও অগ্রগতি হয়। এ কথাটা সত্য নয়। এর সঙ্গে আমি বহুবার দ্বিমত পোষণ করেছি। স্থিতিশীলতার অর্থ হচ্ছে যেখানে সরকার পরিবর্তন হবে, কিন্তু সমাজের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এগিয়ে যাবে, এটা কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত হবে না। আমি মনে করি, রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তিত হতে পারে; কিন্তু আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি ঠিক থাকবে, সমাজ ও রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে-এটাই স্থিতিশীলতা। আমি মনে করি, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি স্থিতিশীলতার সম্পূর্ণ বিপরীত।
যুগান্তর : আপনি বলছেন দেশে আওয়ামী প্লাস রাজনীতি চলছে। বিষয়টি একটু খোলাসা করে বলবেন, আসলে এর মধ্য দিয়ে কী বোঝাতে চান আপনি?
জিএম কাদের : আওয়ামী লীগ এখন দেশে যে শাসনব্যবস্থা চালু করেছে এবং যে পদ্ধতিতে নির্বাচন করছে, আমরা যা দেখেছি, তাতে একটি বিষয় পরিষ্কার-তারা পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাটাকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। নিজেদের মনমতো সংবিধান পরিবর্তন এবং কিছু আইন-কানুনও পরিবর্তন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানানো হয়েছে। নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ পুরো প্রশাসনে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, দলীয় আনুগত্যের নামে দেশকে সম্পূর্ণ বিভাজন করা হয়েছে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। দেশকে বিভাজন করে একশ্রেণির সুবিধাভোগী গোষ্ঠী আরেকটি শ্রেণিকে শাসন-শোষণ করতে এ বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ব্রিটিশ আমল থেকে বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রাম করে আসছে। এরও আগে রাজা-মহারাজারা আমাদের শাসন-শোষণ করত। জমিদার শ্রেণি শোষণ করত। আমাদের ভেতর থেকেই নানান ধরনের ক্লাস বা শ্রেণি তৈরি করা হয়েছিল। একটা সুপিরিয়র ক্লাস তৈরি করা হয়েছিল। পরে মানুষ এ থেকে মুক্তি চেয়েছিল। মুক্তির লড়াইয়ে শামিল হয়েছিল।
পাকিস্তান আমলে বলা হলো আমরা সবাই মুসলমান, আমরা এক দেশের বাসিন্দা, সবাই মিলে একসঙ্গে চলব। এখানে সবাই সমান অধিকার ভোগ করব; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে রাখা শুরু করল। এখানকার মানুষকে ছোট করে দেখার চেষ্টা করা হলো। আমাদের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা হলো। আমরা দেখলাম যে, সেখানেও তারা একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি করেছিল। সরকারের সমর্থক আশীর্বাদপুষ্ট একটি এলিট শ্রেণি তৈরি করা হলো। কিছু মানুষকে ব্যবসা-বাণিজ্য করার অবারিত সুযোগ দেওয়া হলো। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ লুটে নিয়ে তারা সম্পদশালী হলো। এ অঞ্চলের সম্পদ তারা ওই অঞ্চলে নিয়ে যেত। এই যে বৈষম্য, এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের মানুষ আবার লড়াই-সংগ্রাম শুরু করল। অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, বেকারত্ব বাড়ছিল, এ কারণে এখানকার মানুষ মুক্তি চাচ্ছিল। যেমনটি ব্রিটিশ আমলে চেয়েছিল, তেমিন পাকিস্তান আমলেও।
এ মুক্তির সংগ্রামে এখানকার মানুষ প্রথমেই চেয়েছিল স্বায়ত্তশাসন। কারণ অন্যরা শাসন করলে এ বৈষম্য থেকে মুক্তি মিলবে না। তাই পাকিস্তানিরা এটাকে বাধাগ্রস্ত করতে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখন এ অঞ্চলের মানুষ মনে করল বৈষম্যের হাত থেকে মুক্তি পেতে একটি নিজস্ব দেশ দরকার। স্বাধীন দেশ দরকার। যে দেশের মালিক হব আমরা। ক্ষমতার মালিক হব আমরা। আমরা আমাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করব। তাদের দ্বারা দেশ চালাব। ভোটের মাধ্যমে আমাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। আমাদের কথামতো না চললে, আমাদের কথা না শুনলে ভোটের মাধ্যমেই আবার তাদের পরিবর্তন করব।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও ছিল বৈষম্যমুক্ত একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। বৈষম্যের কারণে যে বঞ্চনা হয়, মানুষকে যে অবিচারের শিকার হতে হয়-তার ফলে যে দারিদ্র্য আসে, এ থেকে মুক্তির জন্য দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল একটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য। একটি স্বাধীন দেশ, যার ক্ষমতার মালিক হবে দেশের জনগণ। জনগণই ঠিক করবে এ স্বাধীন দেশ কীভাবে চলবে। কে জনপ্রতিনিধি হবে। তাদের কথামতো সেই প্রতিনিধিরা দেশ চালাবে। আবার জনগণই প্রয়োজন মনে করলে তার প্রতিনিধি পরিবর্তন করবে ভোটের মাধ্যমে। এটাই ছিল স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এখন আওয়ামী লীগ যেটি করেছে, এ দুটোকেই তারা বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে।
