গণিত-ইংরেজির প্রভাব মাধ্যমিকের ফলে
পাশের হার ও জিপিএ-৫ দুটিই কমেছে
মুসতাক আহমদ
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এবার পাশের হার ও জিপিএ-৫ গত বছরের তুলনায় কমেছে। এসএসসিসহ ১১টি শিক্ষা বোর্ডে পাশের হার ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। যা গত বছর ছিল ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আর সর্বোচ্চ সাফল্য হিসাবে বিবেচিত জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ শিক্ষার্থী। গত বছর ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন জিপিএ-৫ পেয়েছিল। শুক্রবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার এই ফল প্রকাশ হয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এবার প্রধান দুই সূচকে ফল নিম্নগামী হওয়ার নেপথ্যে মোটা দাগে দুটি দিক নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। এগুলোর মধ্যে প্রথমেই আসে গণিত এবং ইংরেজি। এছাড়া সব বিষয়ে পূর্ণ নম্বরে এবং পূর্ণ ৩ ঘণ্টা পরীক্ষা দেওয়ার বিষয়টিও প্রভাব ফেলেছে।
শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনেও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির কাছে প্রশ্ন ছিল- জিপিএ-৫ ও পাশের হার এবার কমল কেন। এর জবাবে তিনি শিক্ষার্থীদের সব বিষয়ে ও পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন।
মাধ্যমিক স্তরের এই পরীক্ষার্থীরা ‘করোনার ব্যাচ’ হিসাবে পরিচিত। ২০২১ সালে তারা নবম শ্রেণিতে লেখাপড়া শুরু করে। কিন্তু ওই বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তারা সরাসরি ক্লাস করতে পারেনি। এ অবস্থার কারণে তাদের ‘কাস্টমাইজড’ (সংক্ষিপ্ত) সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এবার পাশের হার আগের চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০১৯ সালে পাশের হার ছিল ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ আর ২০২০ সালে ছিল ৮২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এভাবে ২০২১ সালে ৯৩.৫৮ শতাংশ এবং গত বছর ৮৭.৪৪ শতাংশ পাশ করেছে।
তবে ২০১৮ সালের চেয়ে এবার পাশের হার বেশি। ওই বছর পাশ করেছিল ৭৭.৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। দেখা যাচ্ছে, এসএসসিতে ৯টি শিক্ষা বোর্ডে মোট পাশের হার ৮০ দশমিক ৯৪ শতাংশ। মাদ্রাসায় দাখিলে পাশ করেছে ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনালে পাশ করেছে ৮৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ। অন্যদিকে এবার এই স্তরে তিন ধারায় জিপিএ-৫ কমেছে ৮৬ হাজার ২৪টি।
সূত্র জানায়, যেসব শিক্ষা বোর্ডে গণিত ও ইংরেজিতে বিষয়ভিত্তিক পাশের হার ভালো, সেসব বোর্ডের সার্বিক পাশের হারও ভালো। আর যেগুলো পিছিয়ে সেগুলোতে পাশের হার কম। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে ভালো করেছে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড। ওই বোর্ডে পাশের হার সর্বোচ্চ ৯০.১৮ শতাংশ। ভালো পাশের হারের দিক থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে যথাক্রমে রাজশাহী ও যশোর বোর্ড। এই দুই বোর্ডে পাশের হার যথাক্রমে ৮৭.৮৯ এবং ৮৬.১৭ শতাংশ।
দেখা গেছে, এই তিনটি বোর্ডেই পরীক্ষার্থীরা গণিতে ভালো করেছে। আবার সবচেয়ে কম পাশের হার মাদ্রাসা ও সিলেট বোর্ডে যথাক্রমে ৭৪.৭০ ও ৭৬.০৬ শতাংশ। এসব বোর্ডেও গণিতে পাশের হার কম। এই ৫ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে ভালো করা তিনটিতে গণিতে পাশের হার হচ্ছে-বরিশালে ৯১.৪৭ শতাংশ, রাজশাহীতে ৯৪.৩৯ এবং যশোরে ৯৮.৮৯ শতাংশ। আর খারাপ করা দুই বোর্ডে গণিতে পাশের হার- মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে ৮৩.৭৩ শতাংশ আর সিলেট বোর্ডে ৮৮.০৭ শতাংশ।
