
প্রিন্ট: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৩৫ এএম

আনু মোস্তফা, রাজশাহী
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন (৫৫) ও জাহাঙ্গীর আলমের (৩৫) ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১ মিনিটে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কারাবিধি অনুযায়ী দুজনের ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল।
দুজনের ফাঁসি কার্যকর করেন জল্লাদ আলমগীর হোসেন। তাকে সহায়তা করেন জল্লাদ নাজমুল, সুমন, উজ্জ্বল, নাসির ও রিয়াজুল। ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ড. এস তাহের আহমেদের মেয়ে আইনজীবী শেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ ও স্ত্রী সুলতানা আহমেদ।
মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। তার বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গার তুজারপুর ইউনিয়নের জানদি গ্রামে। বাবার নাম মিয়া আব্দুল মান্নান। অন্যদিকে জাহাঙ্গীর আলম রাজশাহী মহানগরীর মতিহার থানার খোজাপুর মধ্যপাড়ার আজিমুদ্দিন মুন্সির ছেলে
। ফাঁসি কার্যকরের পর লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়। দুটি পৃথক অ্যাম্বুলেন্সে মহিউদ্দিনের লাশ ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও জাহাঙ্গীরের লাশ খোজাপুর মধ্যপাড়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে ২৫ জুলাই দুই আসামির স্বজনরা কারাগারে শেষ সাক্ষাৎ করেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু। রাত ৯টার পর একে একে কারাগারে আসেন ডিআইজি প্রিজনস কামাল হোসেন, রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) সাবিহা সুলতানা, রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. সাঈদ মোহাম্মদ ফারুক এবং রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপকমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা।
দুই আসামির ফাঁসি কার্যকরকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারা এলাকার মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সন্ধ্যার পর থেকে কারাগার এলাকায় অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
কারাগারের একটি সূত্র জানায়, কারা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে গণপূর্ত অধিদপ্তর ১৫ দিন আগে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুতির কাজ শুরু করে। মৃত্যুকূপটি দীর্ঘদিনের পুরোনো। তাই তারা সংস্কার করে। কারাগারের দক্ষিণ দিকের দেওয়ালের পাশে উন্মুক্ত ফাঁসির মঞ্চটি। এছাড়া আসামিদের তিনগুণ ওজনের বস্তু বেঁধে পরীক্ষা করে ফাঁসির দড়িটিও চূড়ান্ত করা হয়।
প্রথমে ১৭ কয়েদিকে জল্লাদের দায়িত্ব পালনের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে কারা কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় আটজনকে চূড়ান্ত করা হয়। এরা হলেন আলমগীর, নাজমুল, সুমন, উজ্জ্বল, নাসির, মজনু, আশরাফুল ও রিয়াজুল। তাদের মধ্যে প্রধান জল্লাদ আলমগীর হোসেন। তিনি একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। আলমগীর এর আগেও জল্লাদের দায়িত্ব পালন করেছেন।
জল্লাদ দলে দুজন নতুন সদস্য ছিলেন। উজ্জ্বল পুঠিয়ার আলোচিত মহিমা ধর্ষণ মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তাদের প্রশিক্ষণ ও ফাঁসি কার্যকরে একাধিক মহড়া দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আটজনের মধ্যে টিম প্রধান হাতল টেনে ফাঁসি কার্যকর করেন।
বাকি ছয়জনের মধ্যে চারজন দুই আসামিকে ধরে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যান। আর দুজন তাদের কালো কাপড়ের যমটুপি ও গলায় দড়ি পরিয়ে দেন। এর আগে সকাল থেকে মিয়া মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের কয়েক দফা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে কারা কর্তৃপক্ষ।
সূত্রমতে, এক মঞ্চে একইসঙ্গে দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১ মিনিট থেকে ৩০ মিনিট তাদের দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা হয়। পরে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে পাঠানো হয়। এর আগে রাত ৯টার দিকে ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি দুই আসামিকে জানিয়ে দেয় কারা কর্তৃপক্ষ।
এরপর তাদের গোসল করিয়ে খাবারের বিষয়ে শেষ ইচ্ছা আছে কিনা জানতে চাওয়া হয়। পরে কারা মসজিদের ইমাম মাওলানা মোজাহিদুল ইসলাম তাদের তওবা পড়ান। এরপর ১০টার আগেই তাদের ফাঁসির মঞ্চের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পশ্চিম আবাসিক কোয়ার্টার থেকে নিখোঁজ হন অধ্যাপক সৈয়দ তাহের আহমেদ। ২ ফেব্রুয়ারি বাসাটির পেছনের ম্যানহোল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি তার ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ রাজশাহীর মতিহার থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।
এদিকে পুলিশ অধ্যাপক তাহেরের করা একটি জিডির সূত্র ধরে বিভাগের শিক্ষক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও তৎকালীন রাবি শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মাহবুব আলম সালেহীর বাসার কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলমসহ আটজনকে গ্রেফতার করে। ৫ ফেব্রুয়ারি মামলায় গ্রেফতার তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
জবানবন্দিতে তারা বলে, অধ্যাপক তাহের বিভাগের একাডেমিক কমিটির প্রধান ছিলেন। একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য কমিটির সুপারিশ চেয়ে আসছিল। কিন্তু বাস্তব কারণে অধ্যাপক তাহের তা দিতে অস্বীকার করেন।
এদিকে ভাঙ্গা (ফরিদপুর) প্রতিনিধি জানান, মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের লাশ আজ জুমার নামাজের আগেই তার গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন তার ভাই আরজু মিয়া।