একটা কথা বুঝতে হবে, আমরা একই ভাষায় কথা বলি। ধর্ম প্রায় একই। সংস্কৃতিও অভিন্ন। বৈষম্যের খুব একটা সুযোগ এখানে ছিল না। ধনী-গরিবের বৈষম্য এখানে তুলনামূলক অনেক কম ছিল। স্বাধীনতার পরপরই যারা ক্ষমতায় ছিল, তখন এত বৈষম্য ছিল না। বিএনপি ক্ষমতায় এসে দলীয়করণ শুরু করে এক ধরনের বৈষম্য শুরু করল। দলের লোক হলে এক ধরনের সুযোগ-সুবিধা হবে। দলের লোক না হলে আরেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা হবে। এটা তারা প্রথম দেশে শুরু করে। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এটা আরও ব্যাপকভাবে শুরু করল। তারা শুধু দলীয়করণই নয়, আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে দলের বাইরে থাকা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা, যেমন-সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী, যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত নন, তাদেরও দলে টানা শুরু করল।
এজন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা নন, মুক্তিযোদ্ধার পরিবার আর মুক্তিযোদ্ধার পরিবার নন-এটি তৈরি করে একটি আর্টিফিশিয়াল ব্যারিয়ার সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ। সেখান থেকে তারা পছন্দ করে নিজেদের দলে নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকের বয়স ছিল চার বা পাঁচ বছর, তাদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দলে নিয়েছে। এভাবে নিজস্ব একটি গণ্ডি সৃষ্টি করেছে। এ সুবিধাভোগী বা সুবিধাবাদী গণ্ডিটা যখন যেখানেই থাকুক, তারা সব সময় আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করছে। তারা আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ড ব্যবহার করছে। এ লোকরাই হচ্ছে আওয়ামী লীগ প্লাস বা বেনামি আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ এসব লোককে ব্যবহার করে যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নষ্ট করেছে, তেমনি বৈষম্যমুক্ত সমাজ তৈরি না করে বরং বৈষম্যমূলক সমাজ সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষের মাঝে বঞ্চনা তৈরি করেছে। এখন একশ্রেণির মানুষ প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের নিচু করে দেখা হচ্ছে, যা পাকিস্তান আমলে করা হয়েছিল; যা পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বেলায় করেছিল, সেই কাজটিই এখন আওয়ামী লীগ করছে। এখন আমাদের মধ্যেও একটা ক্লাস বা শ্রেণি তৈরি করা হয়েছে, যেটা আওয়ামী লীগ প্লাস। চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সুযোগ-সুবিধা, গাড়ি-বাড়ি, প্লট-ফ্ল্যাট, ব্যাংক ঋণসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা তারা নিচ্ছে। বাকিরা বঞ্চিত হচ্ছে। প্রশাসন, পুলিশসহ সব ক্ষেত্রে তারা সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। বাকিরা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।
এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করেছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন কমিশনসহ সব জায়গায় এ বেনামি আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগ প্লাসের রাজত্ব চলছে। এরা বৈষম্যমুক্ত সমাজ সৃষ্টি না করে বরং বৈষম্য বাড়িয়েছে। বঞ্চনার সৃষ্টি করেছে। নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ কুক্ষিগত করেছে। মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার মূল চেতনা-আমি ভোট নিয়ে আমার পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচন করব। আমার কথা অনুযায়ী-আমার প্রতিনিধি দেশ চালাবে। ব্যত্যয় ঘটালে আবার ভোটের মাধ্যমেই তার পরিবর্তন করব। আওয়ামী লীগ এটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছে। এখন মানুষ ভোট দিতে পারে না। তারা যেভাবে চাইবে, যাকে চাইবে, সে জয়ী হবে। ইচ্ছামতো ফল ঘোষণা করে নিজেদের প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের এখানে অংশগ্রহণ নেই। মতামতও নেই। সংবিধান অনুযায়ী দেশের ক্ষমতার মালিক জনগণ, তা আর নেই। সব ক্ষমতার মালিক এখন আওয়ামী লীগ।
জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার হবে জনগণের সরকার। যারা জনগণের পক্ষে কাজ করবে। এটাকেই আমরা গণতন্ত্র বলি। আর রাজতন্ত্র কাকে বলে, রাজা যাকে চাইবেন, যা বলবেন, তাই হবে। এটাকে আমরা রাজতন্ত্র বলি। রাজার সরকারে যিনি কাজ করেন, রাজা যাকে নির্বাচিত করবেন, তিনি রাজার জন্যই কাজ করবেন। এখন আমরা দেখছি আওয়ামী লীগের দ্বারা নির্বাচিত সরকার, তারা আওয়ামী লীগের সরকার। এ সরকার আওয়ামী লীগের স্বার্থে কাজ করছে।
যুগান্তর : আগামী নির্বাচন কেমন হবে বলে মনে করেন আপনি?