গণিতে সবচেয়ে খারাপ করেছে ঢাকা বোর্ড। এই বোর্ডে পাশের হার ৭৭.৫৫ শতাংশ, যা সর্বনিম্ন পাশের হারের রেকর্ড থেকে এবার চতুর্থ স্থানে আছে। ইংরেজিতেও একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে সবচেয়ে খারাপ ফল ঢাকা বোর্ডে, ৯০.৮৩ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন পাশের হার দিনাজপুরে ৯০.৯৮ শতাংশ। এটি বোর্ডগুলোর মধ্যে সম্মিলিত পাশের হারে তৃতীয় স্থানে আছে। কুমিল্লায় ৭৮ দশমিক ৪২ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৭৮ দশমিক ২৯ শতাংশ, দিনাজপুরে ৭৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং ময়মনসিংহে ৮৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাশ করেছে। কারিগরিতে ৮৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাশ করেছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক তপন কুমার সরকার যুগান্তরকে বলেন, এবারের ফল গত বছরের সঙ্গে মেলানো সমীচীন হবে না। কেননা গত বছর ও ২০২১ সালে বিশেষ পরীক্ষা নেওয়া হয়। কাস্টমাইজড সিলেবাসের পাশাপাশি কম নম্বরে পরীক্ষা নেওয়া হয়। প্রশ্নের বিকল্প বেশি ছিল। কিন্তু এবার কাস্টমাইজ সিলেবাস হলেও এর আকার বড় ছিল। প্রশ্নের বিকল্প কম ছিল আর পূর্ণ নম্বরে ও সব বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছে।
তিনি বলেন, এর চেয়ে বড় নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে গণিত। এই বিষয়ে ঢাকা বোর্ডে প্রায় ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। কোনো কোনো বোর্ডে ইংরেজিও নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। ঢাকা বোর্ডেই ইংরেজিতে ১০ শতাংশ অকৃতকার্য হয়েছে।
প্রতিবার বেলা ১১টার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ফলের সারসংক্ষেপ হস্তান্তর করা হয়। এবার বড় দুই দলসহ ৩৭ দলের রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে হস্তান্তরের সময় সকাল ৯টায় নির্ধারণ করা হয়েছিল। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে স্কুলের পাশাপাশি অনলাইন এবং এসএমএসে জানা গেছে। বেলা ১১টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সংবাদ সম্মেলন করে। এতে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ফলাফলের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী এসএসসি ও সমমানের ফলের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি জানান, এবার মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ৪১ হাজার ৪৫০ জন। পাশ করেছে ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৪০ জন। তাদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ শিক্ষার্থী। তিন ধারার মধ্যে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে শুধু এসএসসিতে পরীক্ষার্থী ছিল ১৬ লাখ ৩৩ হাজার ৯১৯ জন। পাশ করেছে ১৩ লাখ ২২ হাজার ৪৪৬ জন। মাদ্রাসায় পরীক্ষার্থী ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭ জন, যাদের মধ্যে ২ লাখ ১২ হাজার ৯৬৪ জন উত্তীর্ণ হয়েছে। আর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল পরীক্ষার্থী ছিল ১ লাখ ২২ হাজার ৪৪৪ জন। তাদের মধ্যে ১ লাখ ৫ হাজার ৭৩০ জন পাশ করেছে।
তিনি বলেন, এবার যে পাশের হার ও জিপিএ-৫ পেয়েছে সেটা স্বাভাবিক ফল। কেননা করোনার আগের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পাশের হার ও জিপিএ-৫ দুটি এমনই ছিল। তিনি যোগ করেন, সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ৩০ নভেম্বরের মধ্যে আমরা মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক মূল্যায়ন শেষ করতে চাই।