জিএম কাদের : আমার ধারণা বা আমার বিশ্বাস লার্জ স্কেলে আমরা বাজার থেকে চাল, ডাল বা অন্য কিছু যখন কিনি, তখন প্রথমে নমুনা সংগ্রহ করি। টেস্ট করে দেখি। যেমন ধরেন আম কেনার সময় আমরা অনেকেই এটা টেস্ট করে দেখি। আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগের অধীনে কেমন হবে-এ নমুনাটা কিন্তু তারা দেখিয়ে দিয়েছে সদ্যসমাপ্ত ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে। গুলশান, বনানী, বারিধারাসহ এ এলাকার যারা ভোটার তারা সারা বাংলাদেশেই প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। এখানে গরিব থেকে সর্বোচ্চ ধনী লোকের বসবাস। এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় উপনির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের সময় বিদেশি রাষ্ট্রদূত এবং দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা এখানে উপস্থিতি থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা দেখতে চেয়েছিলেন তাদের উপস্থিতিতে সরকার কী নির্বাচন উপহার দেয়। বিশ্ববাসী যখন দেখতে চেয়েছে, তখন সবার সামনে সরকার নির্বাচনের এ নমুনা দেখিয়েছে। এরপর কী আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে। সরকার দেখিয়ে দিয়েছে যে, তাদের অধীনে আগামী নির্বাচন কেমন হবে। সরকার যদি এরপরও দাবি করে যে, আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে-এটা দেশের কেউ বিশ্বাস করবেন কিনা আমি জানি না। এটি নিয়ে কথা বলাটাই আমি মনে করি অর্থহীন।
সরকারি দল প্রকাশ্য দিবালোকে, সবার উপস্থিতিতে যে নির্বাচন উপহার দিয়েছে, এতে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, তাদের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা নেই। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন দেখার পর আগামী নির্বাচন কেমন হবে-তা নিয়ে কারও মনে দ্বিধা-দ্ব›দ্ব থাকার কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। ঢাকা-১৭ আসনে নির্বাচনের এ স্যাম্পল বা নমুনা টেস্ট করার পর আর জনগণ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। কারণ তারা মনে করে, ভোট দিলে কী হবে আর না দিলেই বা কী হবে। ফলাফল তো ঠিক করাই আছে। দিনশেষে ফলাফল সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষেই ঘোষণা করা হবে। এরপরও অনেকে ভোট দিতে গেছেন। কিন্তু তারা সেখানেও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। অনেককে ভোটকেন্দ্রে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। অনেককে জোর করে বের করে দেওয়া হয়েছে। অনেক এজেন্টকে পর্যন্ত বের করে দেওয়া হয়েছে। একজন প্রার্থীকে তো সবার সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে মারধর করা হয়েছে, বেধড়ক পিটুনি দেওয়া হয়েছে।
যুগান্তর : জাতীয় পার্টি কি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে?
জিএম কাদের : জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা, তা এখনই বলা কঠিন। আর আমি এককভাবে জাতীয় পার্টির কেউ নই। দলের সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আমরা ঠিক করব। পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেব। আমি যা বললাম তা পার্টির চেয়ারম্যান হিসাবে আমার মতামত। আমি দলীয় ফোরামে আমার কথা তুলে ধরব। সবাই মিলে দেশ ও জাতির স্বার্থে কী সিদ্ধান্ত নেয় পরে তা দেখার বিষয়। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দল এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, যা জনগণের স্বার্থের বাইরে যায়।
যুগান্তর : আপনার মতে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী?
জিএম কাদের : আওয়ামী লীগকে সব সময় গণমুখী বা জনগণের রাজনৈতিক দল মনে করতাম, ধারণা করতাম, ভাবতাম। দীর্ঘদিনে তারা এটা অর্জন করেছিল। কিন্তু টানা ১৫ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগ আর সেই দলে নেই। তারা এক সময় জনগণের রাজনৈতিক দল ছিল। এখন জনগণের মন থেকে পুরোপুরি উঠে গেছে। একটি কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগ এ ক’বছরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এ মুহূর্তে দেশের জনগণ আওয়ামী লীগকে তাদের পক্ষের শক্তি হিসাবে গ্রহণ করছে না, ভাবছে না। জনগণের বিপক্ষ শক্তি বা জনগণের ক্ষতিকারক শক্তি হিসাবে মানুষ আওয়ামী লীগকে চিহ্নিত করেছে। এটাই তাদের বড় ব্যর্থতা বলে আমি মনে করি।
যুগান্তর : প্রধানমন্ত্রী দাবি করছেন বিএনপি নির্বাচন চায় না, তারা মূলত নির্বাচন বানচাল করতে চায়। তারা অসাংবিধানিক সরকার আসুক তা চায়। আপনার কী মনে হয়?
জিএম কাদের : আমি মনে করি, ১৯৯০ সালে দেশে একটি সাংবিধানিক সরকার ছিল। জাতীয় পার্টির সরকার সাংবিধানিক সরকার ছিল। এর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত এবং কিছু বামদল মিলে আন্দোলন করেছে। ‘নির্বাচন ব্যবস্থাটাকে সরকারের অধীনস্থ থেকে বাইরে আনতে চাই’-অনেকটা এ রকম দাবিতে তারা আন্দোলন করে তখন। তারা নির্বাচন বর্জন ছাড়াও বিভিন্নভাবে দেশে একটি অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। তারা চেয়েছিল দেশে যে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হোক না কেন, তাতে কিছু যায় আসে না, জাতীয় পার্টি সরকারের পরিবর্তন যেন নিশ্চিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালে সংবিধানের বাইরে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং তাদের অধীনে নির্বাচন হয়। অথচ জাতীয় পার্টি সরকার কিন্তু তখন আইনগত ও সাংবিধানিকভাবে বৈধ সরকার ছিল। পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। তখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামপন্থিরা চেয়েছিল অনির্বাচিত ও অসাংবিধানিক সরকার। তাই হয়েছে।
আবার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বিএনপি ১৫ ফেব্র“য়ারি একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করে। তারা দলীয় সরকারের অধীনে, নিজস্ব বলয়ে, নিজস্ব আওতাধীন ও সরকারের অধীনস্থ নির্বাচন কমিশন দিয়ে এ নির্বাচন করে। তখন এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ রাজপথে নামে। জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও কিছু বামদল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল। তখন যিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন তিনি আজকের প্রধানমন্ত্রী। তিনি তখন বলেছিলেন, চিরস্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চালু করা উচিত। উনি যা বলতে চেয়েছিলেন, আমি যা বুঝি-তার এ চাওয়ার অর্থ ছিল যে, সরকারের অধীনে থেকে কোনো নির্বাচন না করা। ওই সময় ব্যাপক আন্দোলন হয়। পরে বিএনপি ওই বছরের জুনে আরেকটি নির্বাচন দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে বাধ্য হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে এবং পরে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবে হয়নি। বাকি নির্বাচনগুলো সংবিধানসম্মতভাবেই হয়েছে। ওই নির্বাচনের আইনগত ভিত্তি ছিল না। কিন্তু জনগণ মেনে নিয়েছিল। ২০০৬ সালে এসে আবার কিন্তু আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করল। জাতীয় পার্টি তাদের সঙ্গে ছিল। ক্ষমতায় থাকতে সেই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল শুধু বিএনপি। কারণ, বিএনপি পক্ষপাতদুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেছিল। ভুয়া ভোটার তৈরি করেছিল। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি নির্বাচন বর্জন করে। একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা হলো। যার প্রেক্ষাপটে তখন সেনাসমর্থিত এক-এগারোর সরকার আসে। যেটি ছিল সংবিধানবহির্ভ‚ত ও অনির্বাচিত।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর মহাজোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে। ২০১৪ সালে নির্বাচিত সরকারের অধীনে যে ভোট হয়েছে তার মধ্যে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় জয়ী হয়েছেন সরকার সমর্থকরা। জনগণ ভোট দিতে পারেনি, বাকিগুলোতে র্যাব ও পুলিশ ভোট দিয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন আইনের চোখে বৈধ ছিল, কিন্তু এ নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হয় তাকে জনগণের সরকার বলা যায় না। ২০০৮ সালের নির্বাচনও আইনের চোখে বৈধ, কিন্তু জনগণের চোখে এটি বৈধতা পায়নি। দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন জনগণের বিচারে বৈধতা পাচ্ছে না। কিন্তু অনির্বাচিত সরকারের সময়ের নির্বাচন জনগণ মেনে নিয়েছে।
জনগণের পক্ষের বলে আমরাও অনির্বাচিত সরকারগুলো মেনে নিয়েছি। কাজেই আওয়ামী লীগ এখন যা বলছে, তা বলতে পারে না। তারা নিজেরাও অনির্বাচিত সরকারের জন্য আন্দোলন করেছে। ১৯৯১ ও ২০০৭ সালে যে অসাংবিধানিক সরকার আসে আওয়ামী লীগ কিন্তু তাদের স্বাগত জানিয়েছে। জনগণের পক্ষে কোনো সরকার এলে তা নিয়ে প্রশ্ন করা যায় না। এখন তারা অনির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে বলতে পারে না। আরেকটি কথা, অসাংবিধানিক সরকার হলে যে তা সব সময় জনগণের বিপক্ষের সরকার হবে-এমনটি না-ও হতে পারে। এটাকে দেশবিরোধী কিংবা গণতন্ত্রবিরোধী বলা ঠিক হবে না বলে আমি মনে করি।
যুগান্তর : সরকারবিরোধী শিবিরের দলগুলো কেউ চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আবার কেউ চান জাতীয় সরকার। আপনি বলেছেন, আপনারাও একটি ফর্মুলা দেবেন। সেটা কী?
জিএম কাদের : সরকারের কী চাওয়া, ইলেকশন না সিলেকশন। তারা চায় সিলেকশন। এখন তো সিলেকশনই হচ্ছে। এটি পরিষ্কার হয়ে গেছে। এর বিপক্ষে রাজনৈতিক দলগুলো সরব অবস্থান নিয়েছে। যারা সরকারের তাঁবেদারি করে বিনা ভোটে সংসদ-সদস্য হতে চান তাদের কথা বলছি না। তারা কোনো রাজনীতিবিদই না। তারা সুযোগসন্ধানী-সুবিধাবাদী। এদের কথা আলাদা। এর বাইরে সবাই দেশে আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চান। এজন্য কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলছেন। কেউ জাতীয় সরকারের কথা বলছেন। আসলে তাদের অভিন্ন দাবি একটাই, আর তা হচ্ছে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।
আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপক্ষে কথা বলেছি, এর পক্ষেও বলেছি। আওয়ামী লীগও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছে। এখন এর বিরোধিতা করছে। বিএনপি এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়, এক সময় তারাও এর বিরোধিতা করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে ছিল না। পরে এটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে এ ব্যবস্থা বাতিল করেছে। ’৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে। এর বাইরে আরও কয়েকটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছে। ২০০৭ সালে যে সরকার আসে তা-ও সংবিধানসম্মত ছিল না-কিন্তু আমরা এ রকম সরকার পেয়েছি। যেভাবেই বলি না কেন ২০০৭ সালের সরকারও কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারই।
বিএনপি আগে যে রকম তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়েছিল, এবার সেটা না-ও হতে পারে। আমরা এটাই বলেছি। আসেন, বসেন, কথা বলি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে। নাকি জাতীয় সরকার হবে। নাকি বর্তমান সরকারকে রেখেই নির্বাচন কমিশনকে আরও স্বাধীনতা দিয়ে, ক্ষমতা দিয়ে, শক্তিশালী করে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যায়-এ নিয়ে আলোচনা করি। সবাই মিলে এমন একটা নির্বাচনি ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যা সব সময়ের জন্য থাকবে। মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা যাবে। মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে জনপ্রতিনিধি হিসাবে বেছে নিতে পারবে। প্রতি পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন ইস্যুতে সংকট তৈরি হবে না।
২০০৮ সালের সরকারকে হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা তারা মানেননি। সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক হচ্ছে জনগণ। সংবিধান হবে জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি। একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে মনে করি, আদালত নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলেছে, আমি এত বুুঝি না। সাধারণ মানুষ আমি, ক্ষুদ্র জ্ঞান আমার। তবে আমার ধারণা, নির্বাচিত সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনের কথা বলেছে। আবার এটিও ঠিক, অনির্বাচিত সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে যে নির্বাচন হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য হয়েছে। জনগণ ওই নির্বাচন গ্রহণও করেছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার হলেও তা কিন্তু হয়েছিল অনির্বাচিত সরকারের অধীনে। আদালত হয়তো চেয়েছিল নির্বাচিত সরকার নির্বাচনি ব্যবস্থাটাকে এমনভাবে শক্তিশালী করবে, যাতে নির্বাচন নিয়ে কখনো প্রশ্ন না ওঠে।
যুগান্তর : এ অবস্থায় আপনারা কী চান?
জিএম কাদের : নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন তো আমরাও চাই। কিন্তু নির্বাচিত সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের নির্বাচনে তো ১৫৪টি আসনে জনগণ ভোট দিতে যাওয়ারই প্রয়োজন মনে করেনি। বেশিরভাগ আসনে তো বিনা ভোটে সংসদ-সদস্যরা জয়ী হয়েছেন। এসব আসনে মানুষের ভোটের প্রয়োজনই হয়নি। বাকি আসনগুলোতে ৫ থেকে ১০ শতাংশও ভোট পড়েনি। যেটুকু ভোট পড়েছে তা-ও সিল মেরে দেওয়া হয়েছে। এটা তো জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের সময়েই হয়েছে। যদি প্রশ্ন করা হয়, ওই নির্বাচন আইনসঙ্গতভাবে বৈধ, হ্যাঁ; এটা ছিল বৈধ। নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়েছে, তাই বৈধ। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কথার সঙ্গে তো জনগণের কথা মিলছে না। নির্বাচন কমিশন যেটাকে বলছে বৈধ, জনগণ তো সেটাকে বৈধ মানছেন না।
আমরা মনে করি, জনগণের জন্য দেশ। জনগণের মতামত ও প্রত্যাশা অনুযায়ী হবে আইন। জনগণ বিশ্বাস করে, মনে করে যে আমাদের ভোটে নির্বাচিত সরকার এটা নয়। আইন যদি বৈধতা দেয়, আর জনগণ যদি বিশ্বাস না করে, তাহলে বুঝতে হবে এখানে একটি বড় ধরনের গলদ আছে। আইনের কোনো গলদ আছে। আমরা বিশ্বাস করি, জনগণ দেশের মালিক। তাহলে জনগণের জন্য আইন হবে। আমরা যদি বিশ্বাস করি, যে জনগণই সব ক্ষতার উৎস। জনগণই সব ক্ষমতার মালিক। তাহলে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে আইন হবে। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সংবিধান হবে। সেখানে জনগণই যদি বলে এটা আমাদের ভোটে নির্বাচিত সরকার নয়, তাহলে আইন যদি বলে হ্যাঁ-তাহলে বুঝতে হবে আইনের এখানে ফাঁক আছে। জনগণের মতামতই প্রতিফলিত হচ্ছে না। ফলে অনির্বাচিত সরকারের সময় ভালো নির্বাচনগুলো হয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই দেশের মানুষ ভোটাধিকার ফিরে পাক। আইনের শাসন ও সুশাসন চাই। গণতান্ত্রিক পরিবেশ চাই। দেশে ভোটের নামে যে প্রহসন চলছে, আগামীতে বন্ধ হোক-তা দেখতে চাই।
যদিও বর্তমান সরকার প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ পুরো নির্বাচনি মাঠ এমনভাবে সাজিয়ে রেখেছে যে, তাদের অধীনে নির্বাচনের ফলাফল একই হবে। বিরোধী দলসহ সাধারণ মানুষও এ কথা বিশ্বাস করে। সবাই মনে করেন, সরকারের সাজানো ঘুঁটি বা ছকের মধ্য দিয়ে নির্বাচন হলে অটোমেটিক্যালি রেজাল্ট আসবে যে সরকার জিতে গেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দলীয় সরকারের বাইরে নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান সরকারের রেখে যাওয়া সেটআপ পুরোপুরি বদলাতে হবে। প্রয়োজন মনে করলে নির্বাচন কমিশনকেও ঢেলে সাজাতে হবে।